09/08/2025 অতীশ দীপঙ্কর: এক রাজপুত্র, এক সাধক, এক আলোকবর্তিকা
odhikarpatra
৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ২৩:০৯
ধর্ম ও ইতিহাস | বিশেষ ফিচার |
বাংলার ইতিহাসে এমন কিছু নাম আছে, যাদের আলো কেবল এক সময়কালকে আলোকিত করেনি—বরং ছড়িয়ে পড়েছে শতাব্দী পেরিয়ে, ভূগোল অতিক্রম করে, এক মহাজাগতিক মানবতাবোধে। অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান সেই বিরল ব্যক্তিত্বদের একজন। তিনি জন্মেছিলেন রাজপুত্র হিসেবে, কিন্তু তাঁর যাত্রা শেষ হয়েছিল এক মহাসাধক, শিক্ষক ও মানবিক বিপ্লবের পথপ্রদর্শক হিসেবে। জন্ম বিক্রমপুরে, যাত্রা বোধিগয়ার স্তূপ প্রদক্ষিণ থেকে শুরু করে সুদূর তিব্বতের সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ পর্যন্ত।
এই পর্বে আমরা অন্বেষণ করবো—কীভাবে চন্দ্রগর্ভ নামের এক রাজপুত্র হয়ে উঠলেন অতীশ দীপঙ্কর, কেন তাঁর দর্শন আজও প্রাসঙ্গিক, এবং কোন বুদ্ধিচিন্তার মাটিতে দাঁড়িয়ে তিনি গড়ে তুললেন এক বিশ্বজনীন শিক্ষাধারা, যা আজও আলো ছড়ায় তিব্বতের পাহাড় থেকে নিউ ইয়র্কের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত। তাঁর জীবন দর্শনে প্রতিফলিত হয় তাঁর অমোঘ বাণী দিয়ে, “রাজ্য নয়, করুণা; ভোগ নয়, জ্ঞান” — এই ছিল তাঁর পাথেয়। আর এই পথেই তিনি হয়ে উঠলেন ইতিহাসের দীপ্ত এক আলোকবর্তিকা।
প্রাচীন বাংলায় জ্ঞান, বিজ্ঞান ও সভ্যতার উর্বরতম ভূমি ছিল বিক্রমপুর। এই পবিত্র ভূমি জন্ম দিয়েছে অসংখ্য গুণীজন, মনীষী, সমাজসংস্কারক ও বিদ্বান পণ্ডিতের। গৌরবময় সেই ইতিহাসে বহু নাম থাকলেও—কয়েকটি নাম শুধু পরিচিত নয়, সময়কেও অতিক্রম করে স্থায়ী আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে জ্ঞানের ইতিহাসে। তাদের মধ্যেই অন্যতম হলেন অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান—বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজন, যিনি কেবল বিক্রমপুরের নয়, পুরো বিশ্বের আধ্যাত্মিক ও মনোবৈজ্ঞানিক জগতে রেখে গেছেন অমোঘ ছাপ। আজও তাঁর জন্মস্থান, বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামের আবালবৃদ্ধরা তাঁর পৈতৃক ভিটাকে শ্রদ্ধায় বলেন—"মহাপণ্ডিতের ভিটা"। এই সম্মান কেবল ঐতিহাসিক নয়, এটি এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে বয়ে চলা স্মৃতি ও শ্রদ্ধার বহমান উত্তরাধিকার।
তিব্বতে গিয়ে অতীশ যা করলেন, তা ছিল এক মৌলিক সংস্কার। তিনি রচনা করলেন কালজয়ী গ্রন্থ—"বোধিপথপ্রদীপ" (Bodhipathapradipa)। সহজ ভাষায় লেখা এই পুঁথিতে তিনি বোঝালেন কিভাবে ধাপে ধাপে সাধনার মাধ্যমে আলোকপ্রাপ্তি সম্ভব। এই রচনায় উঠে আসে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়: নৈতিকতা (শীল), প্রজ্ঞা (পৃথিবী ও আত্মার বাস্তব রূপ চিনে নেওয়া), েএবং করুণা ও বোধিচিত্তের অনুশীলন। এই সময়েই তিনি গড়ে তুলেন লোজোং বা মনের প্রশিক্ষণ পদ্ধতি—যার ৫৯টি প্রজ্ঞাবাণী এবং সাতটি ধাপে আত্মশুদ্ধির পথ বিশ্বের সামনে তুলে ধরা হয়। এটি শুধু আধ্যাত্মিক নয়, বরং এক ধরণের মানসিক চিকিৎসাও, যা আজকের যুগেও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য প্রাসঙ্গিক।
অতীশ তিব্বতে কাটান ১৭টি বছর। তাঁর প্রিয় শিষ্য দ্রোম্তোন্পা তাঁর শিক্ষা ধরে রাখেন। এই শিক্ষার ধারাই পরে নতুন প্রাণ পায় জে সোঁখাপা-র মাধ্যমে, যিনি গড়ে তোলেন গেলুগ বা “ইয়েলো হ্যাট” ঘরানা—আজকের দালাই লামা যার ধারক। বিশ্বের নানা প্রান্তে—ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া—আজো অতীশ দীপঙ্করের শিক্ষায় মানুষ অনুপ্রাণিত হয়। তাঁর শিক্ষা শুধু তিব্বত নয়, গোটা বিশ্বের বৌদ্ধ মননে এক উজ্জ্বল মাইলফলক।
এই সময়টা যেন ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছে। মানুষ যত এগোচ্ছে প্রযুক্তিতে, তত পিছিয়ে পড়ছে সম্পর্ক আর সংযোগে। ধর্মের নামে ঘৃণা, রাজনীতির নামে বিভাজন, উন্নয়নের নামে আত্মকেন্দ্রিকতা—সব মিলিয়ে আজকের পৃথিবী এক গভীর মানসিক সংকটে। এই পরিস্থিতিতে, হঠাৎ করে মনে পড়ে যায় এক প্রাচীন সাধকের কথা—অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। তাঁর নামটা উচ্চারণ করলেই যেন মনে হয়, কেউ একটা শান্ত অথচ দৃঢ় হাতে আমাদের থামিয়ে বলছে—“রাগ নয়, বোঝো; লড়াই নয়, ভালোবাসো।”
অতীশ তাঁর জীবনে যা করেছিলেন, সেটি ছিল কেবল ধর্মচর্চা নয়—মানবিকতা প্রতিষ্ঠার এক নিরব বিপ্লব। তিনি বিশ্বাস করতেন, শক্তি আসে ভেতর থেকে; আর সেই শক্তির উৎস অহং নয়, বিনয়। তিনি দেখিয়েছিলেন, সত্যিকার নেতৃত্ব কিভাবে ক্ষমতার প্রদর্শন থেকে নয়, আসে আত্মনিয়ন্ত্রণ আর নৈতিক স্পষ্টতা থেকে। একটি সমাজের প্রকৃত উন্নয়ন তখনই সম্ভব, যখন মানুষ প্রতিযোগিতার বদলে সহানুভূতির শক্তিকে মূল্য দেয়, এবং ধর্মের মোড়কে নয়, মানবিকতার ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়ে তোলে।
এই সময় যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে নৈতিকতা হারাতে বসেছে, কর্পোরেট দুনিয়ায় আত্মোন্নয়ন মানে কেবল কর্মদক্ষতা বাড়ানো, তখন অতীশের জীবন ও দর্শন এক বিপরীত স্রোতের মতো জেগে ওঠে। তাঁর দর্শন শেখায়—উন্নয়ন মানে কেবল বাহ্যিক সফলতা নয়, বরং অন্তর্জগতে আলো জ্বালানো।
তাই হয়তো এখন, এই বিভ্রান্ত সময়েই, আমাদের আবার ফিরে দেখা দরকার অতীশ দীপঙ্করকে। তাঁর জীবন শুধুই অতীত নয়, তাঁর শিক্ষা হতে পারে ভবিষ্যতের জন্য পথরেখা। প্রয়োজন শুধু—তাঁকে নতুন করে আবিষ্কার করার।