12/16/2025 ১৫ই ডিসেম্বরের প্রহর: মুক্তির ঠিক আগের দিন — যুদ্ধ শেষের চাপা উত্তেজনা, আর আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ
Dr Mahbub
১৫ December ২০২৫ ০৯:০৭
— মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ ফিচার ।বুধবার, ১৫ই ডিসেম্বর, ১৯৭১।৩০ অগ্রহায়ণ ১৩৭৮।২৫শে শাওয়াল ১৩৯১ হিজরি
মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের ঠিক আগের দিন, ১৫ই ডিসেম্বরের চাপা উত্তেজনা ও ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে আবেগময় ফিচার। বিজয়ের সেই মূল প্রতিশ্রুতি ও বর্তমান সময়ের বিচ্যুতিগুলো বিশ্লেষণ এবং উত্তরণের পথ।মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত আখ্যান।
১৬ই ডিসেম্বর, বিজয় দিবস— আমাদের আনন্দের দিন। কিন্তু এই বিজয়ের ঠিক আগের দিন, ১৫ই ডিসেম্বরের কথা ভাবুন। দিনটি কেমন ছিল?
সেদিন ঢাকায় ছিল থমথমে উত্তেজনা। চারদিকে মিত্রবাহিনীর অগ্রযাত্রা, আর পাকিস্তানি বাহিনীর ভেতরে আত্মসমর্পণের মানসিক প্রস্তুতি। এটি ছিল দীর্ঘ নয় মাসের এক মহাযুদ্ধের শেষ প্রহর, যখন বিজয় নিশ্চিত, শুধু সময়ের অপেক্ষা। ১৫ তারিখের সন্ধ্যা মানেই যেন— এক হাতে চাপা ভয়, আরেক হাতে নতুন ভোরের আশা।
আজ আমরা সেই ১৫ই ডিসেম্বরের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়েই দেখব, মুক্তির প্রাক্কালে বাঙালি জাতি কোন স্বপ্নগুলো বুনেছিল, আর সেই স্বপ্নের সঙ্গে বর্তমান বাস্তবতার ফারাকটাই বা কতটুকু।
১৯৭১ সালের ১৫ই ডিসেম্বর, শহরগুলো প্রায় স্তব্ধ। আকাশপথে মিত্রবাহিনীর দাপট, আর স্থলপথে ঢাকার দিকে ছুটে আসছে মুক্তির বার্তা। কিন্তু আত্মসমর্পণের ঘোষণা তখনও আসেনি। এই দিনটি ছিল এক চরম অনিশ্চয়তার দিন:
ঘরের কোণে ফিসফিসানি: পুরান ঢাকার বেগম বাজার এলাকার বাসিন্দা ফরিদা বেগম (ছদ্মনাম)। সারাদিন শুধু রান্নাঘরের কোণে বসে রেডিওতে কান পেতে ছিলেন। ১৫ তারিখ রাতে বাইরে গোলাগুলির শব্দ আরও বেড়ে গেল। ফরিদা দ্রুত সাত বছরের ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। ছেলেটি ভয়ে ফুঁপিয়ে উঠলে ফরিদা ফিসফিস করে বললেন, "চুপ সোনা, বাইরে শত্রুরা শুনতে পাবে। একটু অপেক্ষা করো। কাল সকালে দেখবে, নতুন সূর্য উঠবে, আর আমাদের আর ভয় পাবে না।" তিনি জানেন না কালকের সূর্যটা কেমন হবে, কিন্তু তার চোখে তখন এক অব্যক্ত প্রতিজ্ঞা— আর ভয় নয়, এবার মুক্তি। ফরিদা বেগমের মতো লক্ষ বাঙালি সেদিন শুধু নিঃশব্দে আশা ধরে রেখেছিলেন।
ঢাকার উপকণ্ঠে, কাঁপা হাতে অস্ত্র ধরে আছেন একদল গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা। সারারাত তারা অপেক্ষা করছেন আক্রমণের চূড়ান্ত নির্দেশনার জন্য। তাদের ক্লান্তি আকাশ ছুঁয়েছে, কিন্তু মনোবল ইস্পাতের মতো দৃঢ়।
কাঁধে রাইফেল, চোখে ভোর: হাবিলদার মজিদ (ছদ্মনাম), যিনি গত সাত মাস ধরে গেরিলা যুদ্ধ করছেন, ১৫ তারিখ রাতে তার দলটি সাভারের কাছাকাছি এক গোপন আস্তানায় অপেক্ষা করছিল। ঠাণ্ডা ডিসেম্বরের রাতে মজিদের গায়ে কাঁথা নেই, কিন্তু তার ভেতরে উষ্ণতা। সহযোদ্ধাদের দিকে তাকিয়ে তিনি মৃদু হেসে বললেন, "আর মাত্র কটা ঘন্টা। কালকে আমরা ঢাকার ভেতরে ঢুকব। আমাদের আর পালাবার দরকার হবে না।"
তাদের খাবারের থলেতে ছিল শুকনো চিঁড়ে আর গুড়, কিন্তু তাদের ক্ষুধা ছিল একটিই— স্বাধীনতা। মজিদ রাইফেলটির নল পরিষ্কার করতে করতে মনে মনে ভাবছিলেন, এই স্বাধীনতা কেবল ভূখণ্ডের নয়, এটি হবে তার গ্রামের অভাবী মানুষদের মুখে হাসি ফোটানোর স্বাধীনতা। এই হাসি না দেখতে পেলে তার যুদ্ধটা যে অসমাপ্ত থেকে যাবে! সেই রাতে তাদের চোখে ঘুম ছিল না, ছিল শুধু মুক্তির ঠিকানায় পৌঁছানোর প্রখর নেশা।
১৬ই ডিসেম্বরের আত্মসমর্পণের ক্ষেত্রটি তৈরি হয় ১৫ই ডিসেম্বরের সামরিক ও কূটনৈতিক কার্যকলাপের মাধ্যমে। দিনটি ছিল আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি পর্ব:
১৫ই ডিসেম্বর বিশ্ব সংবাদ মাধ্যম কার্যত নিশ্চিত হয়ে যায় যে পূর্ব পাকিস্তানের পতন শুধু সময়ের অপেক্ষা। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রধানত দুটি বিষয় উঠে আসে:
১৫ই ডিসেম্বর যখন রাত গভীর হচ্ছে, তখন প্রতিটি মুক্তিকামী মানুষের মনে তিনটি মৌলিক প্রতিজ্ঞা বারবার অনুরণিত হচ্ছিল। এগুলো শুধু রাজনৈতিক স্লোগান ছিল না, ছিল জাতির আত্মা—
ক. শোষণের অবসান (অর্থনৈতিক মুক্তি): আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম, নতুন দেশে কেউ শোষিত হবে না। জমির মালিক যেমন তার ফসল পাবেন, তেমনি শ্রমিকের শ্রমের সঠিক মূল্য থাকবে। অর্থনৈতিক বৈষম্য ঘুচিয়ে সবাই সুখে শান্তিতে থাকবে।
খ. ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা (সুশাসন): আমরা চেয়েছিলাম এমন এক রাষ্ট্র, যেখানে আইন সবার জন্য সমান হবে। যেখানে দুর্বল মানুষটিও মাথা উঁচু করে ন্যায় বিচার পাবে, আর ক্ষমতাশালীর দাপট থাকবে না।
গ. ভয়হীন সংস্কৃতি (মত প্রকাশের স্বাধীনতা): যেহেতু সামরিক স্বৈরাচার আর একনায়কত্বের বিরুদ্ধে লড়েছিলাম, তাই আমাদের সবচেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষা ছিল একটি মুক্ত সংস্কৃতি, যেখানে মানুষ নির্ভয়ে কথা বলতে পারবে, লিখতে পারবে এবং নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারবে।
আজ যখন আমরা সেই বিজয়ের আগের দিনের কথা ভাবি, তখন তখন মনে হয়— আমরা অনেক কিছু অর্জন করলেও, পথ চলতে গিয়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক থেকে কিছুটা দূরে সরে এসেছি।
শহীদ মিনারের নীরব জিজ্ঞাসা: ধরুন, মজিদের ছেলে শাহেদ। এখন সে একজন সরকারি কর্মচারী। দেশ স্বাধীন হওয়ার চল্লিশ বছর পর, শাহেদ তার বাবার স্বপ্নটা ঠিক মতো পূরণ করতে পারেনি। মজিদ স্বপ্ন দেখতেন, তার ছেলে যেন মাথা নিচু করে কারও কাছে বিচার না চায়। কিন্তু শাহেদকে প্রায়শই তার ন্যায্য পাওনার জন্যেও ওপর মহলকে 'খুশি' করতে হয়। একবার এক সাধারণ মানুষকে সঠিক সেবা দিতে গিয়ে তাকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বকা খেতে হলো। সেদিন সন্ধ্যায় শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে শাহেদ যেন শুনতে পেল— তার বাবার ফিসফিসানি, "এই কি সেই মুক্তি, বাবা?" এই চাপা দুঃখ আর আপস আমাদের অনেক অর্জনকে ম্লান করে দেয়।
আমাদের ফিরতে হবে সেই ১৫ই ডিসেম্বরের স্বপ্নমাখা পথে। এর জন্য বড় কোনো বিপ্লব নয়, দরকার ছোট ছোট, সচেতন পদক্ষেপ:
ক. শূন্য সহনশীলতা (Zero Tolerance): সরকারি-বেসরকারি সব স্তরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘শূন্য সহনশীলতা’ দেখাতে হবে। ছোট হোক বা বড়— দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া চলবে না। একজন শিক্ষক যখন সঠিক সময়ে ক্লাস নেন, একজন সরকারি কর্মকর্তা যখন ঘুষ ছাড়া সেবা দেন— তখনই আমরা আমাদের প্রতিজ্ঞার পথে ফিরি।
খ. সহমর্মিতার চর্চা: গণতন্ত্র শুধু ভোট দেওয়া নয়, এটি অন্যের মতকে সহ্য করার শক্তি। পরিবারে, কর্মস্থলে এবং সমাজে ভিন্ন মতকে গুরুত্ব দিতে শিখতে হবে। সবার আগে আমরা বাঙালি, এই বোধকে প্রাধান্য দিতে হবে।
গ. প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার: এখন তরুণ প্রজন্ম তথ্যপ্রযুক্তিতে অনেক এগিয়ে। প্রযুক্তিকে যেন আমরা শুধু বিনোদনের জন্য ব্যবহার না করে, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করি। যেমন, কোনো সরকারি সেবায় দেরির বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা বা ভালো কাজের স্বীকৃতি দেওয়া।
ঘ. ইতিহাসের নিয়মিত পাঠ: বিজয়ের আগের দিনগুলোতে আমাদের পূর্বপুরুষরা কী ত্যাগ স্বীকার করেছেন, সেই গল্পগুলো নতুন প্রজন্মকে আরও বেশি করে শোনাতে হবে। আবেগ নয়, তাদের মনে আদর্শের বীজ বপন করতে হবে।
১৫ই ডিসেম্বরের প্রহর আমাদের শেখায় যে, সবচেয়ে কঠিন সময়ও কেটে যায়, আর অন্ধকারের পরেই আসে আলো। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিনের ঠিক আগের দিনটি ছিল শুধু সামরিক বিজয়ের অপেক্ষা নয়, এটি ছিল একটি জাতির চূড়ান্ত প্রতিজ্ঞার দিন।
চলুন, আমরা প্রতিজ্ঞা করি: আমাদের এই প্রিয় বাংলাদেশকে আমরা সেই স্বপ্নের বাংলাদেশ হিসেবেই গড়ে তুলব— যেখানে শোষণ থাকবে না, ন্যায় থাকবে এবং থাকবে মাথা উঁচু করে কথা বলার স্বাধীনতা। ১৫ই ডিসেম্বরের সেই চাপা উত্তেজনা যেন আমাদের বর্তমান কাজকে আরও গতিশীল করে তোলে। কারণ, জাতি হিসেবে আমাদের লক্ষ্য কেবল স্বাধীনতা অর্জন করা নয়, স্বাধীনতার মর্যাদা রক্ষা করা।
- অধ্যাপক ড. মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা সম্পাদক, আমাদের অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com)
#মুক্তিযুদ্ধ #বিজয়দিবস #বাংলাদেশ #একাত্তর #১৫ডিসেম্বর #স্বাধীনতারস্বপ্ন #জাতীয়আদর্শ