04/21/2025 করোনা টিকা গুজবে কান দিবেন না
amaderodhikarpatra@gmail.com
২৩ জানুয়ারী ২০২১ ০৮:৩৯
অধ্যাপক আ ব ম ফারুক
পরিচালক, বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার; সাবেক ডীন, ফার্মেসি অনুষদ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ফোন: ০১৮৩০০০২৮২৬,
ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা নেয়ার পর নরওয়েতে ২৩ জনের মৃত্যুর ঘটনাটি ছিল গত তিন দিনের মিডিয়ার উল্লেখযোগ্য খবর। সেই সাথে জানা গেল যে একই টিকা নিয়ে এর আগে পর্তুগালে একজন নার্সেরও মৃত্যু হয়েছে। ভারতের মধ্য প্রদেশেও নাকি টিকা নিয়ে একজন মারা গেছেন। লোকমুখে প্রচার হয়েছে যে এটির কারণ ছিল অক্সফোর্ডের টিকা।
এখন পর্যন্ত যেসব টিকা বেরিয়েছে সেগুলো যারা নিতে পেরেছে তাদেরকে আমরা সৌভাগ্যবান মনে করছি এবং অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি কবে আমরাও টিকা নেয়ার সুযোগ পাবো। এরকম অবস্থায় টিকা নেয়ার পর তার কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ঘটনা কিংবা মৃত্যুর খবর আমাদেরকে প্রচন্ড নাড়া দেয়। মনে হয় যেন এই হতাশাজনক নিষ্ঠুর প্রাণঘাতী অন্ধকার সুড়ঙ্গ থেকে বুঝি আমরা আর বেরুতে পারবো না।
প্রখ্যাত চিকিৎসা সাময়িকী ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল (বিএমজে) গত শুক্রবার ৮ জানুয়ারি ২০২১ নরওয়েতে ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা নেয়ার ফলে ৮০ বছরের বেশি বয়সী ২৩ জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধার মৃত্যু সংবাদটি প্রকাশের পর সেদেশের সরকারের পক্ষ থেকে খুব বেশি বয়স্ক মানুষদেরকে এই টিকা দেয়ার আগে আরো সতর্ক হওয়ার আহবান জানানো হয়েছে। মরদেহ ব্যবচ্ছেদ করার পর এই ২৩ জনের মধ্যে ১৩ জন শুরুতে টিকার স্বাভাবিক পার্শ¦প্রতিক্রিয়াতেই আক্রান্ত হয়েছিলেন, কিন্তু অত্যধিক বয়সের কারণে এগুলোই একসময় মারাত্মক আকার ধারন করে বলে নিউইয়র্ক পোস্ট জানিয়েছে। নরওয়েজিয়ান মেডিসিন এজেন্সি (নোমা) বলেছে যে ফাইজার-বায়োএনটেক এবং মর্ডার্নার দুটি টিকা ইউরোপে হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবকের উপর পরীক্ষা করার পরই অনুমোদন দেয়া হয়। এদের মধ্যে অনেকেরই বয়স ছিল ৮০/৯০ এর মতো, তবে গড়ে ৫০ বছর বয়সীরাই ছিল বেশি। সে সময় অতি বৃদ্ধদের শরীরে কোনো অস্বাভাবিক বা মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা যায় নি। প্্রথম পর্যায়ে যাদেরকে টিকা দেয়া হয় তাদের মধ্যে অতি বয়স্কদের নার্সিং হোমগুলোও ছিল। কারণ এই হোমগুলোর অধিবাসীদেরকে করোনাভাইরাস সহজেই কাবু করতে পারে। নরওয়েজিয়ান ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথের এ সম্পর্কিত বিবৃতি থেকে দেখা যায় যে টিকার সাধারণ প্রতিক্রিয়াগুলোই তাদের শরীরে এমন বড়ো হয়ে দেখা দিয়েছিল যে মাত্রাতিরিক্ত বয়সের কারণে তারা তা সামাল দিতে পারেন নি। তাদের শরীরের প্রতিরক্ষার ভঙ্গুর অবস্থাটা টিকাদানকারীরা বিবেচনায় নিতে পারেন নি। এই ঘটনা টিকা প্রদানের সময় কি কি বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে তা আরেকবার দেখিয়ে দিল। ইউরোপিয়ান মেডিক্যাল এজেন্সির প্রধান এ ঘটনার পর বলেছেন যে টিকার নিরাপত্তার বিষয়গুলি আরো কড়াকড়িভাবে মেনে চলতে হবে, বিশেষ করে তা যদি নতুন প্রযুক্তি এম-আরএনএ ধরনের টিকা হয়।
নিউইয়র্ক পোস্টের মতে ডিসেম্বরের শেষ ভাগ থেকে নরওয়েতে গত কয়েক সপ্তাহে প্রায় ৩০ হাজার জনকে টিকা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে টিকা নেয়ার পর এই ২৩ জন অতি বৃদ্ধ মারা গেছেন। নোমার মেডিক্যাল ডিরেক্টর বলেছেন যে তাদের এজেন্সি এজন্য ভীষণ ঘাবড়ে গেছে তা নয়, এজেন্সির টিকাদান কার্যক্রম চলবে, তবে সতর্কতা ও নির্দেশনামায় কিছু পরিবর্তন আনা হবে। আলোচ্য ঘটনায় মোট ২৯ জন টিকাগ্রহীতার শরীরে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, যার মধ্যে ছিল জ্বর, বমিভাব, অস্বস্তি লাগা, ইনজেকশনের জায়গায় ব্যথা ও শরীরে এলার্জি। এছাড়া তাদের অন্য কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না। এদের মধ্যে এই ২৩ জনও ছিলেন। বিএমজে তাদের রিপোর্টে বলেছে এই সময়কালে নরওয়ের অতি বৃদ্ধদের নার্সিং হোমগুলোতে সাধারণত গড়ে ৪০০ জন মারা গিয়ে থাকেন।
এদিকে ১ জানুয়ারি ২০২১ তারিখে পর্তুগালে একজন নার্সের মৃত্যুর খবরও গণমাধ্যমে আসে। তিনি এর দুদিন আগে ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা নিয়েছিলেন। একচল্লিশ বছর বয়সী এই ভদ্রমহিলার বাবা ডেইলি মেইল পত্রিকাকে বলেছেন যে তার মেয়ে টিকা নেয়ার পর একেবারেই সুস্থ ছিল। কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও দেখা দেয়নি। তাকে কখনোই অসুস্থ বলে মনে হয়নি। পর্তুগালে টিকা পৌঁছে ডিসেম্বরের ২৮ তারিখে। তিনি পর্তুগালের একটি ক্যান্সার হাসপাতালের নার্স ছিলেন। ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা হিসেবে তাকে ৩০ তারিখে টিকা দেওয়া হয় এবং টিকার পর তার কোনো সমস্যা হয়নি। তার মেয়ে জানিয়েছে যে কেমন লাগছে জিজ্ঞাসা করাতে ইনজেকশনের জায়গায় সামান্য ব্যথার কথা তার মা জানিয়েছিলেন। এছাড়া আর কোনো সমস্যা ছিল না। টিকা নেয়ার পরই মাস্ক পরিহিত কিছুটা স্থুলকায় এই নার্স ফেসবুকে লিখেছিলেন “কভিড-১৯ ভেক্সিনেটেড”। তিনি পরিবারের সাথেই থাকতেন। তবে নববর্ষের দিনে মারা যাওয়ার সময় তিনি তার পার্টনারের বাড়িতে ছিলেন, নিজ বাড়িতে নয়। তার হাসপাতাল জানিয়েছে তারা অটোপসি করে মারা যাওয়ার কারণ জানার চেষ্টা করবে।
তবে বাংলাদেশে উপরিউক্ত ঘটনা দুটির চাইতে যেটি বেশি প্রচার পেয়েছে তাহলো ভারতে সিরাম ইনস্টিটিউটের তৈরি অক্সফোর্ডের টিকা নেয়ার পর একজন মারা গেছে। এটি সত্য নয়। যেটি জানা গেল তাহলো ভারতের মধ্য প্রদেশের ভূপালের ৪২ বছর বয়সী একজন শ্রমিক, যার নাম দীপক মারায়ী, গত ডিসেম্বরের ১২ তারিখে ভারত বায়োটেকের মানব শরীরে পরীক্ষাধীন ‘কোভ্যাক্সিন’ নামক টিকা নিয়েছিলেন। এটি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়-এস্ট্রাজেনেকার আবিস্কৃত ও ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের তৈরি ‘কোভিশিল্ড’ নয়। সে সময় ভারত বায়োটেকের এই টিকার তৃতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছিল এবং তিনি একজন নিবন্ধিত স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে টিকা নিয়েছিলেন। ভারতীয় বার্তা সংস্থা প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া এবং দিল্লির ইংরেজি পত্রিকা ‘জাগরণ’ থেকে জানা যায় যে তিনি স্বেচ্ছায় সব নিয়মকানুন মেনেই এই ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে অংশ নিতে রাজী হয়েছিলেন, তাকে নিবন্ধনের সময় স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়েছিল এবং সেদিন টিকা দেয়ার আগে তার সম্মতিও নেয়া হয়েছিল।
তার পরিবারের ভাষ্য অনুযায়ী টিকা নেয়ার পর তিনি অস্বস্তি বোধ করতে থাকেন এবং কিছু সমস্যার কথা বলেন। টিকা নেয়ার পাঁচদিন পর তিনি ঘাড়ে ব্যথা অনুভব করেন। তার দুদিন পর তার মুখ থেকে ফেনা বের হয়। কিন্তু তিনি হাসপাতালে যেতে বা ডাক্তার দেখাতে রাজি হন নি। তিনি পরিবারকে বলছিলেন যে এগুলো দুয়েক দিনে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ২১ ডিসেম্বর অবস্থার অবনতি হলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি পথে মারা যান।
মধ্য প্রদেশের মেডিকো-লিগ্যাল ইনস্টিটিউটের পরিচালক এ বিষয়ে বলেন, যারা তার পোস্ট মর্টেম করেছেন তারা সন্দেহ করছেন যে বিষাক্ত কিছু খাওয়ার ফলে তার মৃত্যু হয়েছে। তবে ভিসেরা পরীক্ষা করলে সত্যি কারণটা জানা যাবে বলে তা করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
যে কোনো মৃত্যুই আমাদের জন্য বেদনার। আমরা টিকা নেয়ার পর মৃত্যুর তিনটি ঘটনার বিবরণ থেকে অনুমান করি যে, নরওয়ের ২৩ জনের মৃত্যুর সাথে টিকার সম্পর্ক রয়েছে। যেখানে অতিবৃদ্ধ, শিশু ও গর্ভবতী মায়েদেরকে বর্তমানের টিকাটি দিতে বারণ করা হয়েছে সেখানে একেবারে জবুথবু বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদেরকে এই টিকা দেয়া উচিত হয়নি। ফাইজার-বায়োএনটেকের উচিত ছিল বিষয়টি আরো স্পষ্ট করে টিকার ব্যবহারবিধি ও নির্দেশনামায় বলা। আর টিকা প্রয়োগকারীদের উচিত ছিল টিকা গ্রহীতার শারীরিক অবস্থা দেখে তাদের শরীরের ইমিউনিটির সম্ভাব্য অবস্থা সম্পর্কে অনুমান করে তাদেরকে টিকা না দেয়া। কারণ এটি স্বতঃসিদ্ধ যে অতি বয়স্কদের ইমিউনিটি কম থাকে এবং তারা দুর্বল স্বাস্থ্যের হলে তা আরো কম থাকে। কিংবা করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আশংকা খুব বেশি থাকলে তাদেরকে স্বাভাবিক মাত্রার অর্ধেক মাত্রা দেয়া উচিত ছিল। অনেক ওষুধের বেলাতেই তা করা হয়ে থাকে।
দ্বিতীয় ঘটনাটি অর্থাৎ পর্তুগালের এই নার্সের টিকাজনিত কোনো সমস্যাই ছিল না। টিকা নেয়ার পর কোনো সমস্যা হলে তা টিকা নেয়ার আধাঘন্টার মধ্যেই দেখা দেয়। তার বেলায় সে রকম কোনো ঘটনা ঘটেনি, এমনকি ২৪ বা ৪৮ ঘন্টা পরেও নয়। তাই সম্ভবত এই মৃত্যুর ঘটনাটি টিকা নেয়ার সাথে সম্পর্কিত নয়। স্থুলকায়দের হঠাৎ মৃত্যুর একটা প্রধান কারণ হার্ট এটাক। তিনি কিছুটা স্থুলকায়া ছিলেন। আবার হতে পারে যে নতুন বছরের আগমন উদযাপনের আনন্দে নিজের বাড়ির বদলে তিনি যে পার্টনারের বাড়িতে ছিলেন, যেখানে বিদেশের প্্রথা অনুযায়ী অপরিমিত খাদ্য-পানীয়ের ব্যবস্থা ছিল। উৎসবের উচ্ছাসে নিয়ন্ত্রণহীন হওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে। সেখান থেকে হয়তো কোনো সমস্যা হয়েছে। তবে অটোপসি রিপোর্ট এলেই প্রকৃত কারণটি জানা যাবে।
তৃতীয় ঘটনাটি অর্থাৎ ভারত বায়োটেকের টিকা নেয়ার নয় দিন পর একজনের মারা যাওয়ার ঘটনাটি আপাতদৃষ্টিতে খাদ্য বা পানীয়ে বিষক্রিয়ার কারণে ঘটেছে বলেই মনে হয়। কারণ টিকা নেয়ার সাথে সাতদিন পর মুখ দিয়ে ফেনা বেরুনোর সামান্য যোগসূত্রও নেই। তাছাড়া তিনি অসুস্থতা বোধ করা সত্তে¡ও ডাক্তারের কাছে বা হাসপাতালে যেতে না চাওয়াটা সন্দেহজনক। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে নিবন্ধিত হওয়ার পর বা পরীক্ষাধীন টিকা নেয়ার পর তার যাবতীয় অসুস্থতার চিকিৎসা একেবারে বিনামূল্যে করার দায়িত্ব নিবন্ধনকারী সংস্থার। এমনকি তিনি খারাপ কিছু হলে ক্ষতিপূরণও পেতেন। ক্লিনিক্যাল স্টাডির এটাই নিয়ম। কিন্তু তিনি ডাক্তারের কাছে যেতেই রাজি ছিলেন না। সম্ভবত গেলে তার এমন কিছু কাজ প্রকাশ হয়ে যাবে যা ক্লিনিক্যাল স্টাডির সময় তিনি করতে পারবেন না বলে অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিলেন, তাই যেতে চান নি।
কোনো টিকাই ১০০% নিরাপত্তা দেয় না। তাই টিকা নিলেই সবাই করোনামুক্ত হবেন না। কিছু মৃত্যুর ঘটনা ঘটবে। এটা মেনে নিতে হবে। কিন্তু আশ্চর্য হই যে ভারতে একজন মারা যাওয়ার এই শেষোক্ত ঘটনাটিকে বিকৃত করে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় আবিস্কৃত ও সিরাম ইন্ডিয়ার উৎপাদিত টিকার ঘাড়ে চাপিয়ে কারা কি ফায়দা নিতে চান? আমাদের দেশে কয়েকদিন পরেই এই টিকাটি চলে আসছে। এটি বিতরণ ও প্রয়োগের জন্যও সবকিছু প্রস্তুত বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। প্রতিদিনই করোনায় নতুন নতুন আক্রান্ত হওয়া ও মারা যাওয়ার দুঃসংবাদগুলো আমাদেরকে শুনতে হচ্ছে। টিকা নিলে আমরা যেখানে বেশ কিছুটা নিরাপত্তা পাই সেখানে ইন্টারনেটে যারা এই টিকার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে তারা কারা? অন্য আরেকটি টিকা নেয়ার পর মৃত্যুর ঘটনা এই টিকার নামে চালাচ্ছেন কি এটি বাংলাদেশে আনা হচ্ছে বলে? এতে তারা কী অর্জন করতে চান? আরো বেশি আক্রান্ত হওয়া ও আরো বেশি মানুষ মারা যাওয়ার মতো অমানবিক ও নিষ্ঠুর প্রত্যাশাই কি তারা করছেন?
জনস্বাস্থ্য রক্ষার স্বার্থে এসব অসত্য প্রচার ইন্টারনেট থেকে দ্রুত সরানোর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানাচ্ছি।