09/24/2025 ফিলিস্তিনকে আরও ছয় দেশের স্বীকৃতি, বিশ্বজুড়ে কূটনৈতিক সমীকরণে পরিবর্তন—গাজা সংঘাত দ্রুত শেষ চান ট্রাম্প
odhikarpatra
২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০০:০০
ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে আরও ছয়টি দেশ—ফ্রান্স, অ্যান্ডোরা, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, মাল্টা ও মোনাকো। এর ফলে জাতিসংঘের ১৯৩ সদস্যদেশের মধ্যে এখন পর্যন্ত ১৫৭টি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে, যা বিশ্বের মোট দেশসংখ্যার ৮০ শতাংশেরও বেশি।
এই স্বীকৃতির ফলে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট সমাধানে নতুন এক কূটনৈতিক অধ্যায় শুরু হলো বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা ও ইসরায়েলের কঠোর অবস্থানের কারণে বাস্তব সমাধানের পথ এখনও অনিশ্চিত।
নিরাপত্তা পরিষদে নতুন সমীকরণ
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পাঁচ সদস্যের মধ্যে চারটি দেশ এখন ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নিয়েছে। এই তালিকায় রয়েছে ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া ও চীন। একমাত্র ব্যতিক্রম যুক্তরাষ্ট্র, যারা দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলের প্রধান মিত্র হিসেবে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র স্বীকৃতি দেওয়ার বিরোধিতা করে আসছে।
ফ্রান্সের এই পদক্ষেপকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। কারণ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বড় শক্তিগুলোর মধ্যে ফ্রান্সই প্রথম দেশ, যারা সরাসরি স্বীকৃতি ঘোষণা করল। এর আগে স্পেন, আয়ারল্যান্ড ও নরওয়ে এ ধরনের স্বীকৃতি দিয়েছিল।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে নতুন এই স্বীকৃতির সমালোচনা করেন। তাঁর ভাষায়, “ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার মানে হচ্ছে হামাসকে পুরস্কৃত করা। এ সংগঠন বারবার শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে।”
তবে একই বক্তৃতায় তিনি গাজায় চলমান সংঘাত দ্রুত বন্ধ করার আহ্বান জানান। ট্রাম্প বলেন, “গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য যুক্তরাষ্ট্র গভীরভাবে সম্পৃক্ত। আমাদের দ্রুত এই সংঘাত থামাতে হবে।”
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ইসরায়েলের ধারাবাহিক হামলায় গাজায় ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় তৈরি হয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই বছরে প্রায় ৬৫ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় ১ লাখ ৬৬ হাজার মানুষ। শিশু ও নারী নিহতের সংখ্যাই এতে সর্বাধিক।
শুধু গতকালই ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় গাজায় অন্তত ৩৮ জন নিহত হয়েছে। গাজার উত্তরাঞ্চলের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলো প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। হাজার হাজার পরিবার এখন বাস্তুচ্যুত।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস নতুন স্বীকৃতির প্রসঙ্গে বলেন, “একটি রাষ্ট্র ফিলিস্তিনিদের অধিকার, কোনো পুরস্কার নয়।” তাঁর মতে, দীর্ঘ দশক ধরে নিপীড়নের শিকার ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া আন্তর্জাতিক আইন ও ন্যায়ের প্রশ্ন।
১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তির মাধ্যমে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, সেটি ইসরায়েলের অনাগ্রহ ও পশ্চিমা শক্তিগুলোর দুর্বল অবস্থানের কারণে কার্যকর হয়নি। তবে সাম্প্রতিক স্বীকৃতিগুলোকে সেই শান্তিপ্রক্রিয়ার পুনরুজ্জীবন হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ফিলিস্তিন স্বীকৃতির বিশেষ সম্মেলন আয়োজন করে সৌদি আরব ও ফ্রান্স। যদিও সৌদি প্রধানমন্ত্রী মুহাম্মদ বিন সালমান উপস্থিত ছিলেন না, তাঁর প্রতিনিধি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল বিন ফারহান সম্মেলনে যোগ দেন। তিনি বলেন, “শুধুমাত্র দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানই মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি নিশ্চিত করতে পারে।”
এ ছাড়া জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ফাঁকে ট্রাম্পের সৌদি আরব, তুরস্ক, মিসর, পাকিস্তান, জর্ডান ও ইন্দোনেশিয়াসহ মুসলিম আট দেশের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে। সেখানে গাজা সংঘাত বন্ধ ও ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কাঠামো নিয়ে আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
অন্যদিকে, ইসরায়েল এই স্বীকৃতিকে ‘রাজনৈতিক নাটক’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। জাতিসংঘে ইসরায়েলের দূত ড্যানি ড্যানন বলেন, “পশ্চিমা দেশগুলোর এই স্বীকৃতির জবাব দিতে আমাদের প্রস্তুতি আছে।”
গবেষক আদেল আবদেল গাফারের মতে, ইসরায়েল তিনভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে—
১. ফিলিস্তিনের আরও ভূখণ্ড ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্ত করা।
২. স্বীকৃতি দেওয়া দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক কমিয়ে আনা।
৩. অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে স্বীকৃতি বাতিলের চেষ্টা করা।
## বিশ্লেষণ: বিশ্ব রাজনীতিতে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত
ফিলিস্তিনকে একে একে পশ্চিমা দেশগুলোর স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। কয়েক বছর আগেও ইউরোপ বা উত্তর আমেরিকার দেশগুলোর কাছ থেকে এ ধরনের সিদ্ধান্ত কল্পনাতীত ছিল।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পশ্চিমা বিশ্বের এই পদক্ষেপ ইসরায়েলকে চাপের মুখে ফেলবে। একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রও ক্রমশ একা হয়ে পড়ছে। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের মধ্যে চার দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের একক অবস্থান আন্তর্জাতিক পরিসরে আরও দুর্বল হয়ে যেতে পারে।
কিহবে ভবিষ্যতে?
বর্তমানে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া দেশসংখ্যা ১৫৭। তবে জার্মানি ও ইতালি এখনো স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, আপাতত তারা ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেবে না। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র তাদের অবস্থান পরিবর্তন না করলে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রক্রিয়া চূড়ান্ত রূপ পাবে না বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
তবুও সাম্প্রতিক স্বীকৃতিগুলো ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নতুন গতি যোগ করেছে। এখন দেখার বিষয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এই চাপ ইসরায়েলকে আলোচনায় ফিরতে কতটা বাধ্য করে।