04/19/2025 মাতৃভাষাপ্রেমী শহর তাবরিযে বাংলাদেশ
MASUM
১২ আগস্ট ২০১৭ ০০:৩২
ইরানের একমাত্র ব্যতিক্রমী প্রদেশ পূর্ব আজারবাইজান। কেননা এই প্রদেশের আবাল-বৃদ্ধা-বনিতা প্রায় সবাই ফারসি ভাষার বদলে তুর্কি ভাষায় কথা বলে থাকেন। তুরস্কের ভাষার সঙ্গে এই ভাষার তেমন মিল নেই, কারণ এখানকার লোকজনের ভাষা তুর্কি-আজারি। শুধুমাত্র সরকারি কাজকর্ম, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম বা তুর্কি না জানা লোকদের সঙ্গে এখানকার অধিবাসীরা ফারসি ভাষায় কথা বলেন। ইরানের একমাত্র ভিক্ষুকমুক্ত শহর হিসেবেও তাবরিযের যথেষ্ট খ্যাতি রয়েছে। এই শহরেই সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়েছে ইরানের বিজ্ঞান, গবেষণা ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ইরানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেলে অধ্যয়নরত বিদেশি শিক্ষার্থীদের ১৫তম মাস্টার্স ও পিএইচডি গ্র্যাজুয়েশন উৎসব (The 15th Graduation Ceremony For Non-Iranian Students) ও দশম আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক উৎসব। এবার এই উৎসবে রেকর্ড সংখ্যক ৪০টি দেশের প্রায় পাঁচ শ শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেন।
উল্লেখ্য, এখানকার মন্ত্রণালয়ের নিয়মানুযায়ী শিক্ষার্থীরা পিএইচডি অষ্টম সেমিস্টার (প্রতি সেমিস্টার ছয় মাস) ও মাস্টার্স চতুর্থ সেমিস্টার হলেই এই সমাবর্তনে অংশগ্রহণ করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরবর্তী সমাবর্তনের আগেই কোর্স শেষ হওয়ার ছাড়পত্র নিয়ে নেন। ইরানে এটি আমার সর্বশেষ বছর, তাই আমাকেও এই সমাবর্তনে অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয়। অত্যন্ত গর্বের বিষয় ছিল, প্রায় পাঁচ শ শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে ছেলেদের ক্যাটাগরিতে আমাকে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য নির্বাচিত করা হয়। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে এটি আমার জন্য ছিল পরম পাওয়া! পাঁচ মিনিট সময় বেঁধে দেওয়া ফারসি বক্তব্যে ইরানের খাবার-দাবার, ইতিহাস-ঐতিহ্য, কবি-সাহিত্যিকদের সমাধির বিবরণসহ কবিতার পঙ্ক্তির ফুলঝুরি ছোটানোর চেষ্টায় নয় মিনিটে বক্তব্য শেষ করেছি।
ইরানের প্রায় ২৫টি প্রদেশ ভ্রমণের সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। যেহেতু তাবরিযের প্রায় সকলে তুর্কি ভাষায় কথা বলতে পছন্দ করেন, তাই টুকটাক তুর্কি ভাষায় কথা বলেছিলাম। পূর্ব আজারবাইজানের প্রাদেশিক গভর্নর ড. জাব্বার যাদেহ বক্তব্য শেষ হওয়ার পরে ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরেন। এটি আমাকে দারুণ আপ্লুত করেছিল। এ ছাড়া লোরেস্তানের প্রচলিত আঞ্চলিক ভাষায়ও কিছু বলার চেষ্টা করেছি। কেউ কেউ বিভিন্ন প্রদেশের খাবার-দাবারের বিবরণ শুনে মিলনায়তন থেকে মোবাইল ফোনে এসএমএস পাঠিয়ে লিখেছেন—‘আমাদের পুরো জাতিকে ক্ষুধার্ত বানিয়ে দিলে!’ এ ছাড়া ওই দিন রাতে তাবরিযের টেলিভিশন চ্যানেলে প্রতি ঘণ্টায় সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়েছে। এটি একজন বাংলাদেশি হিসেবে আমাকে ভীষণ গর্বিত করেছে।
এ ছাড়া সাংস্কৃতিক উৎসবে বাংলাদেশ ছাড়াও তুরস্ক, বসনিয়া, আলবেনিয়া, আজারবাইজান, কাজাখস্তান, তাজিকিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন, চীন, ফিলিস্তিন, দক্ষিণ কোরিয়া, লেবানন, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মিসর, নাইজেরিয়া, আইভরিকোস্ট, সেনেগাল ও সুদানের শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ দেশের কৃষ্টি-কালচার, ইতিহাস-ঐতিহ্য, খাবার-দাবার, পোশাকপরিচ্ছদের এক ব্যতিক্রমধর্মী আয়োজন নিয়ে চিত্তাকর্ষক মেলায় অংশগ্রহণ করেন।
তাবরিয শহরের প্রাণকেন্দ্র এল গোলিকে কেন্দ্র করে তিন দিনব্যাপী এই সাংস্কৃতিক উৎসবের আয়োজন করা হয়। এল গোলি হচ্ছে কৃত্রিম একটি লেক। যেখানে পুরো গ্রীষ্মকাল থই থই পানিতে সমুদ্রের ঢেউয়ের দোলা দেওয়া হয়। লোকজন ছোট ছোট ডিঙি নৌকায় চড়ে ঘুরে বেড়ান। লেকটির চারদিকে সবুজের সমাহার, রাতদিন ২৪ ঘণ্টা লোকজন এখানে বাচ্চাদের নিয়ে আনন্দ-উৎসবে মেতে ওঠেন। লেকটির একেবারে মাঝখানে একটি রেস্টুরেন্ট রয়েছে। তাবরিযের সব আন্তর্জাতিক উৎসব ও সেমিনার এখানে আয়োজন করা হয়। শীত ঋতুতে এই লেকটির ওপর দিয়ে গাড়ি চলাচল করে, কেননা এটি জমাট বাঁধা বরফে পরিণত হয়।
বরাবরের মতো এবার বাংলাদেশ স্টলে দুধ–চা না পেয়ে প্রায় সকল বিদেশি বন্ধু হতাশ হয়েছেন। এবার পাশাপাশি তিনটি আন্তর্জাতিক উৎসব একসঙ্গে অনুষ্ঠিত হওয়ায় সবাইকে বঞ্চিত করতে হয়। তাই এবার শুধুমাত্র ম্যাঙ্গোবার, ম্যাঙ্গোচকলেট ও চানাচুর দিয়ে আমন্ত্রিত অতিথিদের আপ্যায়ন করাতে হয়েছে। তেহরান থেকে ৩৩১ কিলোমিটার দূরে ইসফাহান নগরীতে ৩০তম আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ফর দ্য চিলড্রেন অ্যান্ড ইয়ুথ উৎসবে দুই দিন অবস্থান করি। অতঃপর সেখান থেকে প্রায় ৯৩১ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে তাবরিযের এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করি। তাবরিযের এই সাংস্কৃতিক মেলায় এবার সঙ্গ দিয়েছেন বাংলাদেশি মাসুম ও তাঁর তুর্কি-ইরানি বধূ মারিয়াম। পুরো স্টল সাজানোসহ পুরো তিন দিন তারাই মূলত বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য, কৃষ্টি-কালচার তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তাবরিযবাসীর কাছে বাংলাদেশের রয়াল বেঙ্গল টাইগার ছিল অপার বিস্ময়ের! বেশির ভাগ দর্শনার্থী রয়াল বেঙ্গল টাইগারের সঙ্গে ছবি তোলায় ব্যস্ত ছিলেন।
এই শহরের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র হচ্ছে কান্দুভান গ্রাম। ছোট ছোট পাহাড়ের মধ্যে ঘরগুলো রয়েছে। এই গ্রামের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে একটি ঘরের ছাদ অন্য ঘরের উঠোন। এভাবে প্রায় ৭০টি ঘরে মানুষ এখানে বসবাস করছেন। জনশ্রুতি রয়েছে উত্তর আমেরিকা ও তুরস্কে এ রকম একটি গ্রাম রয়েছে, তবে সেগুলো পরিত্যক্ত। একমাত্র ইরানের কান্দুভান গ্রামটিই সগৌরবে জীবন্ত ইতিহাস হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
এ ছাড়া এখানে রয়েছে ফারসি সাহিত্যের সমকালীন কবি শাহরিয়ারসহ ষষ্ঠ হিজরির কবি খাকানি, জহির ফারইয়াবিসহ অসংখ্য কবি-সাহিত্যিকের সমাধি। এখানকার চামড়া শিল্প ও কার্পেট গোটা ইরানে বিখ্যাত। ইরানের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন শহর হিসেবে এর রয়েছে ব্যাপক খ্যাতি। জরুরি কাজ থাকায় আবারও ইসফাহানে চলে আসার পরে মাসুম ও মারিয়াম প্রাণপণ চেষ্টা করেছে বাংলাদেশ সম্পর্কে দর্শনার্থীদের কৌতূহল মেটাতে। এভাবেই ইরানে শেষ হলো আমার সর্বশেষ আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক উৎসবে অংশগ্রহণ। ইরানের বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সেলর এ টি এম মোনেমুল হক তাঁর তোলা অসাধারণ দুটি ছবি ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ায় আন্তরিক ধন্যবাদ। এ ছাড়া বিশেষ কৃতজ্ঞতা ইরানের বাংলাদেশ দূতাবাসকে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে পিএইচডি গবেষক, তারবিয়্যাত মোদাররেস বিশ্ববিদ্যালয়, তেহরান, ইরান।