12/16/2025 আজ ১৬ ডিসেম্বর, মহান বিজয় দিবস: পলাশীর আম্রকানন হতে ঢাকার রমনা রেসকোর্স হয়ে আজকের বাংলাদেশ--- সাধু সাবধান!
Dr Mahbub
১৬ December ২০২৫ ০৫:২০
সময় যখন কথা বলে, সংখ্যা যখন সতর্ক করে, ইতিহাস যখন ফিরে আসে---আজকের এই বিজয় দিবসে এই প্রবন্ধে আমাদের এই সুদীর্ঘ ২১৪ বছর ৫ মাস ২৩ দিন তথা ৭৮,৩৩৭ দিন পরাধীনতার ইতিহাস এবং স্বাধীনতার সংগ্রামকে ”সময়, ইতিহাস, সংখ্যা, জ্যোতিষ শাস্ত্র “-এর আলোকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। আজকের অস্থির সময়ের জন্য ফুটে ওঠেছে বিশেষ সতর্কবার্তা। মনে রাখতে হবে, সময় যখন কথা বলে, সংখ্যা যখন সতর্ক করে, ইতিহাস তখন ফিরে আসে।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ । এক বৃহস্পতিবার। মুক্তি-সূর্যের পুনরুত্থান
যে কোনো জন-গোষ্ঠীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ জানি, সে তো তার স্বাধীনতার অমূল্যবাণী। আমাদের মুক্তি-ধন আরো বেশি দামি, রক্তের বিনিময়ে অর্জন করেছি, আর যুদ্ধ করে বীরের মতো বারবার তাড়িয়েছি সেই অত্যাচারী ভূস্বামী। আর এর মধ্যেই রয়েছে শিক্ষা, যা এড়িয়ে গেলে হতে পারে সর্ব্নাশ। অনুরোধ করছি, দেশের জন্য একটু সময়, একটু চিন্তা, একটু ভালোবাসা বরাদ্দের।
ইতিহাস কখনো হঠাৎ ঘটে না। ইতিহাস আগে ফিসফিস করে, তারপর গর্জন করে। দীর্ঘ সময় ধরে তাকিয়ে থাকে। অপেক্ষা করে। মানুষের সিদ্ধান্ত, ভুল, অহংকার আর বিভাজন গুনে গুনে জমা করে। তারপর একদিন—একটি নির্দিষ্ট সকালে, একটি নির্দিষ্ট বৃহস্পতিবারে—সে নিজের হিসাব মিলিয়ে নেয়।
২৩ জুন ১৭৫৭। আরেক বৃহস্পতিবার । পলাশীর আম্রকানন।
পলাশীর আম্রকাননে সেদিন—২৩ জুন ১৭৫৭, বৃহস্পতিবার—ইতিহাস ফিসফিস করছিল। সকালটা ছিল স্বাভাবিক, কিন্তু বাতাস ভারী। গাছের পাতায় পাতায় যেন চাপা উৎকণ্ঠা। যুদ্ধের ময়দানে কামান ছিল, সৈন্য ছিল, তলোয়ার ছিল—কিন্তু সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্রটি ছিল অদৃশ্য। তার নাম বিশ্বাসঘাতকতা। বাতাসে বারুদের চেয়ে ভারী ছিল এই বিশ্বাসঘাতকতার গন্ধ। যুদ্ধ তখন কেবল আনুষ্ঠানিকতা; পরাজয় আগেই লেখা হয়ে গিয়েছিল মানুষের মনে। মীর জাফরের নীরবতা ছিল সেই দিনের সবচেয়ে উচ্চ শব্দ। সেদিন বাংলা হেরেছিল অস্ত্রে নয়, ভেতরের ফাটলে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই বাংলার ভাগ্য যেন শেষ অনুচ্ছেদে পৌঁছে গিয়েছিল।
আসলে সেদিন বাংলা কেবল একটি যুদ্ধেই হারেনি। হারিয়েছিল নিজের ওপর বিশ্বাস। ইংরেজ বেনিয়ারা খুব দ্রুত বুঝে গিয়েছিল—এই ভূখণ্ড দখল করতে হলে বাহ্যিক শক্তির চেয়ে ভেতরের ফাটলই সবচেয়ে বড় সহায়ক। পলাশীর আম্রকানন তাই ইতিহাসে শুধু একটি স্থান নয়; এটি একটি মানসিক অবক্ষয়ের প্রতীক।
সেই একটি দিনের পর শুরু হয় দীর্ঘ, অন্ধকার যাত্রা। এই ভূখন্ডের মানুষের জীবনে নেমে আসে সময়ের দীর্ঘ অন্ধকার করিডর। সেই একটি দিনের সময়ের হিসেব ক্যালেন্ডারের পাতায় হয়ে দাঁড়ায় ২১৪ বছর ৫ মাস ২৩ দিন। ক্যালেন্ডারে নিছক সংখ্যা, হঠাৎ করেই সেদিন এদেশের ভাগ্য অনিশ্চয়তায় ফেলে দেয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম অসহনীয় অপমান, অন্যায়, শোষণের মধ্য দিয়ে মাথা নত করে বেঁচে থাকার চেষ্টায় এ ভূখন্ডের আমজনতা স্বীয় ভাগ্যের উপর দোষারপ করেতে থাকে। আর এটা এ অঞ্চলে নেতিবাচকতায় পরিবর্তিত করে দেয় মানুষের জীবন। শুরু হয় হারিয়ে যাওয়া স্বাধীনতার খোজে কয়েক প্রজন্মের ক্লান্ত হাঁটা। সংগ্রামী পথ চলা।
এরই মধ্যে ৭৮,৩৩৭ দিন ধরে বাঙালি শিখেছে পরাধীনতার ব্যাকরণ— কীভাবে নিজের জমিতে অন্যের ফসল ফলে, কীভাবে নিজের নদীতে অন্যের জাহাজ চলে, কীভাবে ধীরে ধীরে নিজের ইতিহাস অন্যের ভাষায় লেখা হয়। এক সময়ে মাথা উঁচু করে থাকা এই বেঙ্গল টাইগারের জাতি যেন ধীরে ধীরে বিড়ালে রূপান্তরিত হতে থাকে, মাথা উঁচু করে কীভাবে বাঁচতে হয়, তাই যেনো ভুলে যেতে থাকে। মনে করতে পারে না, শেষ কবে মুক্আত বাতাসে প্ররাণ খুলে নি:শ্বাস নিয়েছিল। এই পরাধীনতার প্রতিটি দিন ছিল যেন একেকটি নীরব আত্মসমর্পণ, আবার প্রতিটি রাতের শেষে যেনো ক্ষীণ হলেও জেগে থাকতো স্বপ্নের প্রদীপ। আর কোনো একদিন সব অত্যাচারের অবসান হবে এই ভেবে ভেবে কিছুটা হলেও সাময়িক আত্মতৃপ্তি লাভ করার চেষ্টা করতো। কিন্তু বিধি বাম! হৃদয়ের রক্তক্ষরণ যেনো আরো বাড়তেই থাকলো। মানুষের মাঝে বিশ্বাসের হৃদয়ে জন্ম নিলো অবিশ্বাসের ছায়া। ক্ষমতাহীন হয়ে এই ভূখন্ডের সন্তানরা বার বার সৃষ্টিকর্তার কাছে সাহায্য কামনা করতে থাকলো। কিন্তু ভাগ্যের কোনো পরিবর্তনের লক্ষণই দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল না।
এরূপ অস্থিরতার সময়ে ক্যালেন্ডারের সংখ্যাগুলো যেনো ছিল বাইরে থেকে নির্বিকার ও ঠান্ডা। বছর, মাস, দিন—শীতল গণিত। কিন্তু এই সংখ্যার ভেতরে জমে থাকে দীর্ঘশ্বাস, ক্ষয়, অপেক্ষা।সময় এখানে কেবল প্রবাহ নয়; সময় এখানে চরিত্র। পলাশী তাই শুধু একটি যুদ্ধক্ষেত্র নয়—এটি একটি মানসিক ভাঙনের নাম, জাতিগত বিভেদের উপাখ্যান, সার্বিকভাবে একটি জাতিগত ভুল সিদ্ধান্তের স্থায়ী ঠিকানা। সময় এখানে প্রত্যক্ষ করে, কীভাবে বিভাজন জাতিকে ভেঙে দেয়, আবার কীভাবে ঐক্য তাকে (সেই জাতিকে) গড়ে তোলে, মুক্তির পথ দেখায়।
সময় এগোয়, কিন্তু ক্ষত শুকোয় না। ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ আসে—আরেকটি বৃহস্পতিবার। স্বাধীনতা আসে, কিন্তু খণ্ডিত হয়ে। মানুষের আজন্ম লালিত মুক্তির স্বাদ যেনো অসম্পূর্ণই থেকে যায়। মানচিত্র বদলায়, কিন্তু শাসনের মানসিকতা বদলায় না। বাঙালি প্রত্যক্ষ করে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, বৈষম্য ও সম্পদের লুন্ঠন। ক্ষমতার ভাষা থাকে সেই আগের মতোই। পূর্ব বাংলা নতুন রাষ্ট্রের অংশ হয়, কিন্তু বৈষম্যের হিসাব আরও স্পষ্ট হয়। পূর্ব বাংলা নতুন নাম পায়—পূর্ব পাকিস্তান। কিন্তু শোষণের কাঠামো প্রায় অপরিবর্তিতই থাকে। ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি—সবখানেই বৈষম্যের দেয়াল আরও উঁচু হয়। এই সময়কাল—২৪ বছর ৪ মাস ২ দিন, মোট ৮,৮৯০ দিন—ছিল জমাটবাঁধা যন্ত্রণার সময়। ভাষার জন্য রক্ত, অধিকারের জন্য আন্দোলন, আত্মপরিচয়ের জন্য দীর্ঘশ্বাস। ধর্মের দোহাই দিয়ে এই দিনগুলোতে জন্ম নেয় নতুন বৈষম্য, সামাজিক অনাচার ও শোষণের। মনে হয়, ইতিহাস যেন ইচ্ছা করেই এই সময়কে ছোট রেখেছিল—যাতে করে কম দিনে বেশি ক্ষোভ জমা হতে পারে, যাতে বারুদের বিস্কফোরণ ঘটাতে পারে। আর এই ক্ষোভই একদিন ইতিহাসের মঞ্চ বদলে দেয়।
৭ মার্চ ১৯৭১। রবিবার।
ঠিক এখানেই ইতিহাস তার নাট্যরূপ বদলায়। মঞ্চ সরে আসে ঢাকায়—রমনা রেসকোর্সে। আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। পলাশীর আম্রকাননের বিপরীতে এই মাঠ হয়ে ওঠে ঐক্যের প্রতীক। এই রমনা রেসকোর্স সেদিন হয়ে ওঠে একটি মানসিক পুনর্জন্মের স্থান। এখানে আর কোনো মীর জাফর নেই, নেই বিশ্বাসঘাতকতার ফাঁক। আছে একটি জাতি, এক কণ্ঠ, এক স্বপ্ন।
৭ মার্চ ১৯৭১—এখানেই উচ্চারিত হয় সেই বাক্য, যা কেবল রাজনৈতিক ঘোষণা নয়, একটি জাতির আত্মজাগরণ। এই মাঠে সেদিন আর কোনো নীরবতা ছিল না। লক্ষ কণ্ঠের ভেতর দিয়ে এক কণ্ঠ উচ্চারিত হয়—“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।” এই বাক্য ছিল পলাশীর বিপরীত প্রতিধ্বনি। আর এই অমোঘ বাক্যে সেদিন আর কোনো বিভাজন ছিল না, ছিল না নীরব বিশ্বাসঘাতকতা। ছিল সম্মিলিত চেতনা। পলাশী যেখানে হয়ে ওঠেছিল বিভাজনের উর্বর ক্ষেত্র, আর তার বিপরীতে, তথা সেই বিভাজের ২১৩ বছর ৮ মাস ১৫ দিন পরে এসে রেসকোর্সে তৈরি হয় ঐক্য। পলাশীতে গণমানুষের মাঝে নীরবতা ছিল, কিন্তু এখানে ছিল ঠিক উল্টো। এখানে দেখা যায় বজ্রধ্বনি, মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত মানুষ।
এরপর ইতিহাস দ্রুত হাঁটে।
এরপর আসে ইতিহাসের সবচেয়ে আবেগঘন কিন্তু বীরত্বময় অধ্যায়। ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১—মাত্র ২৬৬ দিন, ৮ মাস ২২ দিন, ৩৮ সপ্তাহ। কাগজে ছোট সংখ্যা, বাস্তবে অগ্নিপরীক্ষা। প্রতিটি দিন ছিল অনিশ্চয়তার, প্রতিটি রাত ছিল মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ানোর শিক্ষা, প্রতিটি মুহুর্ত ছিল স্বাধীনতার স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখার লড়াই। এই অল্প সময়েই বাঙালি প্রমাণ করে—ঐক্যবদ্ধ হলে সময়ের চাকা উল্টে দেওয়া যায়। বাস্তবিক অর্থে এই সময়েই বাঙালি উপলব্দি করে—ঐক্যবদ্ধ হলে ইতিহাসের গতি বদলানো যায়।
রমনা রেসকোর্সেই পরে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর হয়। ইতিহাস যেন নিজেই নিজের ভুল সংশোধন করে নেয়। পলাশীতে যে চক্র শুরু হয়েছিল, তা এখানে এসে ভাঙে। ১৯৭১-এ আজকের দিন তথা ১৬ ডিসেম্বরে এসে শেষ হয।
স্বাধীনতার ভেতর দিয়ে হাঁটার অধ্যায়
কিন্তু ইতিহাস থামে না। কিংবা ইতিহাস কখনো চূড়ান্ত বিদায়ও নেয় না। বার বার ফিরে আসে।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এর পর শুরু হয় আরেক অধ্যায়—স্বাধীনতার ভেতর দিয়ে হাঁটার অধ্যায়।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫—৫৪ বছর, ১৯,৭২৪ দিন। এটি পরাধীনতার বাইরে স্বাধীনতার ভেতর দিয়ে হাঁটার সময়। এই সময় আর অন্ধকার নয়, কিন্তু সম্পূর্ণ আলোকিতও নয়।এটি আর অপেক্ষার সময় নয়, বরং হিসাবের সময়। কী অর্জন হলো, কী হারালাম, আর কতটা পথ এখনো বাকি। এই সময় আগের দুই শতাব্দীর মতো নিকষ কুৎসিত নয়, আবার ১৯৭১-এর মতো তীব্র আত্মত্যাগের বাসনারও নয়। আসলে এটি দীর্ঘ এক সকাল—সূর্য উঠেছে, কিন্তু আলো পুরো মাঠে ছড়াতে এখনও সময় লাগে। এই আলোর প্রদীপ আমাদেরকে বার্তা দেয় অনেক দূরে যাওয়ার, কেননা সোনালী রাঙা প্রভাতের যে এখনও অনেক সময় বাকি! এই সময়েই আসে সবচেয়ে বড় পরীক্ষা—স্বাধীনতার রক্ষণাবেক্ষণ।
এখানেই ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত হয় সংখ্যা তত্ত্ব, রাশি তত্ত্ব, জ্যোতিষ শাস্ত্র। এই সংখ্যা তত্ত্ব, রাশি তত্ত্ব ও জ্যোতিষ শাস্ত্র যেন আমাদের ভবিষ্যত নিয়ে আবারো কথা বলতে শুরু করে। ২৩ জুন ১৭৫৭, ২৬ মার্চ ১৯৭১, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১—এই তারিখগুলো শুধু ঘটনাক্রম নয়, বরং জ্যোতিষ ভাষায় “সংবেদনশীল সন্ধিক্ষণ”-এর ইঙ্গিত। জ্যোতিষ মতে, কিছু সময় জাতির ভাগ্য নির্ধারণে পরীক্ষাকেন্দ্র হয়ে ওঠে। আর সেই সময়গুলোতে সামান্য ভুল সিদ্ধান্ত শতাব্দীর বোঝা হয়ে দাঁড়ায়, আবারো জাতির ভাগ্যাকাশে অন্ধকার মেঘ ডেকে আনে। আবার এই সময়গুলোতে যদি সঠিক ঐক্য সাধিত হয়, তাহলে মুহূর্তেই ইতিহাসের দিক বদলে যায়। আলোক জ্বলমলে সোনালী দিন উঁকি মারতে শুরু করে।
চন্দ্র–নক্ষত্রের প্রতীকী ভাষায় বাংলাকে বলা হয় চন্দ্রপ্রধান ভূখণ্ড—আবেগপ্রবণ, স্মৃতিনির্ভর, দ্রুত প্রতিক্রিয়াশীল। অর্থ্যাৎ আবেগ, স্মৃতি, প্রতিক্রিয়া—এই জাতির মূল চালিকাশক্তি। চন্দ্র যখন শক্তিশালী, তখন বাংলা জাগে—ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ তার প্রমাণ। আর যখন চন্দ্র গ্রহছায়ায় পড়ে, তখনই দেখা দেয় বিভ্রান্তি, গৃহবিবাদ, আত্মঘাতী বিভাজন।
নক্ষত্রচক্রে বিশাখা–জ্যেষ্ঠা–মূলা— এই ধারাকে ধরা হয় ক্ষমতা, ভাঙন ও পুনর্গঠনের প্রতীক হিসেবে। পলাশীর সময় ‘মূলা’র ধ্বংসাত্মক দিক সক্রিয় হয়েছিল বিভাজনের কারণে। ১৯৭১-এ সেই একই শক্তি ঐক্যের মাধ্যমে রূপ নেয় মুক্তির মহাজাগরণের। জ্যোতিষ শাস্ত্র এখানে নিয়তি ঘোষণা করে না— কিন্তু সতর্ক করে।
আজকের বাংলাদেশ তাই আবারো পরীক্ষার মুখে দাঁড়িয়ে। বাহিরে কোনো ইংরেজ বেনিয়া নেই, কোনো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নেই, নেই কোনো লাল কোটধারী শাসক। কিন্তু ভেতরের বিভক্তি, ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থের কারণে বিভাজন, পারস্পরিক অবিশ্বাস, গৃহবিবাদ—এগুলোই নতুন বেনিয়াদের সবচেয়ে বড় পুঁজি। এইরূপ অস্থিরতা, অবিশ্বাস ও ক্ষমতার দম্ভ যেনো নব্য উপনিবেশিক শক্তিকে আবারো এই দেশের ভূখন্ডে আহ্বান জানাচ্ছে, সুযোগ করে দিচ্ছে। এই নব্য বিদেশী উপনিবেশিক গোষ্ঠীসমূহ এই পবিত্র ভূমিকে তাদের ক্রীড়ানকে পরিণত করতে উদ্ধত হচ্ছে। আসলে তারা সুযাগ পায় এবং এই সুযোগের সদ্বব্যবহার করে বাংলার পবিত্র গৃহে প্রবেশ করে ‘ঋণ, চুক্তি, মতাদর্শ আর অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা’র ফাঁক দিয়ে। ‘বাইরে বন্ধু, ভেতরে নিয়ন্ত্রক’—ইতিহাসের পুরোনো কৌশল, নতুন মুখ, নতুন রূপে।
সংযুক্ত সময়ের হিসাব আমাদের তাই কেবল গণিত শেখায় না, নৈতিক শিক্ষা দেয়। এই সংযুক্ত নথির সময়ের হিসাব আসলে কেবল “difference” নয়। এটি একটি মানচিত্র। কোথায় ভুল করলে ২১৪ বছর লাগে শোধরাতে, আর কোথায় ঐক্য করলে ২৬৬ দিন-ই যথেষ্ট হয় ভাগ্য বদলাতে। এই বিষয় যদি এখনো বুঝতে সমস্যা হয়, তাহলে জাতি হিসেবে আমাদেরকে হয়তো আরো কঠিন অন্ধকারে পড়তে হতে পারে। সামনে নতুন কোনো বেনিয়ার দল ওৎ পেতে আছে। তাই বাংলা মাকে সুস্থ রাখতে, নিরাপদ রাখতে, নতুন কোনো হায়েনার দলের থাবা থেকে বাঁচাতে, আমাদের ঐক্যের কোনো বিকল্প নাই।
ইতিহাস শেষ পর্যন্ত কি বলে?
ইতিহাস শেষ পর্যন্ত একটিই কথা বলে— স্বাধীনতা একদিনের অর্জন নয়, প্রতিদিনের দায়িত্ব।
যখন জাতি নিজের সঙ্গে লড়াইয়ে ব্যস্ত থাকে, তখন বাইরের শত্রুকে আর যুদ্ধ করতে হয় না—সে শুধু অপেক্ষা করে। সুযোগের অপেক্ষা। সময়মতো কোপ মারে।
পলাশীর আম্রকানন আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান—এই দুই প্রান্তের মাঝখানেই দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ। এক পাশে বিভাজনের স্মৃতি, অন্য পাশে ঐক্যের সম্ভাবনা।
আজকের বাংলাদেশ আবার হচ্ছে অস্থির। বাহির থেকে কেউ এসে হয়তো সরাসরি শাসন করবে না, কিন্তু ভেতরের দুর্বলতা, বিভক্তি আর আত্মস্বার্থ আবারো নতুন বেনিয়াদের জন্য দরজা খুলে দিবে। এই নতুন বেনিয়ারা অদৃশ্য, তারা হয়তো ইংরেজ নয়, হয়তো বাণিজ্য কোম্পানির পতাকা হাতে নেয় না, কিন্তু তাদের কৌশল একই—ভাগ করো, শাসন করো, বিভেদের বীজ রোপন করো।
১৭৫৭ আর ১৯৭১—এই দুই সময়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে বাঙালির ইতিহাস। একদিকে বিভাজনের ফলে সর্বনাশ, অন্যদিকে ঐক্যের শক্তিতে মুক্তি। প্রশ্ন একটাই—আজকের বাংলাদেশ কোন পথ বেছে নেবে?
যদি আবারো আমরা নিজেদের গৃহবিবাদে জড়িয়ে পরি, ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। কারণ ইতিহাস বারবার সতর্ক করে, কিন্তু পথ দেখিয়ে হাত ধরে টেনে নেয় না। পলাশীর শিক্ষা ভুলে গেলে, রমনার চেতনা ধারণ না করলে—স্বাধীনতা কাগজে থাকবে, বাস্তবে নয়।
তাই সময় এখনো আছে। পলাশী থেকে রমনা পর্যন্ত যাত্রার মানে বুঝে নেওয়ার।
ইতিহাস হাত ধরে টানে না।
সংখ্যা কাঁধে চাপ দেয় না।
জ্যোতিষ ভয় দেখায় না।
তারা শুধু নীরবে, বারবার একটি কথাই মনে করিয়ে দিতে চায়—
শুধু ফিসফিস করে একটি কথাই বলে— সাধু সাবধান।
- অধ্যাপক ড. মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা সম্পাদক, আমাদের অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com)
#মুক্তিযুদ্ধ #বিজয়দিবস #বাংলাদেশ #একাত্তর #১৬ডিসেম্বর #স্বাধীনতারস্বপ্ন #জাতীয়আদর্শ #স্বাধীনতা #পলাশী #রমনা #ইতিহাস #সতর্কবার্তা #সাধুসাবধান #VictoryDay #Bangladesh #1971 #PalashiToRamna