04/21/2025 করোনার টিকা নিয়ে জনমনের কয়েকটি সন্দেহের উত্তর: অধ্যাপক আ ব ম ফারুক
amaderodhikarpatra@gmail.com
১৪ জানুয়ারী ২০২১ ০৬:১৫
করোনার টিকা নিয়ে জনমনের কয়েকটি সন্দেহের উত্তর
অধ্যাপক আ ব ম ফারুক
পরিচালক, বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার;
সাবেক ডীন, ফার্মেসি অনুষদ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ফোন: ০১৮৩০০০২৮২৬
আমাদের দেশে করোনাভাইরাসের মহামারি শুরুর পর থেকেই এই অণুজীবটি, তার গতিপ্রকৃতি, চিকিৎসার ওষুধ ও টিকা, পার্শ্ব বা বিরূপ প্রতিক্রিয়া, ইত্যাদি বিষয়ে মানুষের মনে নানা কৌতুহল ও সন্দেহের উদ্রেক হয়েছে। অনেকেই বিভিন্নভাবে এসব বিষয়ে জিজ্ঞেস করছেন। এটা খুবই স্বাভাবিক। কারণ এই ভাইরাসটি পৃথিবীর ইতিহাসে এপর্যন্ত আসা অণুজীবগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ছোঁয়াচে এবং এর কোনো চিকিৎসাপদ্ধতিও জানা ছিল না। তাছাড়া এটি অন্যান্য মহামারির মতো কোনো একটা বিশেষ দেশ বা অঞ্চলে সীমাবদ্ধ না থেকে সারা বিশ্বে একযোগে তার মারণথাবা বিস্তার করেছে এবং নিত্যনতুনভাবে রূপ পাল্টাচ্ছে। সে কারণে সচেতনতার কারণেই মানুষের মনে নানাবিধ প্রশ্ন জন্ম নিচ্ছে। ভাইরাসটি প্রকৃতি থেকে উদ্ভুত নাকি কোনো ল্যাবরেটরিতে মনুষ্যসৃষ্ট এ নিয়েও বহু মানুষের মনে প্রশ্ন রয়েছে। সম্প্রতি ভাইরাসটির উৎস খুঁজতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিজ্ঞানীদের অনুসন্ধানী দলকে এখনো চীনে প্রবেশের অনুমতি না দেয়াতে সংস্থাটির খোদ প্রধানের হতাশা প্রকাশের ঘটনায় এই সন্দেহ আরো দানা বাঁধছে। এই প্রেক্ষিতে করোনাভাইরাসের টিকার কার্যকারিতা ও নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়েও মানুষের মনে প্রশ্ন জাগছে।
আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, সত্যকে যেহেতু দীর্ঘদিন চাপা দিয়ে রাখা যায় না তাই উপরিউক্ত সব প্রশ্ন ও সন্দেহগুলোর উত্তর একসময় নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। কিন্তু এর মধ্যে প্রতিদিন যেভাবে বিশ্বে বিপুল সংখ্যক মানুষ মারা যাচ্ছে তাতে তো বিজ্ঞানীরা ভবিতব্যের হাতে সব ছেড়ে দিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারেন না। মানুষকে বাঁচাতে হলে রোগীকে চিকিৎসা দিতে হবে, প্রতিরোধের জন্য টিকা বের করতে হবে, প্রতিরোধের জন্য আবশ্যকীয় স্বাস্থ্যবিধিগুলো মানতে হবে। এতদিন আমরা যারা আক্রান্ত হয়েছে তাদের জন্য ওষুধ খুঁজেছি। কিছু বেরিয়েছে, ফলে মৃত্যুহার কিছু কমেছে। কিন্তু আরো কার্যকর চিকিৎসা এখনো আমরা খুঁজছি। টিকা ছিল না। সারা বিশ্বে একাগ্র অনুসন্ধানের ফলে কয়েকটি দেশে কয়েকটি টিকা বেরিয়েছে। এখনো আরো কিছু টিকার পরীক্ষা চলছে। এগুলোর কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা শতভাগ নয়। কিন্তু যতদিন এর চাইতে কার্যকর ও এর চাইতে নিরাপদ কোনো টিকা হাতে না আসছে ততদিন তো আমাদেরকে এগুলোই ব্যবহার করতে হবে। পৃথিবীর মানুষ যেখানে অনন্যোপায় হয়ে প্রস্তুত ছিল কোনো টিকা ৫০% কার্যকর হলেও তা ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়ার, সেখানে এই টিকাগুলোর কার্যকারিতা ৭০% থেকে ৯৫%। যখন এর চেয়ে বেশি কার্যকারিতার টিকা পাওয়া যাবে তখন নিশ্চয়ই আমরা সেটাই ব্যবহার করবো। উল্লেখ্য যে আজকের পৃথিবীতে বহুল ব্যবহৃত ফ্লু ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কিন্তু মাত্র ৪০% থেকে ৬০%। শুধু তাই নয়। ফ্লুর টিকা নেয়ার পর এর শরীরে সৃষ্ট এন্টিবডিও দীর্ঘদিন স্থায়ী হয় না। যে কারণে এই টিকা প্রতি বছর নিতে হয়। সে তুলনায় ইয়েল ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব এরিজোনা, ইউনিভার্সিটি অব টরেন্টো এবং ক্যালিফোর্নিয়ার লা জোল্লা ইনস্টিটিউট অব ইমিউনোলজি Ñ এই চারটি বিখ্যাত গবেষণাগারের গবেষণায় দেখা গেছে যে, নবআবিষ্কৃত করোনার এই টিকাগুলো নেয়ার পর অধিকাংশ রোগীর শরীরে করোনার এন্টিবডি ৬ থেকে ১২ মাস, এমনকি আরো বেশি সময় স্থায়ী হয়। তদুপরি পুনরায় আক্রান্তের হারও অত্যন্ত নগণ্য।
আরো আছে। এতকাল আমরা টিকার কার্যকারিতার জন্য শুধুমাত্র টিকার কারণে শরীরে তৈরি হওয়া এন্টিবডির স্থায়িত্বের উপরই নির্ভর করতাম। কিন্তু এখন বিজ্ঞান জেনেছে যে, শরীরে এন্টিবডির স্থায়িত্ব কম হলেও দুশ্চিন্তার কিছু নেই। সৃষ্টিকর্তা শরীরে এত কিছু করে রেখেছেন যে আগে এগুলো জানা ছিল না। এন্টিবডি না থাকলেও টিকা দেয়ার পর শরীরের বি-সেল এবং টি-সেলদেরকে এই এন্টিজেনের অর্থাৎ সম্ভাব্য করোনা ভাইরাসের চেহারা চিনিয়ে রাখে এবং যদি কখনো করোনাভাইরাস শরীরে প্রবেশ করে তখন এন্টিবডি না থাকলেও এই বি-সেল এবং টি-সেলগুলো তাকে ঘিরে ধরে, আক্রমণ করে এবং আরো প্রচুর সংখ্যায় বি-সেল এবং টি-সেল তৈরির জন্য শরীরকে বার্তা পাঠায়, এই বার্তা পেয়ে শরীর তা তৈরি করে এবং করোনাভাইরাস পর্যুদস্ত হয়। এমন চমৎকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শরীরে থাকার পরেও আমরা টিকা নিয়ে কেন তাকে সাহায্য করবো না?
নিরাপত্তার প্রশ্নে বলা যায় যে, এখন পর্যন্ত আবিস্কৃত করোনা টিকার কোনোটাই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত নয়। সবগুলো টিকাই সাধারণভাবে যেসব প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে কিছু এলার্জিক প্রতিক্রিয়া, যার অধিকাংশই মৃদু, হালকা জ্বর, গায়ে সামান্য ব্যথা, ইনজেকশন দেয়ার জায়গা কিছুটা ফোলা বা লাল হওয়া, মাথাব্যথা ও ক্লান্তি। তবে এগুলো সবই স্বল্পস্থায়ী এবং সামান্য ব্যথা বা জ্বরনাশক ওষুধ খেলে এগুলো কমে যায়। অর্থাৎ এসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মারাত্মক নয়। তবে অতি নগণ্য ক্ষেত্রে কারো কারো শরীরে এলার্জিক প্রতিক্রিয়া বেশি হতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) পরিচালিত টিকা-পরবর্তী এক ফার্মাকোভিজিল্যান্স জরীপের এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। তারা গত ১৪-২৩ ডিসেম্বর ২০২০ সময়কালে ১৮,৯৩,৩৬০ জন টিকা গ্রহীতার মধ্যে জরীপ চালিয়ে দেখেছে যে মারাত্মক এলার্জিক প্রতিক্রিয়ার এই হার প্রতি ১ লক্ষ জনে মাত্র প্রায় ১ জন।
সিডিসি তার এই জরীপের ফলাফলে আরো জানিয়েছে যে, ৮৬% ক্ষেত্রে সামান্য কিংবা মারাত্মক উভয় পার্শ¦প্রতিক্রিয়াই টিকা প্রয়োগের আধা ঘন্টার মধ্যে দেখা যায় এবং এদের মধ্যে ৮১% মানুষের এলার্জিক প্রতিক্রিয়ার প্রবণতা রয়েছে। যাদের শরীরে এই প্রতিক্রিয়া দেখা যায় তাদের ৯০% নারী।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত টিকা পেলে খুব ভালো হতো। কিন্তু যতদিন এরকম না পাওয়া যাচ্ছে ততদিন আমাদেরকে করোনার বিরুদ্ধে নীরব দর্শক হয়ে না থেকে সেগুলোকেই ব্যবহার করতে হবে। আমাদের বাল্যকালে কলেরার টিকার কথা আমাদের সমবয়সীদের নিশ্চয়ই মনে পড়বে। সেই টিকা নেয়ার পর ইনজেকশনের জায়গা ভীষণ ফুলে যেতো, প্রচন্ড জ্বর আসতো, খুবই ব্যথা হতো। সে কষ্ট এমনই তীব্র ছিল যে আমরা কয়েকদিন স্কুলে পর্যন্ত যেতে পারতাম না। কিন্তু তার পরেও কলেরার ভয়ে সেই বিভীষিকাময় টিকাও আমরা নিয়েছি। কিন্তু আজ কলেরার টিকা সে রকম ভয়ানক নেই। তা সময়ের, অভিজ্ঞতার ও বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে উন্নত হয়েছে। এখন কলেরার টিকায় মৃদু ব্যথা হয় মাত্র। সব টিকার বেলায়ই নিয়মটা একই। করোনার টিকাও মাত্র বেরিয়েছে। এখন তার যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তা অন্যান্য টিকার তুলনায় কম। যত সময় যাবে ততই এটি আরো উন্নত হবে। কিন্তু ততদিন তো আমাদের পক্ষে বসে থাকা যাবে না। পৃথিবীতে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে কিছু একটা তো করতে হবে। এখন প্রতিরক্ষা পাওয়ার জন্য এখনকার টিকাটাই আমাদেরকে নিতে হবে।
উন্নত হওয়ার পরেও প্রতিটি টিকার ক্ষেত্রেই এখনো কিছু পার্শ¦প্রতিক্রিয়া বা বিরূপ প্রতিক্রিয়া রয়েছে। মানুষ এখনকার দিনে সদ্যোজাত শিশু থেকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত কমবেশি ১৪টি টিকা গ্রহণ করে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব অনুযায়ী গত ২২ বছরে সারা পৃথিবীতে ৩০ লক্ষ মানুষকে বিভিন্ন রকম টিকা দেয়া হয়েছে। এদের মধ্যে ১৮০ জনের ক্ষেত্রে টিকা নেয়ার পর মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, কিন্তু এতে কেউ মারা যাননি। অর্থাৎ গত ২২ বছরে শুধু টিকা নেয়ার কারণে ১৮০ জন অসুস্থ হলেও কেউ বিভিন্ন রকম টিকা নেয়া থেকে বিরত থাকেন নি। এটাই তো সঠিক সিদ্ধান্ত। ওষুধবিজ্ঞানে ‘রিস্ক-বেনিফিট রেশিও’ বলে যে নিয়মটি আছে তা হলো সব ওষুধেরই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। তাই কোনো ওষুধ ব্যবহারের আগে ঝুঁকির চাইতে লাভ বেশি কিনা তা হিসেব করতে হয়। করোনার টিকার বেলাতেও সবাইকে এই লাভ-ক্ষতির বিষয়টি মাথায় রেখেই টিকা নিতে হবে।
টিকা যেহেতু ভাইরাস থেকে তৈরি হচ্ছে এবং করোনা যেহেতু ভীষণ ছোঁয়াচে, তাহলে এই টিকা নিলে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি আছে কিনা তাও অনেকে জিজ্ঞাসা করছেন। এর সোজা উত্তর হচ্ছে, না। করোনার টিকা নিলে এই টিকা থেকে করোনা হওয়ার কারণ নেই। যদি করোনার জীবাণু টিকা নেয়ার আগেই শরীরে ঢুকে থাকে তাহলে এই টিকা কাজ নাও করতে পারে। তাছাড়া এসব টিকার কার্যকারিতা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৯৫%। অতএব ৫% লোকের টিকা নেয়ার পরেও করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা তো আছেই। কিন্তু এজন্য মন খারাপ করে টিকা নেয়া থেকে বিরত থেকে লাভ নেই। ‘ভালো-মন্দ যাই আসুক সত্যরে লও সহজে।’
টিকা থেকে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই এ কারণে যে এসব কোনো টিকাতেই জীবন্ত কোনো ভাইরাস নেই। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও এস্ট্রাজেনেকার যৌথ উদ্যোগের টিকা তৈরিতে সর্দির ভাইরাসকে নিস্ক্রিয় করে ব্যবহার করা হয়েছে। সদ্য আবিষ্কৃত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, জনসন এন্ড জনসন এবং বেথ ইসরায়েল মেডিক্যাল সেন্টারের যৌথ গবেষণার টিকাও একইভাবে ভাইরাসকে মেরে জীন প্রকৌশল প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি করা। এই টিকাটি এখনো মিডিয়াতে আসেনি। এটি এফডিএ-এর অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। সব কিছু অর্থাৎ কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা বিষয়ক পর্যালোচনা ঠিক থাকলে হয়তো এ মাসেই অনুমোদন পেয়ে যাবে। ফাইজার ও বায়োএনটেকের যৌথ টিকা এবং মডার্নার টিকা মেসেঞ্জার আরএনএ প্রযুক্তিতে তৈরি যেখানে জেনেটিক কোডের অতি সামান্য অংশ ব্যবহার করা হচ্ছে, যা দিয়ে ভাইরাসের গায়ের প্রোটিনের মতো কিছু প্রোটিন শরীরের কোষ থেকে তৈরি করা হয় এবং কাজ শেষে এই কোড আপনাআপনিই বিনষ্ট হয়ে যায়। এই করোনা-সদৃশ প্রোটিনগুলোর কারণে শরীরে এন্টিবডি তৈরি হয়ে করোনা প্রতিরোধ করে। চীনের সিনোভ্যাক, রাশিয়ার গামালিয়া ও ভারতের ভারত বায়োটেকের টিকাগুলোও অক্সফোর্ডের মতোই, যেখানে কোনো জীবন্ত বা সুপ্ত ভাইরাস নেই। তাই টিকা থেকে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। এমনকি এগুলো শরীরের ডিএনএ-এরও কোনো পরিবর্তন করতে পারে না।
ক’দিন আগে একটা দেশের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, করোনার টিকা নিলে মানুষ নাকি কুমির হয়ে যাবে। এরকম আজগুবি কথা শুনলে ক্রোধের পাশাপাশি করুণাও হয় যে, এসব লোকজন প্রেসিডেন্ট হয় কি করে।
করোনা মহামারিতে সারা পৃথিবীর মানুষই দিশেহারা। চোখের সামনে অসহায় মৃত্যু দেখে মানুষ আতংকিত। এসময়ে মানুষকে সঠিক পরামর্শটাই দিতে হবে। মিথ্যা আশ্বাস আর বিশ্বাস নিয়ে নয়, সত্যকে তুলে ধরে স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চলা এবং চিকিৎসা বিষয়ক অর্জনগুলোকে ব্যবহার করে সম্মিলিতভাবে আমাদেরকে এই মহাদুর্যোগকে প্রতিরোধ করতে হবে। এখানে মনগড়া, আজগুবি ও অবৈজ্ঞানিক কথাবার্তা মানুষকে আরো বিপদের দিকে ঠেলে দেবে।