সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার বন্যা পরিস্থিতির ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। শুক্রবার বিকালে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটলে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সব ধরণের ফ্লাইট উঠা-নামা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
সিলেট বিমানবন্দর সিভিল অ্যাভিয়েশনের ম্যানেজার আবদুল হাফিজ শুক্রবার বিকালে জানান, রানওয়ের কাছাকাছি পানি এসে যাওয়ায় বেলা সাড়ে ৩টায় তারা সব ধরণের বিমান চলাচল আগামী ৩ দিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছেন। সিলেটের বিভিন্ন খাল ও ড্রেন দিয়ে পানি প্রবেশ করছে। নদী উপচে শাবি ক্যাম্পাসে পানি ঢুকলে সেখানে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ শুরু হয়েছে। শাবিতে ২৫ জুন পর্যন্ত পরীক্ষা ও ক্লাস স্থগিত করা হয়েছে। সেখানে বিদ্যুৎ ও পানির অভাব দেখা দিয়েছে। আবাসিক শিক্ষার্থীরা হল ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। ছাত্রীদের নিরাপদে সরানো হচ্ছে। সিলেট শহরের বহু আবাসিক এলাকা ডুবে গেছে।
এদিকে স্মরণকালের বন্যা পরিস্থিতিতে বানভাসি মানুষের উদ্ধার, ত্রাণ বিতরণ, চিকিৎসা প্রদানসহ বিভিন্ন বিষয়ে সহযোগিতার জন্য ৮ প্লাটুন সেনা সদস্য নামানো হয়েছে সিলেট ও সুনামগঞ্জে। সিলেটস্থ ১৭ পদাতিক ডিভিশন সিলেটের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং বরাবর সিলেটের জেলা প্রশাসক মজিবুর রহমান চিঠি পাঠালে ৮ প্লাটুন সেনা সদস্য মাঠে নামানো হয়। সেনাবাহিনীর সদস্যরা পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে পৌঁছানো, চিকিৎসা সহায়তা, খাবারের ব্যবস্থা, খাদ্য গুদাম রক্ষার করার কাজে নেমেছে। সিলেটে সেনাবাহিনীর ১৭ পদাতিক ডিভিশন প্রধান মেজর জেনারেল হামিদুল হক এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
এদিকে সিলেট শহরের কুমারগাঁওয়ের বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখিন। বেলা সাড়ে ৩টার দিকে প্রকৌশলীরা জানান, ৪-৫ ইঞ্চি পরিমাণ পানি বাড়লে পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করবে। সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধূরীসহ সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা ওই কেন্দ্রের চারদিকে বালির বস্তা দিয়ে বাঁধ দিয়ে পানি আটকানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। মেয়র আরিফ জানান, যেকোনো মূল্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু রাখতে হবে। নতুবা সিলেট সারাদেশের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।
কুমারগাঁওয়ের বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বন্যার পানি।
সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় বন্যার কারণে হাওর-নদী, গ্রাম শহর এখন একাকার। হাওরের গর্জন, তীব্র পানির স্রোতের দৃশ্য এবং আকাশে মেঘের ঘন ঘন গর্জন, বজ্রপাত বানভাসি মানুষদের আতঙ্কিত করে তুলেছে। দুই জেলার বন্যাকবলিত অন্তত ১৪ লাখ মানুষ খাদ্য ও আশ্রয়ের সন্ধানে। বন্যাকবলিত এলাকার একতলা বাড়ির রান্নার চুলা বহু আগেই ডুবে গেছে।
অন্যদিকে সুনামগঞ্জ জেলা শহরে গ্যাস, বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন। অনেক স্থানে মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। এলাকার প্রকৃত খবরাখবর সংগ্রহ করা- এমনকি সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের সঙ্গেও যোগাযোগ সম্ভব হচ্ছে না। ধনী-গরিব সবার জন্য শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি, বিস্কুট, মোমবাতি, দিয়াশলাই এখন বেশি প্রয়োজন। সুনামগঞ্জের ৭ উপজেলার পরিস্থিতি ভয়াবহ। এই দুই জেলায় অন্তত ১৫ লাখ মানুষ এখন পানিবন্দি।
পানিতে ঢুবে গেছে সুনামগঞ্জ পুলিশ লাইনস।
বর্তমানে হাওর ও জনপদ একাকার। চারদিকে শুধু পানি আর পানি। সুনামগঞ্জ জেলা সদরের সাথে বিভাগীয় শহর সিলেটের সড়ক যোগাযোগ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়ই বন্ধ হয়ে গেছে।
মসজিদ-মন্দির সব খানে পানি। শহরের বহু বাসাবাড়িতে এখন বুক পানি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুটি অফিসই ডুবে গেছে। জেলা প্রশাসকের বাসভবন, পুলিশ সুপারের অফিসসহ প্রতিটি উঁচু স্থান ও ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্র ডুবিয়ে দিয়েছে ঢলের পানি। অনেকেই বাড়ি ঘর ফেলে সিলেটের দিকে চলে এসেছেন। জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা চলছে।
পরিস্থিতি গুরুতর রূপ নিয়েছে সিলেটের গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও সিলেট সদর এবং সুনামগঞ্জ পৌর এলাকা, সদর, ছাতক, দোয়ারাবাজার ও বিশ্বম্ভরপুরে। সিলেটের জেলা প্রশাসক মজিবুর রহমান বিকালে বলেন, সিলেটে অন্তত ১০ লাখ লোক পানিবন্দি। সেনাবাহিনীর লোকজন মাঠে নেমেছেন। তারা উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতায় সহযোগিতা করবেন। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত ৩২০টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ১০ হাজারের বেশি লোক আশ্রয় নিয়েছে। ৪০০ টন খাদ্য সহায়তা দেয়া হয়েছে সিলেটে। অনেক স্থানে বিদ্যুৎে না থাকার কারণে মোবাইল নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানান সিলেটের জেলা প্রশাসক।