
ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালে দুইজন কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী তথ্য গোপন করে চিকিৎসা নেয়ার পর হাসপাতালটির স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে।
হাসপাতালটির ডাক্তার এবং নার্সসহ মোট ৪২ জন করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন। আক্রান্তদের সবাইকে আইসোলেশনে নেয়া হয়েছে।
এদের মধ্যে কয়েকজন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।
আক্রান্তদের পরিবারের সদস্য ও কাছের মানুষদের কোয়ারেন্টিন করা হয়েছে।
হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী মোঃ রশিদ-উন-নবী বিবিসিকে বলেন, আক্রান্তদের মধ্যে মোট ২৩ জন চিকিৎসক, ১০ জন নার্স ও এবং ৯ জন সেবাকর্মী।
১৩ই এপ্রিল প্রথম চিকিৎসক ও সেবাকর্মীদের নমুনা পরীক্ষা করা হয়।
তিনি বলেন, এর মধ্যে ১৬ই এপ্রিল ১২ জনের এবং ১৭ই এপ্রিল আরো ১০ জনের করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়।
এরপর গতকাল রোববার আরও ১৩ জন চিকিৎসক এবং সাতজন নার্সের করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে।
"নমুনা পরীক্ষার সময় থেকেই 'কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং' করে আমরা চিহ্নিত করেছি। আক্রান্তদের কয়েকজন হাসপাতালে ভর্তি আছেন, বাকীদের আইসোলেশনে রাখা হয়েছে। এছাড়া তাদের 'ক্লোজ কন্ট্যাক্টে' ছিল এমন মানুষদের কোয়ারেন্টিন করা হয়েছে।"
এত বেশি সংখ্যক চিকিৎসক এবং সেবাকর্মী আক্রান্ত হয়ে পড়ায়, প্রতিষ্ঠান হিসেবে কোন ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়োজন আছে কি না, সে বিষয়ে মতামত চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরে চিঠি দেয়া হয়েছে।
এত বেশি ছড়িয়ে পড়ার কারণ কী
এই হাসপাতালটি করোনাভাইরাস সংক্রমিত রোগীদের চিকিৎসার জন্য সরকারের ঘোষিত বিশেষায়িত হাসপাতাল নয়, কিন্তু তা সত্ত্বেও এই হাসপাতালের স্বাস্থ্য-কর্মীদের মধ্যে ভাইরাসে সংক্রমণের হার বিস্ময়কর।
মূলত দুইজন রোগীর তথ্য গোপন করে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এবং পর্যাপ্ত সুরক্ষা সরঞ্জামের অভাবের কারণেই একটি হাসপাতালে এত বেশি করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে বলে মনে করেন চিকিৎসকেরা।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের করোনা ইউনিটের প্রধান অধ্যাপক ডা. শামসুল আলম বিবিসিকে বলেছেন, মূলত দুইজন রোগী যারা তথ্য গোপন করে হাসপাতালে সেবা নিয়েছেন, তাদের মাধ্যমে এই সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে।
"দুইজন অপারেশনের রোগী, যারা তথ্য গোপন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়, এদের দুইজনেরই জরুরী ভিত্তিতে অপারেশন করতে হয়েছিল। ওই দুইজনই নারায়ণগঞ্জ থেকে এসেছিল, এবং তারা দুইজনই এই হাসপাতালে আসার আগেই কোভিড-১৯ শনাক্ত হয়। এই তথ্য কেউই প্রকাশ করেনি।"
তিনি আরো বলেন, "রোগীদের একজন হার্নিয়ার সমস্যা এবং আরেকজনের খাদ্যনালীতে প্যাঁচ লেগে যাওয়ার সমস্যা নিয়ে এসেছিলেন। এমন অবস্থায় এসেছিলেন দ্রুতই অপারেশন করতে হয়, কিন্তু পরে দেখা যায় যে তারা 'প্লেস অব বার্থ' মিথ্যা লিখেছে। ওই দুইটি অপারেশনে যারা যুক্ত ছিলেন, তারা সবাই আক্রান্ত হয়েছেন।"
অধ্যাপক আলম বলেন, রোগী তথ্য গোপন করার কারণে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকেরা অপারেশনের সময় সাধারণ রোগীদের ক্ষেত্রে যেমন ব্যবস্থা নেন, তাই করেছেন। বাড়তি সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহার করেননি।
চিকিৎসক ও সেবাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ-হতাশা
তথ্য গোপন করে রোগীদের হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে ৪২জনের আক্রান্ত হবার বিষয়টি নিয়ে ডাক্তার এবং সেবাকর্মীদের মধ্যে এক ধরণের ক্ষোভ ও হতাশা রয়েছে।
নাম প্রকাশ করতে চাননি এমন কয়েকজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, হাসপাতালে একটি করোনা ইউনিট থাকার পরেও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালে তাদের যথেষ্ট পরিমাণে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম নেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী, একটি পূর্ণাঙ্গ পিপিই সেটের মধ্যে মোট পাঁচটি উপকরণ থাকতে হয়, যার মধ্যে গাউন, গ্লাভস, ফেস শিল্ড বা মুখ ঢাকার আবরণ, চোখ ঢাকার জন্য মুখের সাথে লেগে থাকে এমন চশমা, এবং মাস্ক থাকতে হবে।
কিন্তু ওই চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, করোনা ইউনিটেই কিছু পিপিই গাউন ও গ্লাভস পাওয়া যায়।
কিন্তু মাস্ক বিশেষ করে করোনাভাইরাসে সুরক্ষা দেবার উপযোগী এন-৯৫ মাস্ক দেয়া হয়নি তাদের।
ঘাটতি আগে থেকেই
এর আগেও এই হাসপাতালে সুরক্ষা সরঞ্জামের ঘাটতির কথা শোনা গেছে। মার্চ মাসের ২১ তারিখে ওই হাসপাতালে একটি নোটিশ জারি করে কর্তৃপক্ষ, যাতে হাসপাতাল কর্মীদের নিজ দায়িত্বে মাস্ক জোগাড়ের জন্য আহ্বান জানায়।
ওই নোটিসে বলা হয়, "সম্পদের স্বল্পতার জন্য হাসপাতালের তরফ থেকে সবাইকে মাস্ক সরবরাহ করা যাচ্ছেনা। এমতাবস্থায় ঝুঁকি এড়ানোর জন্য সকলকে নিজ উদ্যোগে মাস্ক ব্যবহারের জন্য অনুরোধ করা হলো।"
পরে সমালোচনার মুখে ওই নোটিস প্রত্যাহার করা হয়।
ওই ঘটনার কয়েকদিন পরেই সরিয়ে দেয়া হয় হাসপাতালের তৎকালীন পরিচালককে।
একটি ব্যাপক ভিত্তিক ধারণা প্রচলিত আছে যে, ওই নোটিস প্রকাশিত হয়ে পড়ার সঙ্গে ওই বদলির সম্পর্ক আছে।
যদিও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন
BBC