09/06/2025 মাতামুহুরীর কাছে শেখা জীবনদর্শন: হোক সবার পথচলা - প্রফেসর ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমানের সাথে একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার
odhikarpatra
৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৮:৫৯
অধিকারপত্র বিশেষ আয়োজন- সাক্ষা’কার নিয়েছেন অধিকারপত্রের বিশেষ প্রতিবেদক
অধিকারপত্রের প্রশ্ন: আলীকদম ও মাতামুহুরী নদীর সঙ্গে আপনার জীবনের সম্পর্ক আসলে কোথা থেকে শুরু?
ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান: ১৯৯৮ সালে ছাত্রাবস্থায় প্রথমবার আলীকদমে প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে কাজ করতে যাই। তখনই মাতামুহুরী নদীর ধারে দাঁড়িয়ে মনে হলো, জীবন মানেই শুধু ব্যক্তিগত অর্জন নয়—মানুষের জন্য কিছু করা। মাতামুহুরী এ দেশের একমাত্র নদী যার উৎপত্তি ও সমাপ্তি দুই-ই বাংলাদেশে। সেই মুহূর্তে মনে প্রতিজ্ঞা করি, আমার জন্ম, কর্ম আর মৃত্যু—সবই এই দেশে হবে। বিদেশে গিয়েও সেই টান আমাকে বারবার ফিরিয়ে এনেছে।
অধিকারপত্রের প্রশ্ন: অথচ আপনি তো নিউজিল্যান্ডে দীর্ঘ সময় পড়াশোনা করেছেন। তখন কি স্থায়ী হওয়ার সুযোগ ছিল না?
ড. রহমান: ছিল, বরং অনেকে আমাকে উৎসাহ দিয়েছে। স্কলারশিপে পড়াশোনা করেছিলাম, তিনটি ডিগ্রি অর্জন করেছি, খণ্ডকালীন কাজ করেছি, নিউজিল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া ইনক্লুসিভ এডুকেশন সামিটের অর্গানাইজিং কমিটিতে ছিলাম, এমনকি New Zealand Journal of Performing Arts-এর ম্যানেজিং এডিটরও ছিলাম। কিন্তু যখন পিআরের আবেদন করতে বলল, আমার ভেতর থেকে মাতামুহুরীর কাদা-মাটির টান আমায় থামিয়ে দিল। আমি উত্তর দিলাম—আমি বিদেশে অভিবাসী হতে পারি না, আমি হতে চাই মাতামুহুরী।
অধিকারপত্রের প্রশ্ন: পরিবার কি এ সিদ্ধান্তে দ্বিধাগ্রস্ত হয়নি?
ড. রহমান: অবশ্যই হয়েছে। আমার স্ত্রী তখন বলেছিলেন—“শিশুদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ করতে হলে বিদেশে থাকাটাই ভালো।” কিন্তু আমি বলেছি, যদি আমি অজপাড়াগাঁ থেকে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জায়গা করে নিতে পারি, আমার সন্তানরাও পারবে। আমি বিশ্বাস করি দেশের ভেতরেই সর্বোচ্চ অর্জন সম্ভব।
অধিকারপত্রের প্রশ্ন: বিশেষ শিক্ষা বিভাগে আপনার অবদান অনেক। কীভাবে এই যাত্রা শুরু হলো?
ড. রহমান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিশেষ শিক্ষা বিভাগ শুরু থেকেই আমার কর্মক্ষেত্র। প্রভাষক হিসেবে যোগদানের আগেই শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য বাংলা সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ উন্নয়ন দলের সঙ্গে কাজ করেছি। পরে ২০১৪ সালে প্রথমবার অটিজম নিয়ে জাতীয় সম্মেলনের আয়োজন করি নিউজিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায়। সেই অভিজ্ঞতা আমাকে অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার বৃহত্তর এজেন্ডায় কাজ করতে অনুপ্রাণিত করে।
অধিকারপত্রের প্রশ্ন: বিভাগীয় চেয়ারম্যান হিসেবে আপনার সময়টা কেমন ছিল?
ড. রহমান: ২০১৭–২০২০ সময়কাল ছিল পরিবর্তনের অধ্যায়। গবেষণা, প্রশিক্ষণ, নীতি-আলোচনা—সব জায়গাতেই বিশেষ শিক্ষা বিভাগকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। একটি সরকারি তথ্যচিত্র নির্মাণ করি, যা আজও বিভিন্ন জায়গায় প্রদর্শিত হয়। জাতীয় পর্যায়ে প্রতিবন্ধী কোটার প্রশ্নে আলোচনায় নেতৃত্ব দিয়েছি।
অধিকারপত্রের প্রশ্ন: আপনার উদ্যোগে শুরু হওয়া Advanced Course on Disability, Autism and Inclusive Education অনেক আলোচনায় এসেছে।
ড. রহমান: এটি আসলে আমার গর্বের কাজ। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে শিক্ষক, ডাক্তার, অভিভাবক—সবাইকে একত্র করে অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার একটি পূর্ণাঙ্গ কোর্স তৈরি হয়। ২০১৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সভায় এটিকে সাফল্যের দৃষ্টান্ত হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
অধিকারপত্রের প্রশ্ন: প্রতিবন্ধিতা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা বিষয়ে আপনার কাজ জাতীয় নীতিনির্ধারণে কীভাবে প্রভাব ফেলেছে?
ড. রহমান: ন্যাশনাল একাডেমি ফর অটিজম অ্যান্ড নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅ্যাবিলিটিজ (NAAND)-এর বিশেষজ্ঞ সদস্য হিসেবে প্রশিক্ষণ ডিজাইন, ম্যানুয়াল তৈরি, মাস্টার ট্রেইনার কোর্স—এসব কাজ করেছি। আমার সম্পাদিত প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল দিয়ে এখন পর্যন্ত হাজার হাজার শিক্ষক ও অভিভাবক প্রশিক্ষিত হয়েছেন। সংসদে প্রতিবন্ধী কোটার নীতি আলোচনায়ও সরাসরি প্রভাব ফেলতে পেরেছ
অধিকারপত্রের প্রশ্ন: এত কাজের মাঝেও ঢাবিতে বিশেষ শিশুদের জন্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেছেন।
ড. রহমান: হ্যাঁ, এ আমার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন। উপাচার্যের সমর্থনে এখন “School for Children Living with Autism Spectrum Disorder and Resource Centre” প্রতিষ্ঠার কাজ এগোচ্ছে। এটি কার্যকর হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই হবে দেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে অটিজম শিশুদের জন্য আলাদা স্কুল ও রিসোর্স সেন্টার থাকবে।
অধিকারপত্রের প্রশ্ন: দেশে ফিরে আপনার গুরুত্বপূর্ণ অবদান বা কাজগুলোর মধ্যে যদি কয়েকটি উল্লেখ করতেন?
ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান: অসংখ্য কাজ আছে—এগুলো আসলে আমার সন্তানের মতো, প্রতিটিই একেকটা ব্রেইনচাইল্ড। কোনটা রেখে কোনটা বলব, সেটাই কঠিন।
অধিকারপত্রের প্রশ্ন: তবুও সার্বিকভাবে কিছু প্রধান অবদান যদি বলেন?
ড. রহমান: ঠিক আছে, কয়েকটা তুলে ধরছি।
সার্বিকভাবে একনজরে আমার বিশেষ অবদান:
অধিকারপত্রের প্রশ্ন: শেষ অধিকারপত্রের প্রশ্ন—আপনার জীবনদর্শনকে যদি এক বাক্যে বলতে হয়?
ড. রহমান: মাতামুহুরী নদীর মতো আমিও চাই জন্ম থেকে মৃত্যু—সবই এই দেশের ভেতর দিয়ে বয়ে যাক। জ্ঞান, ভালোবাসা আর দায়বদ্ধতা দিয়েই এ দেশকে ফেরত দিতে চাই
ড. রহমান: “আমার প্রতিশ্রুতি খুব স্পষ্ট—এই দেশকে ফিরিয়ে দেওয়া। আমি এসেছি একটি দরিদ্র পরিবার থেকে; আজ যা কিছু অর্জন করেছি, তা দেশেরই অবদান। তাই আমার দায়িত্ব জ্ঞান দিয়ে এই দেশকে সমৃদ্ধ করা।
বিদেশে অনেক সুযোগ ছিল—নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া কিংবা যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী হওয়ার প্রলোভন। কিন্তু আমি কখনো আবেদন করিনি। কারণ আমি বিশ্বাস করি, আমার দেশকেই সবচেয়ে বেশি দরকার আমার মতো মানুষদের। উন্নয়নশীল দেশে হাজার হাজার পিএইচডি তৈরি হয়, তারা নিজেদের রাষ্ট্রের উন্নয়নে নিয়োজিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো সেই সংখ্যা অতি সামান্য। অথচ শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার, সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবসম্পদ উন্নয়ন—সব ক্ষেত্রেই জরুরি ভিত্তিতে এমন মানুষ প্রয়োজন।
আমি মনে করি, নিজের জীবন, অর্জন আর শ্রমকে মাতামুহুরীর মতো এই দেশেই প্রবাহিত করতে হবে। বিদেশে গড়ে ওঠা জ্ঞানকে ফিরিয়ে এনে বাংলাদেশের শিক্ষা ও সমাজ ব্যবস্থার সংস্কারই আমার মূল দর্শন।”
অধিকারপত্রের প্রশ্ন: শেষ অধিকারপত্রের প্রশ্ন—মাতামুহুরীর শিক্ষা কিভাবে সকলকে অনুপ্রাণিত করতে পারে?
ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান: মাতামুহুরী আমাকে শিখিয়েছে—জীবন মানেই গন্তব্যে পৌঁছানো নয়, বরং নিজের মাটি, সমাজ ও মানুষের জন্য নিরন্তর প্রবাহিত হওয়া। এ নদী যেমন জন্ম থেকে মৃত্যু—সবটুকু পথ এ দেশেই অতিক্রম করে, আমিও চাই আমার জীবনধারা যেন দেশেই বয়ে চলে।
যে শিক্ষা আমি নিয়েছি, তা হলো—আপনার জ্ঞান, অর্জন, অভিজ্ঞতা বিদেশে জমা রেখে নয়, দেশের মানুষকে সমৃদ্ধ করতেই ব্যয় করতে হবে। যদি আমি অজপাড়াগাঁ থেকে উঠে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারি, তবে বাংলাদেশের প্রতিটি তরুণ-তরুণীও তাদের সীমিত সুযোগের মধ্যেই বড় স্বপ্ন দেখতে এবং তা পূরণ করতে পারে। মাতামুহুরী আমাদের শিখিয়ে দেয়—নিজ মাটিকে ছেড়ে নয়, মাটির সঙ্গেই একাত্ম হয়ে এগিয়ে যাওয়াই সত্যিকারের সাফল্য।
অধিকারপত্র সমাপ্তির বিশ্লেষণ: আমার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগই প্রমাণবিহীন, মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমার পেশাগত জীবন সর্বদা সততা, শৃঙ্খলা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন-নীতির প্রতি অনুগত থেকে পরিচালিত হয়েছে। শিক্ষার্থী, সহকর্মী ও প্রতিষ্ঠানের কল্যাণে আমার অবদান সুপ্রতিষ্ঠিত; একাডেমিক ক্ষেত্রে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে। সুতরাং তদন্ত কমিটির নিকট আমার ন্যায়সংগত প্রত্যাশা—উক্ত অভিযোগসমূহকে মিথ্যা, প্রমাণবিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিবেচনা করে আমাকে অবিলম্বে পূর্ণ ও নিঃশর্ত অব্যাহতি প্রদান করা হোক। অতএব, বিশদ ব্যাখ্যা ও সংযুক্তিসমূহ গভীরভাবে পর্যালোচনা করে, তদন্ত কমিটি সমীপে বিনীত অনুরোধ—আমাকে অধ্যাপক হিসেবে দেশ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং আমার একাডেমিক ক্ষেত্রের উন্নয়নে অবদান রাখার সুযোগ প্রদান করা হোক।
অধিকারপত্রের প্রশ্ন: আর কিছু কি বলবেন? ড. রহমান: আলীকদমের মাতামুহুরী নদী শুধু একটি প্রাকৃতিক স্রোত নয়, ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমানের জীবনদর্শনের প্রতীক। দেশকে ভালোবেসে বিদেশি স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে ফেরা এই মানুষটি আজ বাংলাদেশের বিশেষ শিক্ষা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার অন্যতম চালিকাশক্তি।
~মাতামুহুরীর শিক্ষা আমার দেশেই ফেরার অঙ্গীকারকে দৃঢ় করে। আসলে বিদেশ নয়, মাতৃভূমিই হোক আমাদের সবার শেষ আশ্রয়” - ড. মাহবুবুর রহমান