12/10/2025 ধলেশ্বরীর ঢেউয়ে প্রতিরোধের গান: ৭১-এর মুন্সিগঞ্জ বিক্রমপুরের রণাঙ্গনের বীরত্বগাথা | Nodi o Matir Lorai – The River & Soil War of Munshiganj 1971
Dr Mahbub
১০ December ২০২৫ ১০:৩০
বিশেষ ফিচার
ধলেশ্বরী থেকে টংগিবাড়ী, গজারিয়া থেকে হরগঙ্গা কলেজ—মুন্সিগঞ্জের নদী, মাটি ও মানুষের এক বীরত্বের ইতিহাস। ১৯৭১ সালের মুন্সিগঞ্জ ছিল রণকৌশল আর বীরত্বের এক অনন্য ময়দান। ধলেশ্বরীর নৌযুদ্ধ, টংগিবাড়ীর বিজয়, গজারিয়ার গণহত্যা ও নারীদের অংশগ্রহণ—সবই ইতিহাসের গৌরবময় অধ্যায়। ধলেশ্বরীর ঢেউ থেকে টংগিবাড়ীর বিজয়, গজারিয়ার রক্তক্ষয়ী প্রতিরোধ—১৯৭১-এর মুন্সিগঞ্জ বিক্রমপুরের রণাঙ্গন আজও সাহস, ত্যাগ আর বীরত্বের প্রতীক।
Translation: From Dhaleshwari to Tongibari, from Gazaria to Harganga College — a heroic chronicle of Munshiganj’s rivers, soil, and people In 1971, Munshiganj became a battlefield of courage and strategy — from the Dhaleshwari naval battles to Tongibari’s victory and Gazaria’s tragedy.
৭১-এর মুন্সিগঞ্জ বিক্রমপুরের রণাঙ্গনের বীরত্ব গাথা
১৯৭১ সালের মুন্সিগঞ্জ ছিল রণকৌশল আর বীরত্বের এক অনন্য ময়দান। বিক্রমপুরের এই অঞ্চলটি ঢাকা থেকে কাছে হওয়ায় কৌশলগতভাবেই এটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নদীমাতৃক এই জনপদে মুক্তিযোদ্ধাদের যে দুর্ধর্ষ প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে উঠেছিল, তাকে এক কথায় বলা যায় ‘নদী ও মাটির লড়াই’।
৭১-এর মুন্সিগঞ্জ রণাঙ্গনের কিছু উল্লেখযোগ্য গল্প নিচে তুলে ধরা হলো:
মুন্সিগঞ্জের রণাঙ্গন উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ
মুন্সিগঞ্জের রণাঙ্গন ছিল ঢাকা বিজয়ের অন্যতম প্রবেশপথ। স্থানীয় সাধারণ মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়ে, তথ্য দিয়ে এবং খাবার দিয়ে যে সহযোগিতা করেছিলেন, তা এই রণাঙ্গনের গল্পকে পূর্ণতা দেয়। ১১ ডিসেম্বর যখন মুন্সিগঞ্জ হানাদার মুক্ত হয়, তখন তা ছিল মূলত এই সাধারণ মানুষ আর অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধাদের দীর্ঘ ৯ মাসের সম্মিলিত ত্যাগের ফসল। নিচে কয়েকটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের কথা তুলে ধরা হলো:
ক) ধলেশ্বরীর যুদ্ধ – সারাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল চাঙ্গা করেছিলো
মুন্সিগঞ্জের রণাঙ্গনে নৌ-যুদ্ধ বা ধলেশ্বরী নদীর যুদ্ধ ছিল পাকিস্তানিদের জন্য যমদূত। নদীর প্রতিটি বাঁক আর কচুরিপানাকে ব্যবহার করে মুক্তিযোদ্ধারা যেভাবে পরাক্রমশালী পাকিস্তানি বাহিনীকে কুপোকাত করেছিলেন, তা আজও শিহরণ জাগায়। মুন্সিগঞ্জের অন্যতম দুর্ধর্ষ ‘ধলেশ্বরীর নৌ-অপারেশন’ এবং একজন কিংবদন্তি মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বগাথা নিচে তুলে ধরছি:
১. ধলেশ্বরী নদীর সেই অতর্কিত আক্রমণ: মুন্সিগঞ্জ শহর ও আশপাশের এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনী বড় বড় লঞ্চ ও স্পিডবোট ব্যবহার করে নদীপথে টহল দিত। ১৯৭১ সালের মাঝামাঝি সময়ে মুক্তিযোদ্ধারা খবর পান যে, পাকিস্তানি বাহিনীর একটি বড় অস্ত্রবাহী কার্গো এবং সাথে দুটি গানবোট ধলেশ্বরী দিয়ে ঢাকার দিকে যাচ্ছে।
২. কিংবদন্তি মুক্তিযোদ্ধা—বীর বিক্রম শাহজাহান এবং বীরপ্রতীকদের গল্প: মুন্সিগঞ্জের রণাঙ্গনের কথা বললে কমান্ডার শাহজাহান (বীর বিক্রম) বা বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান ভোলা অসম্ভব। তাদের অধীনেই গড়ে উঠেছিল শক্তিশালী গেরিলা বাহিনী।
৩. সাধারণ মানুষের অবদান: রণাঙ্গনের গল্পের একটি বড় অংশজুড়ে আছেন স্থানীয় মায়েরা। তারা নিজের জীবন বাজি রেখে মাটির নিচে গর্ত করে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র লুকিয়ে রাখতেন। শত্রুসেনারা বাড়িতে তল্লাশি চালাতে এলে তারা কৌশলে মুক্তিযোদ্ধাদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করতেন। মুন্সিগঞ্জের সাধারণ মানুষের এই নিঃস্বার্থ সমর্থনই রণাঙ্গনকে সচল রেখেছিল।
৪. চূড়ান্ত বিজয়—১১ ডিসেম্বরের ভোর: ১০ ডিসেম্বর রাত থেকেই মুক্তিযোদ্ধারা চারদিক থেকে শহর মুন্সিগঞ্জ ঘিরে ধরেন। হরগঙ্গা কলেজের পাকিস্তানি ক্যাম্প লক্ষ্য করে অবিরাম গুলিবর্ষণ শুরু হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে পাকিস্তানিরা বুঝতে পারে যে, পালানো ছাড়া আর পথ নেই। অবশেষে ধলেশ্বরীর কুয়াশাচ্ছন্ন বুক চিরে ১১ ডিসেম্বর ভোরে তারা মুন্সিগঞ্জ ছেড়ে পালায়।
একটি ঐতিহাসিক তথ্য: মুন্সিগঞ্জের টংগিবাড়ী মুক্ত হওয়ার সংবাদ বিবিসি যখন প্রচার করে, তখন সারা বিশ্বের মানুষ জানতে পারে যে বাংলাদেশের জেলা শহরগুলোর পতন শুরু হয়েছে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় সন্নিকটে।
খ) 1971 এর রণাঙ্গনে এক রক্তাক্ত মহাকাব্য: মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া ও খাসকান্দি’র যুদ্ধ
মুন্সিগঞ্জের রণাঙ্গনে গজারিয়া ও খাসকান্দি হলো এক রক্তাক্ত মহাকাব্য। ১৯৭১ সালের ৯ মে গজারিয়ার মাটিতে পাকিস্তানি বাহিনী যে নারকীয় তাণ্ডব চালিয়েছিল, তা কেবল মুন্সিগঞ্জ নয়, গোটা বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম জঘন্যতম গণহত্যা হিসেবে বিবেচিত।
নিচে গজারিয়া ও খাসকান্দির সেই বিভীষিকাময় রক্তঝরা ইতিহাসের খতিয়ান তুলে ধরা হলো:
১. কালরাত্রি — ৯ মে, ১৯৭১: সেদিন ছিল রবিবার। ঈদের আর মাত্র কয়েক দিন বাকি। ভোরের আলো ঠিকমতো ফোটার আগেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি বিশাল দল কয়েকশ’ নৌযান ও গানবোট নিয়ে মেঘনা নদী পার হয়ে গজারিয়া আক্রমণ করে। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল গজারিয়া সংলগ্ন গ্রামগুলো।
২. অবরুদ্ধ ১০ গ্রাম ও বধ্যভূমি: হানাদাররা গজারিয়া সদর, খাসকান্দি, ভবেরচরসহ আশপাশের অন্তত ১০টি গ্রাম কর্ডন বা ঘেরাও করে ফেলে। কোনো পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই সাধারণ গ্রামবাসী আটকা পড়েন। খাসকান্দি গ্রামটি ছিল এই নৃশংসতার কেন্দ্রবিন্দু। পাকিস্তানি সেনারা প্রতিটি বাড়িতে ঢুকে পুরুষদের টেনে-হিঁচড়ে বের করে আনে।
৩. খাসকান্দির ‘মরণকূপ’ ও অগ্নিসংযোগ: গুলি করার পর ঘাতকরা ক্ষান্ত হয়নি। তারা অনেক আহত মানুষকে জীবিত অবস্থায় গণকবরে মাটিচাপা দেয়। এরপর কয়েকশ’ ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। মুহূর্তের মধ্যে উৎসবের অপেক্ষায় থাকা গ্রামগুলো পরিণত হয় শ্মশানে। স্বজনহারা মানুষের আহাজারি আর আগুনের লেলিহান শিখায় আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে।
৪. শোক থেকে শক্তির উত্থান: গজারিয়ার এই গণহত্যা স্থানীয় মানুষের মনে দাউ দাউ করে প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। যে তরুণেরা দ্বিধায় ছিলেন, খাসকান্দির সেই রক্ত তাদের রণাঙ্গনে টেনে নিয়ে আসে।
৫. বর্তমান স্মৃতি ও শ্রদ্ধা
আজও খাসকান্দির সেই বধ্যভূমি আর মেঘনার পাড় সেই কালরাত্রির সাক্ষ্য বহন করে। স্থানীয়ভাবে নির্মিত স্মৃতিসৌধটি শহীদদের নাম আগলে রেখেছে। প্রতি বছর মুন্সিগঞ্জ মুক্ত দিবস বা মে মাসে এলাকাবাসী অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হৃদয়ে এই শহীদের স্মরণ করেন।
সংক্ষিপ্ত টীকা: খাসকান্দি গণহত্যা ছিল বাঙালিদের ভয় পাইয়ে দেওয়ার একটি চাল, কিন্তু এটি মুন্সিগঞ্জের মানুষকে উল্টো আরও বেশি বিদ্রোহী করে তুলেছিল, যার চূড়ান্ত ফলাফল আমরা দেখি ১১ ডিসেম্বরের বিজয়ে।
মুন্সিগঞ্জের রণাঙ্গনে গেরিলা যুদ্ধ এবং নৌ-কমান্ডোদের ভূমিকা
মুন্সিগঞ্জের রণাঙ্গনে গেরিলা যুদ্ধ এবং নৌ-কমান্ডোদের ভূমিকা ছিল এক অনন্য রণকৌশলের পরিচয়। নদীমাতৃক এই জনপদটি ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর রসদ সরবরাহের অন্যতম প্রধান রুট। এই রুটটি অচল করে দিতে মুক্তিযোদ্ধারা যে অসীম সাহসিকতা দেখিয়েছিলেন, তা ছিল বিশ্বমানের গেরিলা যুদ্ধের উদাহরণ। নিচে মুন্সিগঞ্জের গেরিলা ও নৌ-কমান্ডোদের বীরত্বের আখ্যান তুলে ধরা হলো:
১. ‘হিট অ্যান্ড রান’ — দুর্ধর্ষ গেরিলা যুদ্ধ: মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর, লৌহজং এবং সিরাজদিখান অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল শক্তিশালী গেরিলা নেটওয়ার্ক।
২. নৌ-কমান্ডোদের ‘অপারেশন জ্যাকপট’ স্টাইল: মুন্সিগঞ্জের উত্তাল মেঘনা ও ধলেশ্বরী নদীতে নৌ-কমান্ডোরা ছিলেন পাকিস্তানি সেনাদের সাক্ষাৎ যম। তাদের লড়াইয়ের ধরণ ছিল অবিশ্বাস্য:
৩. কমান্ডো সিরাজউদ্দৌলা ও তাঁর বীরত্ব: মুন্সিগঞ্জের নৌ-কমান্ডোদের কথা বলতে গেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজউদ্দৌলার নাম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়। তিনি এবং তাঁর দল বেশ কিছু সফল অপারেশন পরিচালনা করেন।
৪. নারীদের ভূমিকা — রণক্ষেত্রে ছায়া সহযোদ্ধা: গেরিলা যুদ্ধের সফলতার পেছনে স্থানীয় নারীরা ছিলেন এক বড় শক্তি। তারা কেবল মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার বা আশ্রয় দিতেন না, বরং নিজেদের আঁচলের নিচে গ্রেনেড লুকিয়ে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে পৌঁছে দিতেন। অনেক সময় নারী গেরিলারা পাকিস্তানি ক্যাম্পে তথ্য পাচারের গুরুত্বপূর্ণ কাজও করেছেন।
৫. প্রভাব — ১১ ডিসেম্বরের বিজয় ত্বরান্বিতকরণ: গেরিলা ও নৌ-কমান্ডোদের এই ক্রমাগত আক্রমণের ফলে পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়ে। তারা শহরের ক্যাম্পে (যেমন হরগঙ্গা কলেজ) অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। যখন জল ও স্থল উভয় পথ মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে, তখন পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানি হানাদাররা ১১ ডিসেম্বর ভোরে পালানোর পথ খোঁজে।
সংক্ষিপ্ত টীকা: মুন্সিগঞ্জের গেরিলা যুদ্ধ প্রমাণ করেছিল যে, অস্ত্রশস্ত্র কম থাকলেও মেধা আর মাটির প্রতি মমতা থাকলে আধুনিক সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করা সম্ভব।
— অধ্যাপক ড. মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা সম্পাদক, আমাদের অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com)
#Munshiganj1971 #BikrampurWar #DhaleshwariBattle #GazariaMassacre #BangladeshLiberationWar #FreedomFighters #RiverAndSoilWar #JoyBangla #VictoryDayBangladesh #Muktijuddho