03/13/2025 নেত্রকোনায় পুকুরে পুকুরে মিলছে সর্বগ্রাসী সাকার মাছ, আতংকে মাছ চাষিরা
odhikarpatra
১২ মার্চ ২০২৫ ১৬:৪৮
হাওর, বাওর, খাল, বিল আর নদীর সংমিশ্রণে মিঠা পানির মাছের বিশাল আশ্রয়স্থল এই জেলা। সম্প্রতি জেলার বিভিন্ন নদী, জলাশয় ও পুকুরে মিলছে সর্বগ্রাসী সাকার মাছ। উদ্ভট রং আর আকৃতির এ মাছ দেখতে উৎসুক জনতা আগ্রহ দেখালেও চিন্তিত স্থানীয় মাছ চাষিরা। জেলার ভিন্ন ভিন্ন স্থানে স্থানীয় মাছ চাষিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সম্প্রতি এ জেলায় আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে সাকার মাছের বৃদ্ধি। ঠিক কোথা থেকে কিভাবে এ মাছ এ জেলায় আসলো তা জানা নেই কারো।
মাছ চাষিরা জানান, এসব মাছ তাদের পুকুরে আসার পর থেকে বিভিন্ন দেশীয় ছোট ছোট মাছের বংশ বৃদ্ধি একেবারেই কমে গিয়েছে এবং অনেক মাছ ইতিমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
জেলার সদর উপজেলার উলুয়াটি গ্রামের মাছ চাষি ও তরুণ কৃষক আরিফুর রহমান জানান, তাদের পুকুরে এ মাছের পরিমাণ দিনদিন বেড়েই চলেছে। কয়েকদিন পরপর জাল দিয়ে এ মাছ তুলে মেরে ফেললেও এর পরিমাণ কমছে না। এদিকে সাকার মাছের বিচরণের কারণে দেশীয় চিংড়ি,পুঁটি,বাইলা মাছসহ অনেক ছোট ছোট মাছ হারিয়ে যাচ্ছে পুকুর থেকে।
জানা যায়, সাকার মাছ একটি সর্বগ্রাসী মাছ। এই মাছটি একবার কোনো জলাশয়ে ঢুকে পড়লে এর বিস্তার রোধ করা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। চাষের পুকুরে এই মাছ ঢুকে পড়লে অন্য মাছের সাথে খাবার ও বাসস্থান নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু করে। এতে করে বাইরে থেকে পর্যাপ্ত খাবার দেওয়া জলেও প্রত্যাশা অনুযায়ী মাছের উৎপাদন পাওয়া যায় না।
এ মাছ জলজ পোকামাকড় ও শেওলার পাশাপাশি ছোট মাছ এবং মাছের পোনা খেয়ে থাকে। পাখনা খুব ধারালো হওয়ায় এ মাছের সাথে লড়াই করার সময় ধারালো পাখনার আঘাতে সহজেই অন্য মাছের দেহ ক্ষত-বিক্ষত হয় এবং পরবর্তীতে পচন ধরে সেগুলো মারা যায়। এ মাছ রাক্ষুসে প্রজাতির না হলেও প্রচুর পরিমাণে খাবার ভক্ষণ করে। এতে খাদ্যের যোগান নিয়ে তীব্র প্রতিযোগিতা তৈরি হয় অন্য মাছের সাথে। বেশিরভাগ সময়ই দেশীয় প্রজাতির মাছ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পেরে জলাশয় থেকে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। জেলায় সাকার মাছ এমন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় মাছ চাষিরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহজাহান কবীর বাসসকে বলেন, ‘সম্প্রতি জেলায় বিভিন্ন স্থানে এ মাছের দেখা মিলেছে এবং তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। এ মাছ অনেক প্রতিকূল পরিবেশেও টিকে থাকতে পারে। এ মাছ জেলার হাওর ও নদীতে ছড়িয়ে গেলে তা এ অঞ্চলের মাছের বংশবৃদ্ধিতে এবং প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশে বিরূপ প্রভাব ফেলবে।’
তিনি আরো জানান, এ মাছের উপদ্রব থেকে দেশীয় মাছের বংশবৃদ্ধি রক্ষায় দেখামাত্রই এ মাছ মেরে ফেলতে হবে। বা কেটে তা মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে।
এ মাছের পুরো নাম ‘সাকার মাউথ ক্যাটফিশ’। অনেকে ‘সাকার ফিশ’ নামে চেনে। বৈজ্ঞানিক নাম ‘হিপোসটোমাস প্লেকোসটোমাস’। নেত্রকোনায় স্থানীয়রা একে ‘টাইগার ফিশ’ নামেও চেনেন।
ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াটিক স্টাডিজের তথ্য অনুযায়ী, এ মাছ মূলত দক্ষিণ আমেরিকার মাছের একটি প্রজাতি যা এখন দক্ষিণ এশিয়ার জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের পাশ্ববর্তী দেশ ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের জলাধার ও নদীতে সাকার মাছের আধিক্য বেড়েছে। এ ছাড়া এটি উত্তর আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জেও ছড়িয়ে পড়ছে।
এ পর্যন্ত এ মাছের দুটি ধরণ পাওয়া গেছে। একটির রং সাদা ও ছোপ ছোপ দাগ। অপরটি কালো এবং তার উপর সাদা ডোরাকাটা দাগ। বর্তমানে বাংলাদেশের নদ-নদীতে দ্বিতীয়টি ব্যাপকভাবে পাওয়া যাচ্ছে। এটি সাধারণ একুরিয়ামের জন্য আদর্শ মাছ। একুরিয়াম এর ময়লা খেয়ে বেঁচে থাকে। এই মাছ ময়লাসহ অন্যান্য মাছের খাদ্য খেয়ে থাকে এবং দ্রুত বংশবিস্তার করে থাকে। তাই যে জায়গায় এই মাছ বেশি পরিমাণে থাকে সেই জায়গায় অন্যান্য মাছ কম থাকে। বর্তমানে বুড়িগঙ্গা নদীসহ প্রায় জলাশয়েই মাছটি উল্লেখযোগ্য আকারে দেখা যায়।
মৎস্য বিশেষজ্ঞদের মতে, সাকার ফিস উন্মুক্ত জলাশয়ে ছড়িয়ে পড়ায় দেশীয় অনেক প্রজাতির মাছ খেয়ে শেষ করে দিচ্ছে। এটি চিংড়ি, কালি বাউশ, মাগুর ও শিং মাছসহ ছোট শামুক জাতীয় শক্ত খোলের প্রাণী খেয়ে সাবাড় করে ফেলে।
এ মাছ দেশের জন্য ক্ষতিকর বলে দীর্ঘদিন ধরে প্রচার চালিয়ে আসছে মৎস্য অধিদপ্তর। তাদের এক প্রচারপত্রে বলা হয়েছে, সাকার ফিশ আশির দশকে ব্রাজিল থেকে অননুমোদিতভাবে বাহারি মাছ হিসেবে প্রথম বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়।
অ্যাকুয়ারিয়ামের কাঁচে যে শ্যাওলা জমে, তা খেয়ে পরিষ্কার রাখে সাকার ফিশ। এ কারণে অ্যাকুয়ারিয়ামে এই মাছ রাখা হয়। ধারণা করা হয়, বিদেশ থেকে আনা এই মাছ কোনোভাবে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক জলাশয়ে ছড়িয়ে পড়েছে।
সাকার ফিশ নদী-নালা, খাল-বিল ও পুকুরে চাষ করা মাছের সঙ্গে ব্যাপকভাবে ধরা পড়ছে, যা জীববৈচিত্য তথা দেশীয় প্রজাতির মাছের অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। ২০২৩ সালে সরকার সাকার ফিশের আমদানি, প্রজনন, চাষ, পরিবহন, বিক্রি, গ্রহণ বা প্রদান, বাজারজাতকরণ ও সংরক্ষণ নিষিদ্ধ করে।
মৎস্য অধিদপ্তরের এই প্রচারপত্রে বলা হয়, দ্রুত বংশবৃদ্ধির কারণে দেশীয় প্রজাতির মাছের সঙ্গে খাদ্য ও বাসস্থান নিয়ে প্রতিযোগিতা করে এই মাছ। দেশীয় প্রজাতির মাছের ডিম ও রেণু খেয়ে বংশবিস্তারে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে, সর্বোপরি জলজ জীববৈচিত্র্য নষ্ট করে এ মাছটি।
দেশীয় প্রজাতি ছোট মাছসহ জলজ পোকামাকড়, শেওলা, ছোট শামুকজাতীয় প্রাণী খেয়ে সাকার ফিশ পরিবেশের সহনশীল খাদ্যশৃঙ্খল নষ্ট করে। জলাশয় পাড়ের ক্ষেত্রবিশেষ পাঁচ ফুট পর্যন্ত গর্ত করে পাড়ের ক্ষতি করে এবং জলাশয়ের উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা কমায়।
এ মাছ স্বল্পমাত্রায় অক্সিজেনযুক্ত পানিতে, এমনকি নোংরা দূষিত পানিতেও বেঁচে থাকতে ও দ্রুত বংশ বিস্তার করতে পারে। এ মাছের প্রজননকাল মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর মাস, স্ত্রী মাছ ৫০০-৩০০০ টি ডিম পাড়ে।
মৎস্য অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়, এ মাছটি যেখানে যে অবস্থায় পাওয়া যাবে সাথে সাথে বিনষ্ট করতে হবে, যেমনঃ মাটিতে পুঁতে ফেলা যেতে পারে। পুকুর, দীঘি বা চাষকৃত জলাশয় সম্পূর্ণ শুকিয়ে বা সেঁচের মাধ্যমে এ মাছ সম্পূর্ণ বিনষ্ট করতে হবে। পুকুর বা উন্মুক্ত জলাশয়ে প্রবেশ রোধের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে।
এ্যাকুরিয়ামের মাছ হিসেবে বাজারজাতকরণের নিমিত্তে হ্যাচারিতে প্রজনন বা লালন পালন বন্ধ করতে হবে।