✍ উপসম্পাদকীয় (গল্পভিত্তিক বিবরণ)
মেশিনগুলোর চোখ লাল হয়ে জ্বলে উঠছে, অ্যালগরিদম প্রতিদিন ১০০ জনের কাজ করে ফেলছে। আর দূরে, একটি ক্লাসরুমে, এক শিক্ষক সাদা বোর্ডে চক ঘষে বলছেন: ‘ধ্বনি বিশ্লেষণ করো’। বাহিরে চলছে শিল্পায়ন ৪.০, ভেতরে আটকে আছে শিক্ষা ১.০।
বাংলাদেশ আজ যে পরিবর্তনের মোড়ে দাঁড়িয়ে, তাতে প্রযুক্তি আর মানুষের মধ্যে ব্যবধান নয়, বরং মানুষের ব্যবস্থার মাঝেই সবচেয়ে বড় ব্যবধান তৈরি হয়েছে—বিশেষ করে শিক্ষায়। চাকার গতি বাড়ে, পিছু পড়ে শিক্ষা?
শিল্পায়ন ৪.০ বনাম আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার এক অন্তর্দৃষ্টিমূলক যাত্রা
রাতের শহর ঘুমিয়ে পড়লেও কারখানার চাকা ঘুরে। সেই চাকা এখন আর কেবল ধোঁয়া তোলা বয়লারের নয়, বরং মাইক্রোচিপের অভ্যন্তরে ঘূর্ণায়মান সিগন্যালের। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব, বা সংক্ষেপে ৪IR, এমন এক বিশ্ব বাস্তবতার দরজা খুলে দিয়েছে যেখানে মানুষের চেয়ে মেশিন অনেক বেশি দ্রুত, বেশি সুনির্দিষ্ট, আর অনেক সময় বেশি যুক্তিবাদী। কিন্তু এরই ফাঁকে প্রশ্ন ওঠে—এই অতি দ্রুতগতির শিল্পায়নের যুগে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কোথায় দাঁড়িয়ে?
সাত সকালে বিদ্যালয়ের ঘণ্টা বেজে ওঠে। একটি ক্লাসরুমে শিক্ষক সাদা বোর্ডে গাঢ় হাতে লিখে চলেছেন “সমাস ও তার প্রকারভেদ।” জানালার বাইরের দিগন্তে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মহা-উদ্ভাবন, অটোমেশন আর রোবোটিক্স আমাদের দৈনন্দিন জীবন পাল্টে দিচ্ছে; আর ভিতরে, সেই পুরনো পাঠ্যক্রম, সেই মুখস্থনির্ভরতা, সেই অপরিবর্তিত কাঠামো—যেন শিক্ষা নিজেই থেমে গেছে সময়ের গতির কাছে।
শিল্পায়ন ৪.০ কেবল প্রযুক্তিগত এক বিবর্তন নয়; এটি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক এক মোড়। এখানে মানুষের চাকরি এখন আর কেবল মেধার নয়, বরং দক্ষতার, অভিযোজনক্ষমতার, ও সৃজনশীলতার। অথচ আমাদের শিক্ষা এখনও প্রস্তুত করছে একরৈখিক চিন্তাশীল শিক্ষার্থী—যাদের অধিকাংশই বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে সংঘর্ষে হোঁচট খায়।
বিশ্বে যখন বিগ ডেটা বিশ্লেষণ, মেশিন লার্নিং বা ক্লাউড কম্পিউটিং মূলধারার কর্মসংস্থানে পরিণত হচ্ছে, তখন বাংলাদেশে অনেকে এখনো চাকরি বলতে বোঝে বিসিএস বা ব্যাঙ্ক জব। পাঠক্রম আর পরীক্ষার মধ্যে আটকে থাকা এই দৃষ্টিভঙ্গি নতুন সময়ের জন্য এক মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রশ্ন উঠে আসে, কেন এমন ব্যবধান? এর মূল কারণ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় সময়োপযোগী নীতিমালার অভাব, শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাব এবং শিল্পক্ষেত্রের সঙ্গে শিক্ষার সংযোগহীনতা। আমাদের বেশিরভাগ পাঠক্রম কেবল তাত্ত্বিক; বাস্তবমুখী দক্ষতা অর্জনের পরিবেশ নেই বললেই চলে। শিক্ষার্থীরা জানে না কীভাবে একটি পিচ ডেক বানাতে হয়, অথচ তারা রচনার ছন্দ বিশ্লেষণ করতে জানে। তবে আশার আলো আছে। যদি আমরা এখনই উদ্যোগ নিই—পাঠক্রমকে ভবিষ্যতমুখী করি, শিক্ষকদের ডিজিটাল যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ দিই, এবং ছাত্রদের হাতে প্রজেক্ট-ভিত্তিক শেখার সুযোগ তুলে দিই—তাহলে পিছিয়ে পড়া নয়, আমরা এগিয়ে চলতে পারব।
আমাদের দরকার এমন এক শিক্ষা, যা প্রজন্ম ‘Z’-এর দ্রুতগতির চিন্তা, অনলাইনভিত্তিক শেখার অভ্যাস এবং গেমিফিকেশন-ভিত্তিক কৌতূহলের সঙ্গে সঙ্গতি রাখে। যে শিক্ষা তাদের কেবল চাকরির জন্য প্রস্তুত করবে না, বরং জীবনের অনিশ্চয়তায় টিকে থাকার মানসিকতা গড়ে তুলবে। কারণ শিক্ষা আর কেবল মুখস্থ আর পরীক্ষার জন্য নয়—এটা হয়ে উঠতে হবে অভিযোজন, উদ্ভাবন এবং আত্মপ্রতিফলনের এক পাথেয়। আজ যদি আমরা শিক্ষা ৪.০-কে গ্রহণ করতে না পারি, তবে আগামীকাল শিল্পায়ন ৫.০-এর দুনিয়ায় আমরা কেবল দর্শক হয়ে থাকব। শেষে বলি—চাকা ঘুরছে, খুব দ্রুত। যদি আমরা শিক্ষাকে সেই গতিতে না নিয়ে যাই, তাহলে ভবিষ্যৎ একদিন এসে জিজ্ঞেস করবে: "তোমরা প্রস্তুত ছিলে তো?"
শিল্পায়ন ৪.০—বিপ্লব না বিভ্রাট?
শিল্প বিপ্লবের চতুর্থ পর্ব মানে শুধু রোবটিক্স নয়; এটা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বিগ ডেটা, ক্লাউড কম্পিউটিং, এবং ইন্টারনেট অব থিংসের এক মহামঞ্চ। উৎপাদনের গতি ও মান দুই-ই বদলে যাচ্ছে। সাইবার-ভৌতিক ব্যবস্থা প্রতিদিনই মানুষের কর্মজগত বদলে দিচ্ছে। কিন্তু সেই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে কি আমাদের পাঠক্রম, সিলেবাস, বা ক্লাসরুম?
আমাদের শিক্ষা—ধ্বনি বিশ্লেষণ বনাম কোড বিশ্লেষণ!
যে সময়টাতে একজন শিক্ষার্থীকে শেখানো উচিত কীভাবে অ্যাপ তৈরি হয়, তাকে শেখানো হচ্ছে রচনার ব্যাকরণ। চাকরির বাজার চায় প্রজেক্ট ম্যানেজার বা ডেটা অ্যানালিস্ট, আর আমরা তৈরি করছি ‘মাল্টিপল চয়েস’ পরীক্ষায় পাস করা মুখস্থবিদ।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনো অধিকাংশ কোর্স এমনভাবে চলে, যেন চাকরি মানেই সরকারি ফর্ম পূরণ। অথচ আজকের শিল্পক্ষেত্রে চাহিদা সফট স্কিল, ডিজিটাল লিটারেসি, এবং বাস্তবভিত্তিক সমস্যা সমাধানের দক্ষতার।
কেন এই ব্যবধান?
- শিক্ষকেরা অনেকেই প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ নন।
- পাঠ্যক্রম নির্ধারণ হয় ৫-১০ বছর পুরোনো নীতিমালার ভিত্তিতে।
- বাস্তবজ্ঞানচর্চার পরিবেশ দুর্বল।
- শিল্পখাত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব।
উদাহরণস্বরূপ, আপনি কি জানেন যে বাংলাদেশে এখনো অনেক কারিগরি প্রতিষ্ঠানে থিওরিটিক্যাল পড়াশোনাই মুখ্য, হাতে-কলমে শেখার সুযোগ প্রায় নেই?
কী করতে হবে আমাদের?
১. পাঠ্যক্রমের যুগান্তকারী রূপান্তর: শুধু কোর্স নয়, পড়ানোর পদ্ধতিও বদলাতে হবে। সমস্যা-ভিত্তিক, প্রজেক্ট-নির্ভর এবং চ্যালেঞ্জ-নির্ভর শিক্ষা দিতে হবে।
২. শিক্ষকের দক্ষতা বৃদ্ধি: প্রতিটি শিক্ষকের প্রয়োজন রি-স্কিলিং, বিশেষ করে প্রযুক্তি, ইংরেজি, এবং সফট স্কিলের ক্ষেত্রে।ৎ
৩. শিল্প-শিক্ষা সংযোগ: ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যৌথ প্রজেক্ট, ইন্টার্নশিপ, এবং গবেষণামূলক কাজ চালু করতে হবে।
৪. ডিজিটাল অবকাঠামো: প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ইন্টারনেট, স্মার্ট ক্লাসরুম এবং অনলাইন শেখার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
৫. প্রজন্ম Z-কে বোঝা: তারা দ্রুত শেখে, গেমিফিকেশন চায়, আর চায় শেখার স্বাধীনতা। সেই অনুযায়ী শিক্ষা পদ্ধতি রূপান্তর প্রয়োজন।
শেষ কথা—“চাকা যদি ঘোরে, তবে তার সঙ্গে ঘোরানো দরকার পাঠের চাকা, শিক্ষার চাকা এবং চিন্তার চাকা। নইলে আমরা রোবট তৈরি করব, কিন্তু চালাতে পারবো না।” বাংলাদেশের শিক্ষার দিগন্তে এখন একটি প্রশ্নই ধাক্কা দিচ্ছে: “আমরা কি শুধুই শিক্ষিত মানুষ তৈরি করছি, আমরা কী ভবিষ্যত পৃথিবীর জন্য মানুষ প্রস্তুত করতে পারছি?”
- অধ্যাপক ড. মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা সম্পাদক, আমাদের অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com)
#IndustrialRevolution4 #EducationSystemBangladesh #4IR #SmartIndustry #DigitalTransformation #BanglaEducationCrisis #AutomationVsEducation #Edu4_0 #BangladeshVision2041

আপনার মূল্যবান মতামত দিন: