07/22/2025 বিমান বাহিনীর পুরাতন প্রযুক্তির বিপর্যয়:
odhikarpatra
২২ জুলাই ২০২৫ ০৩:৩৭
(একটি বিশেষ সম্পাদকীয়)
প্রকাশকাল: মঙ্গলবার, বর্ষাকাল
তারিখ: ৬ই শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ; ২১ জুলাই, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ; ২৫শে মহররম, ১৪৪৭ হিজরি।
স
ম্প্রতি রাজধানী ঢাকার উত্তরা এলাকায় মাইলস্টোন স্কুলসংলগ্ন স্থানে একটি যুদ্ধ প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হইয়া ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মোঃ তৌকির ইসলামসহ অন্তত ঊনবিংশজন নিহত হন এবং শতাধিক মানুষ আহত ও দগ্ধ হন। নিহতদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন কোমলমতি শিক্ষার্থী ও পথচারী। এই শোকাবহ দুর্ঘটনা নিছক প্রযুক্তিগত ত্রুটির ফল নহে—ইহা আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতা ও রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকারের ঘাটতির করুণ প্রতিচ্ছবি।
এই প্রেক্ষিতে উক্ত সম্পাদকীয়ের শিরোনাম কেবল বাক্য নহে—ইহা একটি সময়োপযোগী ও যুক্তিযুক্ত আহ্বান। একবিংশ শতাব্দীর প্রগতিশীল বিশ্বে যেখানে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে প্রতিনিয়ত অগ্রগতি ঘটিতেছে, সেখানে আমাদের বিমান বাহিনীতে এখনো পুরাতন ও ঝুঁকিপূর্ণ প্রযুক্তি ব্যবহার করা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক এবং নাগরিক নিরাপত্তার প্রতি চরম অবহেলার নিদর্শন।
বিধ্বস্ত বিমানটি ছিল চীনের তৈরি 'এফ-৭ বিজিআই' মডেলের, যাহা পুরাতন ‘জে-৭’ সিরিজের একটি সংস্করণমাত্র। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বহরে ইহা যুক্ত হইলেও চীন তখনই এই সিরিজের উৎপাদন বন্ধ করিয়াছিল। ‘ইকোনমিক টাইমস’ সূত্রে প্রকাশ, উক্ত বিমান ‘স্বল্প ব্যয়ে’ প্রস্তুতকৃত একটি প্ল্যাটফর্ম, যাহা কার্যকারিতা ও নিরাপত্তার দিক হইতে প্রশ্নবিদ্ধ।
ইহাই প্রথম দুর্ঘটনা নহে। ২০০৮, ২০১৫, ২০১৮ ও ২০২১ সালে একই মডেলের প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হইয়াছেন বিভিন্ন পদমর্যাদার পাইলটগণ। এই সকল ঘটনার বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিমানের যান্ত্রিক ত্রুটি, পুরাতন এয়ারফ্রেম, সীমিত সুরক্ষা ব্যবস্থা এবং আধুনিক ফ্লাইট নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তির অভাবই দুর্ঘটনার মূল কারণ।
ইতিপূর্বে ঘটিয়া যাওয়া বিভিন্ন দুর্ঘটনার পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, উক্ত মডেল-সিরিজভুক্ত যুদ্ধবিমানসমূহে জটিল ও বহুমাত্রিক যান্ত্রিক দুর্বলতা বিদ্যমান। এতদবিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণ থাকা সত্ত্বেও, এই ধরনের যুদ্ধবিমান ব্যবহার করিয়া আমাদের উদীয়মান ও মেধাবী ডিডি পাইলটগণকে প্রশিক্ষণের আওতায় আনিবার প্রচেষ্টা যেনো মৃত্যুর দিকেই আহ্বান জানাইবার শামিল।
Aerospace Global News-এর তথ্য অনুসারে, নতুন প্রজন্মের যুদ্ধবিমানের তুলনায় উক্ত সিরিজের বিমানগুলির দুর্ঘটনার হার অধিকতর। ইহার নানাবিধ কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য—পুরাতন নকশার এয়ারফ্রেম, সীমিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং আধুনিক ফ্লাইট নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তির অভাব।
অতএব, অনিবার্যভাবেই প্রশ্ন জাগে—একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান কেন জনবহুল আবাসিক এলাকার উপর দিয়া উড্ডয়ন করিল? ইহার নিরাপত্তা পরিকল্পনায় কোথায় ছিল ঘাটতি? ব্যবহৃত বিমানটির প্রযুক্তিগত সক্ষমতা কতখানি বর্তমান সময়ের উপযোগী ছিল? এই সকল প্রশ্নের যথাযথ উত্তর খুঁজিয়া বের করাও যেমন নিহত পরিবারসমূহের ন্যায্য অধিকার, তেমনি রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতি আমাদের সম্মিলিত দায়বদ্ধতার প্রকাশও বটে।
বেদনাবিধুর ভাষায় বলা প্রয়োজন, আমাদের বিমান বাহিনীর বহু প্রশিক্ষণ কার্যক্রম এখনো পরিচালিত হয় প্রযুক্তিগতভাবে পশ্চাদপদ ও বহু পুরাতন বিমান ব্যবহার করিয়া। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত ৩৪ বছরে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে মোট ৩২টি বিমান দুর্ঘটনার রেকর্ড রহিয়াছে। এতদসংখ্যক দুর্ঘটনার পরও, উক্ত ব্যবস্থায় কাঙ্ক্ষিত আধুনিকায়নের ছোঁয়া পৌঁছায় নাই।
বিধ্বস্ত উক্ত বিমানটি ছিল চীনে প্রস্তুতকৃত ‘এফ-৭ বিজিআই’ মডেলভুক্ত, যাহা মূলত পুরাতন ‘জে-৭’ সিরিজের একটি পরিমার্জিত সংস্করণ। ২০১৩ সালে যখন বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বহরে ইহা সংযুক্ত হয়, ঠিক সেই সময়েই চীন এই সিরিজের উৎপাদন বন্ধ করিয়া দেয়। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম The Economic Times-এর একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, বাংলাদেশের অনুরোধে ‘এফ-সেভেন বিজিআই’ সংস্করণটি ‘স্বল্প খরচে’ প্রস্তুত করা হইয়াছিল। অর্থাৎ, আমরা একটি এমন প্ল্যাটফর্মে নির্ভর করিতেছি, যাহার কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা উভয়ই প্রশ্নবিদ্ধ।
ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৯৬০ হইতে ১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির বহরে ‘জে-৭’ ছিল সর্বোচ্চ উচ্চতায় উড্ডয়নক্ষম ও দ্রুতগামী জেট যুদ্ধবিমান। পরবর্তীকালে চাহিদা অনুসারে, নির্দিষ্ট ক্রেতার অনুরোধে ইহা কাস্টমাইজ করিয়া নির্মিত হইতে থাকে।
বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রসমূহ যখন আধুনিক যুদ্ধবিমান, রিয়েল-টাইম সিমুলেশন, অটোমেটেড প্রশিক্ষণব্যবস্থা এবং বেসামরিক নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার প্রদান করিতেছে, সেই সময়ে আমরা আজো জীবননাশী ও “কম খরচের” প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল থাকিয়া উড্ডয়ন করিতেছি।
এই বাস্তবতায় একটি মৌলিক প্রশ্ন উঠে আসে—আমরা কি সত্যিই নিরাপদ আকাশসীমা এবং জনগণের প্রাণ ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করিবার মতো রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করিতেছি? একবিংশ শতাব্দীর প্রতিরক্ষা বাস্তবতায়, আমরা কি পারি মান্ধাতার যুগের প্রযুক্তি আঁকড়াইয়া ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হইতে?
বেদনাদায়ক হলেও সত্য, গত ৩৪ বছরে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে মোট ৩২টি বিমান দুর্ঘটনা ঘটিয়াছে। এতদসত্ত্বেও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে কাঙ্ক্ষিত আধুনিকায়ন পরিলক্ষিত হয় নাই। বিশ্বের বহু উন্নত রাষ্ট্র যেখানে রিয়েল-টাইম সিমুলেটর, উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন যুদ্ধবিমান এবং বেসামরিক নিরাপত্তা-নির্ভর প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হইতেছে, সেখানে আমরা এখনো পুরাতন ও জীবননাশী প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল থাকিয়া চলিতেছি।
এই দুর্ঘটনাও যদি নীতিনির্ধারকগণের দীর্ঘ নিদ্রার ব্যাঘাত না ঘটায়, তবে আর কী ঘটাইতে পারে? কুম্ভকর্ণের ঘুম যেমন সহসা ভঙ্গ হয় না, তেমনি এই প্রাণহানিমূলক মর্মান্তিক ঘটনা কি তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনিতে সক্ষম হইবে? প্রশ্ন উঠাই স্বাভাবিক—একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান কেন জনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকার উপর দিয়া উড্ডয়ন করিল? এর নিরাপত্তা পরিকল্পনায় কার ব্যর্থতা বা অবহেলা ছিল? বিমানটি আদৌ কি বর্তমান সময়ের প্রযুক্তিগত মানদণ্ডে উপযোগী ছিল?
এই সকল প্রশ্নের যথাযথ ও দায়িত্বশীল উত্তর প্রদান কেবল নিহত পরিবারবর্গের প্রতি রাষ্ট্রের ন্যায্য কর্তব্যই নয়—বরং ইহা সমগ্র জাতির প্রতি আমাদের সম্মিলিত নৈতিক ও নাগরিক দায়বদ্ধতার প্রকাশ।
অতএব, বর্তমানই হইল সেই উপযুক্ত সময়—যখন আমাদের বিমান বাহিনীকে যুগোপযোগী প্রযুক্তি ও নিরাপত্তা কাঠামোতে রূপান্তরিত করিবার সুপরিকল্পিত রোডম্যাপ প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন একান্ত প্রয়োজন। যুদ্ধবিমান ও প্রশিক্ষণ কাঠামোর আধুনিকায়ন, নিরাপদ প্রশিক্ষণ এলাকা নির্ধারণ এবং নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ—ইহাই হইতে হইবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।
উক্ত দুর্ঘটনা কেবল একটি বিমানের পতন নহে—ইহা আমাদের আত্মবিশ্বাস, নিরাপত্তা সচেতনতা ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ববোধের কঠিন পরীক্ষা।
আমাদের দাবি ও প্রত্যাশা
অধিকারপত্র অনলাইন পরিবার নিহতদের প্রতি গভীর শোক ও সহমর্মিতা প্রকাশ করে, এবং আহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের দ্রুত আরোগ্য ও পুনর্বাসনের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আন্তরিক আহ্বান জানায়। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, অবিলম্বে নিম্নোক্ত পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করা অপরিহার্য—
1. দুর্ঘটনার নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত;
2. সংশ্লিষ্টদের দায় নিরূপণ ও যথোপযুক্ত জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ;
3. জনবসতিপূর্ণ এলাকায় যেকোনো প্রশিক্ষণ উড্ডয়ন কার্যক্রম স্থগিত রাখা;
4. নিহত ও আহতদের পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন প্রদান;
5. একটি স্বাধীন জননিরাপত্তা ও প্রশিক্ষণ মূল্যায়ন কমিশন গঠন;
6. বিমান বাহিনীর আধুনিকায়নে বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ প্রণয়ন ও তার কার্যকর বাস্তবায়ন।
এই হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিয়াছে—রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা খাতের বহু অংশ এখনো ঝুঁকিপূর্ণ এবং যথাযথ পরিকল্পনা ও বাস্তবতাবিবর্জিত। এইটি কেবল একটি যুদ্ধবিমানের পতন নয়—ইহা রাষ্ট্রীয় সচেতনতা, জবাবদিহিতা এবং মানবিক দায়িত্ববোধের এক কঠিন ও করুণ পরীক্ষা। এই শোকাবহ মুহূর্ত হইতে আমরা যদি সত্যিকার শিক্ষা গ্রহণ করিতে পারি, তবে ভবিষ্যতের পথে আমাদের অগ্রযাত্রা হইবে আরও নিরাপদ, আরও দায়িত্বশীল।
অধিকারপত্র অনলাইন পরিবার নিহত সকল ব্যক্তির প্রতি গভীর শোক ও বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে এবং আহত ও দগ্ধ ব্যক্তিগণের দ্রুত চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট আন্তরিক আহ্বান জানায়।
আমরা প্রত্যাশা করি—এই হৃদয়বিদারক ট্র্যাজেডি হইবে একটি সতর্কবার্তা, যাহা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা পরিকল্পনা ও প্রযুক্তিগত সচেতনতার ক্ষেত্রে একটি দৃঢ় এবং কার্যকর মোড় পরিবর্তনের সূচনা করিবে।
দেশের আকাশ হোক নিরাপদ, মানুষের জীবন হোক রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার—এই হোক আমাদের সম্মিলিত অঙ্গীকার।
একটি আগামীর, অধিকারভিত্তিক ও বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ নির্মাণের প্রত্যয়ে—আমরা এগিয়ে চলি
সম্পাদক
অধিকারপত্র অনলাইন
(অধিকবারপত্র: আপনার কণ্ঠ, আপনার অধিকার)
(Dr. Mahbub Litu)
---------------------------------------------------------------
Muhammed Mahbubur Rahaman, PhD (University of Canterbury, New Zealand)
Professor
Department of Special Education, IER
Institute of Education and Research (IER)
University of Dhaka
Dhaka, Bangladesh.

For profile Profile on the web of University of Dhaka, Bangladesh
Research Profile on ResearchGate
Cell: +8801711958348
web: http://mahbubttc.wixsite.com/mahbub
https://orcid.org/0000-0003-2268-301X
Please consider the environment before printing this e-mail