09/16/2025 কালো কোটে সাদা বৈষম্য: ভারতের বিচারব্যবস্থায় লিঙ্গবৈষম্য, সুপ্রিম কোর্টে নারীর পথরুদ্ধ যাত্রা
odhikarpatra
১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৯:০৬
ভারতের আদালতপাড়ায় কালো কোটে ভিড় জমে প্রতিদিন। সেখানে বিচারক, আইনজীবী, কর্মচারী সবাই ব্যস্ত আইনের স্রোতে। কিন্তু এই ভিড়ে নারীর কণ্ঠ যেন প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টে একসময় চারজন নারী বিচারপতির উপস্থিতি যে আশার আলো জ্বালিয়েছিল, তা এখন নিভে এসেছে। একমাত্র বিচারপতি বি ভি নাগরথ্না লড়াই করছেন একা। প্রশ্ন জাগছে যে দেশে অর্ধেক মানুষ নারী, সেখানে বিচারবিভাগের সর্বোচ্চ আসনে তাঁদের জায়গা এতটাই সঙ্কুচিত কেন?
২০২১ সালের কথা। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য ধরা পড়েছিল একটি ছবিতে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এন ভি রামানার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন চার নারী বিচারপতি। ছবিটি মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল। অনেকে ভেবেছিলেন, এবার হয়তো শীর্ষ আদালতে নারীর অংশগ্রহণ নতুন মাত্রা পাবে। কিন্তু মাত্র চার বছরের মাথায় সেই আশার আলো নিভে এসেছে। তখনকার চার নারীর মধ্যে তিনজনই অবসরে গেছেন। এখন সুপ্রিম কোর্টে আছেন একমাত্র নারী বিচারপতি বি ভি নাগরথ্না। আইনজীবী স্নেহা কলিতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এটা একেবারেই ভয়াবহ। প্রায় শূন্য প্রতিনিধিত্ব মানে সুপ্রিম কোর্ট আবারও পুরুষ ক্লাব হয়ে গেছে।
১৯৫০ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু প্রথম নারী বিচারপতি নিয়োগ পেতে লেগেছিল প্রায় ৩৯ বছর—১৯৮৯ সালে নিয়োগ পান ফাতিমা বিবি। ৭৫ বছরে মোট ২৮৭ জন বিচারপতির মধ্যে নারী হয়েছেন মাত্র ১১ জন অর্থাৎ মাত্র ৩.৮%। সংখ্যাটা কেবল কমই নয়, বিচারব্যবস্থার বৈষম্যের প্রকট প্রতিচ্ছবি। শুধু সুপ্রিম কোর্ট নয়, উচ্চ আদালতগুলোতেও নারীর প্রতিনিধিত্ব করুণ অবস্থায় আছে। বর্তমানে ৭৭৩ জন উচ্চ আদালতের বিচারকের মধ্যে মাত্র ১০৩ জন নারী। অন্তত চারটি হাইকোর্টে একটিও নারী বিচারপতি নেই। সাম্প্রতিক সময়ে কোলেজিয়াম দুটি শূন্যপদে নতুন বিচারপতি নিয়োগ দিয়েছে কিন্তু দুজনই পুরুষ। অথচ অন্তত তিনজন সিনিয়র নারী বিচারক ছিলেন, যাঁদের উপেক্ষা করা হয়েছে। বম্বে হাইকোর্টে নতুন ১৪ জন বিচারকের মধ্যে মাত্র একজন নারী। আল্লাহাবাদ হাইকোর্টের প্রস্তাবিত ২৬ জনের তালিকায় নারী মাত্র পাঁচজন।
এ অবস্থায় সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন প্রকাশ্যে অসন্তোষ জানিয়েছে। সংস্থার সভাপতি বিকাশ সিং বলেন, নিম্ন আদালতে যেখানে নিয়োগ হয় লিখিত পরীক্ষা ও সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, সেখানে নারী বিচারক আছেন প্রায় ৪০%। কিন্তু উচ্চ আদালত ও সুপ্রিম কোর্টে সংখ্যা ১০%-এরও কম। এটা অস্বাভাবিক। নারী আইনজীবীরা বলছেন, বিষয়টি শুধু ‘নারীদের সমস্যা’নয়, বরং সমাজের প্রতিচ্ছবি। জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মাধবী দিবান বলেন, এটি শুধু নারীর সমস্যা নয়, পুরো বিচারব্যবস্থার সমস্যা। সমাজে বৈচিত্র্য যেমন দরকার, আদালতেও তেমন। সিনিয়র অ্যাডভোকেট জয়না কোঠারি মনে করেন, ভারতের মতো বহুমাত্রিক দেশে বিচারব্যবস্থায় আঞ্চলিক বৈচিত্র্যের পাশাপাশি লিঙ্গ বৈচিত্র্যও জরুরি। নারী দেশের অর্ধেক জনগণ, তাঁদের সমান প্রতিনিধিত্ব থাকা উচিত। গবেষণায় দেখা গেছে, আদালতে নারীর উপস্থিতি অন্য বিচারক ও আইনজীবীদেরও লিঙ্গবিদ্বেষী মন্তব্য থেকে বিরত রাখে। আর নারীর আলাদা জীবন অভিজ্ঞতা বিচার প্রক্রিয়াকে আরও সমৃদ্ধ করে। নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে অনেকেই কোটা বা সংরক্ষণের প্রস্তাব দিচ্ছেন। সমালোচকেরা আশঙ্কা করছেন এতে মেধার ক্ষতি হবে। কিন্তু স্নেহা কলিতা দ্বিমত পোষণ করে বলেন, নারী আইনজীবীরা দ্বিগুণ পরিশ্রম করেন, পরিবার সামলান, আবার কর্মজীবনেও কৃতিত্ব দেখান। তাঁদের মেধাকে উপেক্ষা করা বৈষম্য ছাড়া কিছু নয়। জয়না কোঠারি প্রস্তাব দিয়েছেন, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে অন্তত ৩০% নারী বিচারপতির লক্ষ্য স্থির করতে।
আজ যখন একমাত্র নারী বিচারপতি বি ভি নাগরথ্না শীর্ষ আদালতে একা দাঁড়িয়ে আছেন, তখন প্রশ্ন জাগছে কোথায় হারাল সেই চার নারীর যুগের স্বপ্ন? বিচারব্যবস্থার সিঁড়ি বেয়ে হাজারো নারী আইনজীবী প্রতিদিন লড়ছেন। কিন্তু শীর্ষ আদালতের দরজা তাঁদের জন্য প্রায় বন্ধ হয়ে আছে। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, যদি সমান সুযোগ নিশ্চিত না হয়, তবে তরুণী আইনজীবীরা ভেবে বসবেন এত কষ্ট করেও যদি শীর্ষে পৌঁছানো না যায়, তবে এত সংগ্রামের মানে কী? প্রিম কোর্টের শীর্ষ আসনে নারীর কম সংখ্যার ঘটনা কেবল বিচারব্যবস্থার নয়, পুরো সমাজের প্রতিবিম্ব। যদি আদালতের সিঁড়ি নারীদের জন্য বন্ধ থাকে, তবে অনেক প্রতিভাবান নারী আইনজীবীই শীর্ষে পৌঁছানোর স্বপ্ন ত্যাগ করতে বাধ্য হবেন। নারীর উপস্থিতি শুধু সংখ্যা নয়, এটি বিচার ব্যবস্থার বৈচিত্র্য, সংবেদনশীলতা এবং ন্যায়ের প্রতি দৃষ্টি বাড়ায়। দেশের অর্ধেক জনগণ নারী—তাঁদের অংশগ্রহণ ছাড়া পূর্ণ বিচারদীক্ষার কথা ভাবাই যায় না। এখন সময় এসেছে সুপ্রিম কোর্ট এবং উচ্চ আদালতগুলোতে নারীর উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার। না হলে বিচারব্যবস্থা এবং সমাজ উভয়ই হারাবে সমতা ও ন্যায়ের প্রতিফলন।
- বিশেষ প্রতিনিধি (Special National Correspondent) মোঃ সাইদুর রহমান (বাবু)