—বিশেষ বিশ্লেষণধর্মী ফিচার

বাংলাদেশে আইনের সমতার নীতি ও বাস্তবতার ফারাক নিয়ে বিশ্লেষণ—ভিআইপি সংস্কৃতি কীভাবে সাধারণ মানুষের আস্থা, ন্যায়বিচার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তা নিয়ে একটি প্রাসঙ্গিক ও সমকালীন আলোচনা।/ A critical analysis of Bangladesh’s legal equality versus on-ground reality—exploring how VIP culture undermines public trust, justice, and constitutional principles.

ভূমিকা: 'লেখা আছে যা, হচ্ছে তার উল্টো'—এই খেলা কতদিন?

বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাটা যেন এক জটিল ধাঁধা। বইয়ের পাতায় এর ছবিটা খুব সুন্দর, একেবারে ঝকঝকে—গণতন্ত্রের আলো, আইনের শাসন আর সাম্যের প্রতিশ্রুতি। কিন্তু যখনই চোখ বন্ধ করে এই পাতা থেকে বাস্তবে পা রাখি, তখনই দেখি ছবিটা কেমন যেন 'পিছল'! সংবিধানে যা লেখা আছে, তার সঙ্গে আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা মাঝে মাঝে এমন সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে যে মনে হয়, আমরা কি দুটো ভিন্ন দেশে বাস করছি? এই আর্টিকেলে আমরা সেই 'গোলমেলে' অসঙ্গতিগুলো নিয়ে একটু হালকা চালে বিশ্লেষণ করব।

১. আইন সবার জন্য সমান: কিন্তু 'ভিআইপি'র রাস্তা আলাদা কেন?

আমাদের সংবিধানের মূল কথা হলো: আইনের চোখে সবাই সমান। বাহ! কী দারুণ কথা! কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখি?

• অসঙ্গতি: ধরুন, আপনি এক জরুরি কাজে মতিঝিল যাচ্ছেন। রাস্তায় প্রচণ্ড জ্যাম। সবাই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ সাইরেন বাজিয়ে একটা বিশেষ স্টিকার লাগানো গাড়ি বেরিয়ে গেল। সবাই আটকে রইল, শুধু সেই 'বিশেষ ব্যক্তিটি' পেলেন বিনা বাধায় যাওয়ার অনুমতি।
• বিশ্লেষণ: এই যে 'ভিআইপি' বা বিশেষ সুবিধাভোগী সংস্কৃতি, এটা আসলে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ভেতরে তৈরি হওয়া একটি 'গোপন অলিখিত নিয়ম'। এই সংস্কৃতি আইনের সামনে মানুষকে সমান না দেখে ক্ষমতা বা পদমর্যাদার ভিত্তিতে ভাগ করে দেয়। যখন সাধারণ মানুষ দেখছে যে নিয়ম এক শ্রেণির জন্য শিথিল, তখন তাদের কাছে আইনের প্রতি আস্থা কমে যায়।

২. বিচার পেতে দেরি মানেই কি ন্যায়বিচারে ব্যর্থতা?

সংবিধান আমাদের দ্রুত ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার দিয়েছে। বিচার যেন লটারি না হয়!

• অসঙ্গতি: কিন্তু বাস্তবে, ছোট একটি মামলার নিষ্পত্তি হতে বছরের পর বছর লেগে যায়। আদালতের বারান্দায় ঘুরতে ঘুরতে সাধারণ মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়েন। অন্যদিকে, প্রভাবশালী কেউ কেউ হয়তো দ্রুত জামিন বা বিচারিক সুবিধা পেয়ে যাচ্ছেন।
• বিশ্লেষণ: বিচার ব্যবস্থার এই দীর্ঘসূত্রতা নিজেই একটি বড় অসঙ্গতি। এটিকে অনেকে আইনের শাসনের দুর্বলতা হিসেবে দেখেন। বলা হয়, "Justice delayed is justice denied"—অর্থাৎ, দেরিতে বিচার পাওয়া মানে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হওয়া। এই জট এবং অপ্রতুল লোকবল প্রমাণ করে যে, রাষ্ট্র জনগণের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষা করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে।

৩. স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি: অলিখিত 'কমিশন' ব্যবস্থা

রাষ্ট্রীয় কার্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার কথা।

• অসঙ্গতি: সরকারি কোনো কাজ, হোক তা একটি সাধারণ লাইসেন্স বা একটি বড় প্রকল্প—অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে কাজটা সঠিকভাবে বা দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য 'স্পিড মানি' বা অলিখিত 'কমিশন' দিতে হচ্ছে। শুধু তাই নয়, নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধার বদলে রাজনৈতিক বা পারিবারিক 'যোগাযোগ' প্রাধান্য পাচ্ছে।
• বিশ্লেষণ: এই দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয়। লিখিত নিয়ম থাকলেও, এই 'অনৈতিক লেনদেন' একটি সমান্তরাল ব্যবস্থা তৈরি করে। এর ফলে, সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিরা বঞ্চিত হয় এবং রাষ্ট্রের সম্পদ অপব্যবহার হয়। অর্থাৎ, খাতায়-কলমে থাকলেও, বাস্তবে কাজ করে 'কানেকশন'।

উপসংহার: 'ছিদ্রযুক্ত বালতি'তে জল ভরার চেষ্টা

বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার এই অসঙ্গতিগুলো একটি 'ছিদ্রযুক্ত বালতি'র মতো। আমরা যত বেশি উন্নয়ন আর সুশাসন ঢালার চেষ্টা করি না কেন, যদি এই ফাঁক-ফোঁকরগুলো বন্ধ না হয়, তবে সবই নষ্ট হয়ে যাবে।

এই সমস্যাগুলো একদিনে সৃষ্টি হয়নি। তবে সমাধানও এক লহমায় হবে না। প্রয়োজন হলো:

• রাজনৈতিক সদিচ্ছা: সংবিধানকে তার আসল রূপে ফিরিয়ে আনার আন্তরিক উদ্যোগ।
• নাগরিক সচেতনতা: সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রশ্ন করার সাহস ও অন্যায়কে প্রত্যাখ্যান করার মানসিকতা।
• প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিশালীকরণ: দুর্নীতি দমন কমিশন এবং বিচার বিভাগকে আরও স্বাধীন ও শক্তিশালী করা।

আসুন, আমরা সবাই এই ব্যবস্থার ত্রুটিগুলো নিয়ে আর চুপ না থাকি। আমাদের হালকা চালের আলোচনা, সচেতনতা এবং সামান্য প্রচেষ্টা হয়তো একদিন এই গোলমেলে সমীকরণকে একটা সহজ, সঠিক উত্তরে ফিরিয়ে আনবে।

আপনার মতে এই অসঙ্গতিগুলো দূর করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় কী হতে পারে?

✍️ –অধ্যাপক ড. মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা সম্পাদক, অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com)

#আইনের_সমতা #ভিআইপি_সংস্কৃতি #বাংলাদেশ_আইন #সামাজিক_অসঙ্গতি #আইনের_শাসন #গণতন্ত্র #TrafficInequality #RuleOfLaw #BangladeshSociety #PublicAwareness