09/23/2025 Triangle of Water Forts | ঢাকার মুঘল প্রতিরক্ষা ইতিহাস ও সংরক্ষণের বর্তমান চ্যালেঞ্জ
odhikarpatra
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৪:১২
মুঘল আমলে বাংলার রাজধানী ঢাকা শুধু প্রশাসনিক শহরই নয়, ছিল একটি সামরিক ঘাঁটি। ১৭শ শতকের ঢাকা ছিল নদীঘেরা প্রাণবন্ত এক সুন্দর নগরী। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী ও মেঘনার জলের জটলা নগরীর চারপাশে যেন একটি প্রাকৃতিক দুর্গ তৈরি করেছিল। এই নগরীর শান্ত নীরবতায় লুকিয়ে ছিল এক ধরনের সামরিক জটিলতা। জলদস্যু, বিদেশি আগ্রাসী এবং চোরাকারবারিদের হঠাৎ হামলার আশঙ্কা। মুঘল সুবাদার ইসলাম খান এবং তাঁর উত্তরসূরিরা এই ঝুঁকিকে দৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করতে অভিনব পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। রাজধানীর চারপাশে তিনটি দুর্গ স্থাপন করা হয়, হাজীগঞ্জ, সোনাকান্দা এবং ইদ্রাকপুর। হাজীগঞ্জ ও সোনাকান্দা কেল্লা নারায়ণগঞ্জ জেলায় এবং ইদ্রাকপুর কেল্লা মুন্সিগঞ্জ জেলায় অবস্থিত। ইতিহাসবিদদের মতে, এই তিন দুর্গ সমন্বয়ই তৈরি হয়েছিল ঢাকার প্রতিরক্ষার মূল কৌশল। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী ও মেঘনার সংযোগপথ দিয়ে যাতে সহজেই রাজধানী ঢাকাকে আক্রমন করতে না পারে। সেজন্যই মুঘলরা প্রাকৃতিক নদী-প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে মিলিয়ে গড়ে তোলেন দুর্গের স্থাপত্য। এই তিন দুর্গ মিলেই তৈরি করেছিল ঢাকার সুবিশাল প্রতিরক্ষা বলয়, যা ইতিহাসে পরিচিতি পায় “Triangle of Water Forts” নামে। ত্রিভুজ জল দুর্গ বলতে বোঝায় তিনটি দুর্গের এমন অবস্থান, যেখানে তারা একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত এবং একসাথে ঢাকাকে ঘিরে একটি প্রতিরক্ষা বলয় তৈরি করা। হাজীগঞ্জ কেল্লা ছিল দক্ষিণ-পূর্ব দিকের প্রবেশপথ নিয়ন্ত্রণকারী। সোনাকান্দা কেল্লা নদী দিয়ে আসা শত্রুকে প্রতিহত করত। ইদ্রাকপুর কেল্লা পশ্চিম প্রান্তের অভ্যন্তরীণ সুরক্ষা নিশ্চিত করত। এভাবে ঢাকার প্রতিটি প্রবেশপথ এই দুর্গগুলোর আওতায় চলে আসে। মুঘলরা নদীর প্রাকৃতিক শক্তি এবং দুর্গের স্থাপত্যকে একত্রিত করে এমন একটি প্রতিরক্ষা নকশা তৈরি করেছিলেন যা সামরিক উদ্ভাবন ও স্থাপত্যের অনন্য সমন্বয়। তিনটি দুর্গ একে অপরের সাথে দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত, যেন প্রতিটি আক্রমণ প্রায়শই নদী ও প্রাচীরের ফাঁদে আটকে যায়। নদী + দুর্গ = প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা, কামান + প্রহরী = আক্রমণ প্রতিরোধের শক্তিশালী হাতিয়ার, অবস্থান নির্বাচন = ঢাকার প্রবেশপথ সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। এই কৌশল দেখায় কেবল শক্তি নয়, প্রাকৃতিক সম্পদ ও স্থাপত্যগত বুদ্ধিমত্তা দিয়ে মুঘলরা শহর রক্ষা করতেন।
মুঘল সুবাদার ইসলাম খান চিশতী ১৬০৮ সালে রাজধানী সোনারগাঁও থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করেন। এরপর থেকে শহরটি হয়ে ওঠে বঙ্গাল সুবার প্রশাসনিক ও সামরিক ঘাঁটি। ঢাকার অবস্থান ছিল অত্যন্ত কৌশলগত। পূর্বে শীতলক্ষ্যা, পশ্চিমে বুড়িগঙ্গা, উত্তরে তুরাগ এবং দক্ষিণে ধলেশ্বরী নদী। এই ভৌগোলিক অবস্থানই ছিল দুর্বলতার কারণ। নদীপথ দিয়েই জলদস্যু ও বিদেশি আক্রমণকারীরা বারবার ঢাকায় হামলার চেষ্টা চালাত। তাই মুঘল শাসকরা বুঝতে পারলেন, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে নদী-নির্ভর জল দুর্গের মাধ্যমে। হাজীগঞ্জ, সোনাকান্দা ও ইদ্রাকপুর কেল্লা মিলে গড়ে উঠেছিল একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্ক। নদীপথের প্রতিটি প্রবেশপথ নজরদারির আওতায় আসত। কামানের পাল্লা এক দুর্গ থেকে অন্য দুর্গ পর্যন্ত পৌঁছাত। শত্রু ঢাকার ভেতরে ঢুকলেও, ত্রিভুজ বলয়ের কারণে তাকে একাধিক দিক থেকে হামলার মুখে পড়তে হতো।
ত্রিভুজ জল দুর্গ ছিল একধরনের মাল্টি-লেয়ার্ড ডিফেন্স সিস্টেম। দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে এ ধরনের উদাহরণ বিরল। জল ব্যবস্থাপনা ও সামাজিক প্রভাব ত্রিভুজ জল দুর্গ শুধু প্রতিরক্ষার জন্য নয়, বরং সমাজ ও অর্থনীতির সাথেও জড়িত ছিল। স্থানীয় জনগণ দুর্গের জলাধার থেকে পানি ব্যবহার করত। নদীঘেঁষা দুর্গগুলো বাণিজ্যপথকে নিরাপদ রাখত। কৃষিকাজে ব্যবহৃত খাল ও সেচ ব্যবস্থার সাথেও দুর্গগুলোর সম্পর্ক ছিল। এভাবে প্রতিরক্ষা, অর্থনীতি ও সামাজিক জীবন একসাথে চলত। আজ এই দুর্গগুলো অনেকটাই ধ্বংসপ্রাপ্ত। হাজীগঞ্জ ও সোনাকান্দার অধিকাংশ অংশ জীর্ণ, ইদ্রাকপুর তুলনামূলকভাবে কিছুটা অটুট আছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিক সংরক্ষণ ছাড়া এগুলো আরও নষ্ট হয়ে যেতে পারে। “ত্রিভুজ জল দুর্গ শুধু ইতিহাস নয়, বরং এটি পর্যটনের বিশাল সম্ভাবনা। আন্তর্জাতিকভাবে প্রচার করলে ঢাকায় ঐতিহ্য পর্যটনের নতুন অধ্যায় শুরু হতে পারে।”ঢাকার ত্রিভুজ জল দুর্গ—হাজীগঞ্জ, সোনাকান্দা ও ইদ্রাকপুর—আজও আমাদের মনে করিয়ে দেয় মুঘল স্থাপত্য ও সামরিক কৌশলের মহিমা। প্রতিরক্ষা, জল ব্যবস্থাপনা এবং সামাজিক জীবনের এক অসাধারণ সমন্বয় ঘটেছিল এই দুর্গগুলোতে। ঢাকার ইতিহাসে এগুলো শুধু স্থাপত্য নয়, বরং এক অমূল্য ঐতিহ্য। সংরক্ষণের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এগুলো তুলে ধরতে পারলেই প্রমাণিত হবে—ঢাকার প্রতিরক্ষা ইতিহাস কেবল অতীতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্যও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
হাজীগঞ্জ কেল্লা: দক্ষিণ-পূর্ব প্রহরী-
হাজীগঞ্জ কেল্লা ছিল এক অর্থে ঢাকার ফ্রন্ট লাইন ডিফেন্স। শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে নির্মিত হাজীগঞ্জ কেল্লা ছিল ঢাকার প্রথম প্রতিরক্ষা ঘাঁটি। সুবেদার মীর জুমলা (১৬৬০–৬৩) বা শায়েস্তা খাঁর সময়ে নির্মাণ করা হয়। স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য উঁচু প্রাচীর, কামান বসানোর প্ল্যাটফর্ম এবং নদীমুখী প্রবেশপথ। দুর্গটির চারপাশে খাল কেটে জলপ্রাচীর তৈরি করা হয়েছিল। শত্রুর নৌযান নদীপথে এগোলে এখান থেকেই প্রথম গোলাবর্ষণ শুরু হতো।
সোনাকান্দা কেল্লা: নদীপথের নিয়ন্ত্রক-
শীতলক্ষ্যা নদীর মোহনা সংলগ্ন, যেখানে নদীর পানি ঢুকে দুর্গের প্রাচীরকে আরও শক্তিশালী করতো। সোনাকান্দা ছিল শুধু দুর্গ নয় বরং একটি কমান্ড সেন্টার, যেখান থেকে শীতলক্ষ্যার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ মুঘলরা নিজেদের হাতে রেখেছিল। নির্মাণ শায়েস্তা খাঁর সময় (১৭শ শতক)। হাজীগঞ্জ কেল্লার সাথে যুগপৎ প্রতিরক্ষা তৈরি করা হয়। শীতলক্ষ্যার অপর প্রান্তে অবস্থিত সোনাকান্দা কেল্লা মূলত নদী আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য তৈরি হয়। স্থাপত্য উঁচু বুরুজ, গোলাকার কামান টাওয়ার, জলাধার ও খাদ্যগুদাম। দুর্গের ভেতরে আলাদা জলাধার ছিল, যা দীর্ঘস্থায়ী অবরোধের সময় সৈন্যদের জন্য পানি সরবরাহ করত। হাজীগঞ্জ ও সোনাকান্দা মিলেই ঢাকার দক্ষিণ-পূর্ব ফ্রন্টকে অজেয় করে তুলেছিল।
ইদ্রাকপুর কেল্লা: অভ্যন্তরীণ ঢাকার ঢাল-
মুন্সীগঞ্জে অবস্থিত ইদ্রাকপুর কেল্লা ছিল ঢাকার পশ্চিম দিকের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। ধলেশ্বরী ও মেঘনা নদীর সংযোগস্থলে অবস্থিত। নির্মাণ শায়েস্তা খাঁ ১৬৬০-এর দশক। শহরের পূর্বমুখী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করতো এবং দুর্গটি জলপথ আক্রমণ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ চাবিকাঠি ছিল। স্থাপত্য:প্রাচীরঘেরা দুর্গ, নদীমুখী প্রবেশদ্বার, কামান বসানোর স্থান। দুর্গে একটি বিশেষ জলাধার তৈরি করা হয়েছিল, যা সৈন্যদের পানীয় জল সরবরাহ করত এবং একইসাথে প্রতিরক্ষার কাজেও ব্যবহৃত হতো। স্থানীয় জনগণের পানীয় জল ও সেচ ব্যবস্থায়ও এর ভূমিকা ছিল। ইদ্রাকপুর কেল্লা শুধু সামরিক দুর্গ নয়, বরং এটি স্থানীয় অর্থনীতি ও সমাজজীবনের অংশ হয়ে উঠেছিল।
হাজীগঞ্জ, সোনাকান্দা ও ইদ্রাকপুর কেল্লা শুধু ইতিহাসের দলিল নয়। এগুলো আজও দাঁড়িয়ে আছে মুঘল প্রতিরক্ষা স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন হিসেবে। নদীমুখী এই তিন দুর্গ ঢাকার অতীত গৌরবের প্রতীক এবং একই সঙ্গে পর্যটকদের জন্য এক অনন্য দর্শনীয় স্থান। প্রতিদিন দেশি-বিদেশি ভ্রমণপিপাসুরা এখানে এসে ইতিহাসের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করেন, অনুভব করেন ঢাকার শিকড়। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এসব দুর্গের দেয়ালে ক্ষয় দেখা দিয়েছে, অনেক জায়গায় ভাঙন ও অবহেলার চিহ্ন স্পষ্ট। অবৈধ দখল, পরিবেশ দূষণ ও যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো হুমকির মুখে পড়ছে। এখন প্রয়োজন সরকারের উদ্যোগে এবং স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণে সমন্বিত সংরক্ষণ কার্যক্রম চালু করা। নিয়মিত সংস্কার, পরিচর্যা ও বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে এই কেল্লাগুলোকে আগামীর প্রজন্মের জন্য টিকিয়ে রাখা। পাশাপাশি পর্যটনবান্ধব অবকাঠামো গড়ে তোলা গেলে এগুলো জাতীয় অর্থনীতিতেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। রাজধানী ঢাকার অতি নিকটে অবস্থিত মুঘল পূরার্কীতি হাজীগঞ্জ, সোনাকান্দা ও ইদ্রাকপুর কেল্লার ঐতিহাসিক গুরুত্ব যেমন অমূল্য, তেমনি এর সংরক্ষণও আমাদের দায়িত্ব। এগুলো শুধু অতীতের প্রতিরক্ষা স্থাপনা নয়, এগুলোই আজকের বাংলাদেশের গৌরবময় ঐতিহ্যের জীবন্ত সাক্ষী।
- বিশেষ প্রতিনিধি (Special National Correspondent) মোঃ সাইদুর রহমান (বাবু)