12/22/2025 বাঙালির আজব সামাজিকতা: আচারের হাঁড়ি, লোকদেখানো আভিজাত্য ও হাইব্রিড সংস্কৃতি আর আত্মার অন্দরমহল
odhikarpatra
২২ December ২০২৫ ১৭:৪৬
—সম্পাদকীয় ফিচার | আমাদের অধিকারপত্র
“বাঙালির সামাজিকতা”—শব্দবন্ধটির মধ্যেই লুকিয়ে বাঙালির সামাজিকতা মানেই যেন এক হাঁড়ি আচার—টক, ঝাল আর আবেগের মিশ্রণ। আড্ডা, প্রতিবেশী প্রেম থেকে শুরু করে আইফোন ও হাইব্রিড সংস্কৃতির এই নিরাভরণ চালচিত্রটি পড়ুন।
আছে এক বয়াম ভর্তি আচারের মতো বিচিত্র স্বাদ। কখনো তা জিভে জল আনা টক, কখনো ঝাল, আবার কখনো এক চিমটে অহং-এর মিষ্টি প্রলেপ। সমাজ নামক এই বিশাল হাঁড়িতে প্রতিদিনই কেউ না কেউ নাড়াচাড়া করছে—কেউ আবেগের চিনি বাড়াচ্ছে, কেউ বাড়াচ্ছে পরচর্চার ঝাল, আবার কেউবা মেশাচ্ছে হালকা “গুজবের গুঁড়ো”। তবু, সেই হাঁড়ির গন্ধে বাঙালি আজন্ম টান অনুভব করে। কারণ, এই আজব ও বিচিত্র চরিত্রই বাঙালির টিকে থাকার মূল মন্ত্র।
প্রতিবেশী সমাজ: জানালার ওপারেও আত্মীয়তার উঁকি
বাঙালির অভিধানে ‘ব্যক্তিগত গোপনীয়তা’ বা ‘প্রাইভেসি’ শব্দটির অস্তিত্ব প্রায় নেই বললেই চলে। “আমাদের হাড়িতে আজ কী রান্না হচ্ছে”—এই খবর গৃহকর্ত্রীর জানার আগেই পাশের বাড়ির ‘খালাম্মা’ জেনে যান। তিনতলার কারো অসুখ হলে নিচতলা পর্যন্ত সেই খবর বাতাসের বেগে পৌঁছায়। শুধু তাই নয়, কে হাসপাতালে নিয়ে যাবে, কে ফল কিনবে, আর কে শুধু দাঁড়িয়ে থেকে ‘বিনামূল্যে পরামর্শ’ দেবে—তা মুহূর্তেই নির্ধারিত হয়ে যায়।
বাঙালির জানালায় গ্রিল থাকে বটে, কিন্তু দৃষ্টির কোনো সীমানা থাকে না। জানালার পাশে কাপড় শুকাতে গিয়ে অন্যের সংসারের খুঁটিনাটি জেনে নেওয়া, কিংবা জানালা খুলেই “কী রান্না করছো গো?” বলে মহাদেশীয় কূটনীতি শুরু করা—এ যেন আমাদের সহজাত প্রবৃত্তি।
চা, আড্ডা ও ‘জাতির বিবেক’
বাঙালির আড্ডা হলো এক অদ্ভুত দার্শনিক প্রথা। রাস্তার মোড়ের টং দোকানটিই এখানে একইসাথে সংসদ ভবন, সুপ্রিম কোর্ট এবং থেরাপি সেন্টার। ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ হাতে ঝড় ওঠে তর্কে।
একজন বিজ্ঞের মতো শুরু করেন, “দেখেছ ভাই? ওরা ছেলের বিয়েতে পাঁচতলা হোটেল ভাড়া করেছে!”
দ্বিতীয়জন তৎক্ষণাৎ রায় দেন, “আরে রাখো! আমরা হলে ওসব দেখতাম না, সব লোক দেখানো!”
এভাবেই দুই ঘণ্টা কেটে যায়, চা ঠান্ডা হয়ে শরবত হয়, কিন্তু তাদের সমাজতাত্ত্বিক গবেষণার উত্তাপ কমে না।
ভালোবাসার ট্র্যাজেডি: আবেগ বনাম আইফোন ১৭
বাঙালির সামাজিক নাটক শুধু রাস্তায় নয়, অন্দরমহলেও নিয়মিত মঞ্চস্থ হয়। ভালোবাসা আর বস্তুবাদী চাহিদার দ্বন্দ্বে তৈরি হয় অদ্ভুত সব পরিস্থিতি। একটি দৃশ্যকল্প ভাবা যাক:
স্ত্রী আবদারের সুরে ডাকলেন, “জানু!”
স্বামী গদগদ হয়ে উত্তর দিলেন, “বলো আমার রানী।”
স্ত্রী: “তুমি তো ঈদে গিফট দিতে চেয়েছিলে। আমার জান দিতে হবে না, শুধু একটা আইফোন ১৭ কিনে দাও।”
স্বামী মহোদয় থমকে গিয়ে তার এক মোবাইল ব্যবসায়ী বন্ধুকে ফোন করলেন। ওপাশ থেকে বন্ধু যখন আইফোন ১৭-এর দাম জানালেন, তখন ‘জানু’র প্রেমিক সত্তা কর্পূরের মতো উবে গেল। হাত থেকে ফোন খসে পড়ল, তিনি প্রায় মূর্ছা গেলেন।
জ্ঞান ফেরার পর স্ত্রীর সেবা-শুশ্রূষায় চোখ মেলে স্বামীর করুণ আরজি, “আমার জানু, আইফোন না, তুমি বরং নোকিয়া নাও, ওটাই টেকসই!”
এই হাস্যরসাত্মক ঘটনাটি আসলে আমাদের সমাজেরই প্রতিচ্ছবি। সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে ‘শো-অফ’ করা বা নিজেকে জাহির করার প্রবণতা আমাদের রক্তে মিশে আছে।
‘শো-অফ’ (Show-off) এর সমাজতত্ত্ব: বাইরে ফিটফাট, ভেতরে সদরঘাট
বাঙালি সমাজে নিজেকে জাহির করা বা ‘শো-অফ’ এখন একটি শিল্পে পরিণত হয়েছে। মুখে বিনয় কিন্তু অন্তরে অহমিকা—এই দ্বিমুখী আচরণই এখনকার ট্রেন্ড। প্রত্যেকেই নিজেকে ‘মোড়ল’ ভাবেন এবং বাকিদের ভাবেন ‘প্রজা’।
পুরুষেরা দৌড়ায় গুজবের পেছনে—কার চাকরি গেল, কে প্রমোশন পেল, কার ছেলের রেজাল্ট খারাপ হলো—এই তথ্যের ভাণ্ডার তাদের নখদর্পণে। অন্যদিকে, অন্দরমহলে নারীদের একটি বড় অংশ ডুবে থাকেন ‘স্টার জলসা’ বা ‘জি বাংলা’র কৃত্রিম ড্রামায়। সিরিয়ালের কুটকচালি যেন বাস্তব জীবনের রিহার্সাল। সবাই সব বোঝে, সবাই সব জানে, কিন্তু দিনশেষে সবাই ভাবে, “তালগাছটা আমার”। অন্যের সুখে অংশীদার হওয়ার চেয়ে অন্যের কৃতিত্ব নিজের বলে চালিয়ে দেওয়ার প্রবণতাই এখানে প্রবল।
সম্পর্কের জট ও আধুনিকতার জগাখিচুড়ি
বাঙালির আত্মীয়তার সমীকরণ এক জটিল জ্যামিতি। “মায়ের বড়বোনের জায়ের ভাইপোর শালার বিয়াইনের কাকার ছেলে”—এমন সম্পর্কও আমাদের সমাজে গুরুত্বপূর্ণ এবং তাদের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। এই জালের ভেতরেই গড়ে ওঠে বাঙালির পারস্পরিকতা—যা কখনো হাস্যকর, কিন্তু দিনশেষে গভীর মানবিক।
তবে এই ধরণের আত্মীয়তার মোহ বাঙালির অনেক রথি মহারথির জন্যই যুগে যুগে সর্বনাশ ডেকে এনেছে। ক্ষমতাশীনরা আত্মীয় নামে অন্ধ হয়ে অযোগ্য মানুষে ভরসা করে ছাগল দিয়েই গায়ের জোরে হাল চাষ করতে চেয়েছে! ফলাফল হয়েছে যা অনুমেয়! তাই দেখা যায় বিধাতার নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর জন্য এই ঠুনকো বন্ধন মানুষকে বিপথে চালিয়েছে, এখনো চালায়, এবং ভবিষ্যতেও চালাবে।
ন্যায়ের জান্ডা নামিয়ে স্বজনপ্রীতির প্রশ্নবিদ্ধ পতাকা উড়ানোর এই আজব সংস্কৃতি যেনো দিনে দিনে আরো কঠিনভাবে চেপে বসছে।লতা-পাতায় জড়ানো এই মহান সম্পর্কের জেরে অনেক যোগ্য লোকের চোখের পানিতে বঙ দেশের আকাশ বাতাশ ভারি হয়েছে। অযোগ্য বা জুনিয়রের কাছে সুপারসিড হয়ে সারাজীবনের সততা যোগ্যতাকে প্রশ্ন করেছে? শুধু ক্ষমতাশীনদের এই প্যাঁচানো সম্পর্কই আজ উচ্চ চেয়ারে বসার এক বিশেষ যোগ্যতা হয়ে দাঁড়িয়েছে!।
তবে প্যাঁচানো জিলাপীর মতো এই অতি মানবিক সম্পর্কও খুব আজব রীতিতে চলে। কখনো বকুল ফুলের মতো সুতীব্র সুভাষ ছড়ায়, আবার কখনো কর্পূরের মতো উড়ে যায়। মানুষ ভুলে যায়, সুসময়ে অনেক আত্মীয় জন্ম নেয়, কিন্তু হায়! অসময়ে তাদের টিকিটাও দেখতে পাওয়া যায় না। তবে এই কিউট বাঙালি সব বুঝলেও তেলের কাছে সবসময়্ই যেনো ধরা খায় বা খেতে চায়!
ভাড়াটে সংস্কৃতি ও ‘বাংলিশ’ আভিজাত্য
তবে ইদানীং আমাদের সামাজিকতার ‘বাংলো’য় অদ্ভুত সব ‘হাইব্রিড কালচার’ বা সংকর সংস্কৃতি এসে বাসা বেঁধেছে। আগে ছিল পাড়ার রক বা চণ্ডীমণ্ডপের আড্ডা, এখন জায়গা করে নিয়েছে ‘ভার্চুয়াল স্ট্যাটাস’।
মাতৃভাষা বাংলার সঙ্গে অহেতুক ইংরেজি মেশানো এখন স্মার্টনেসের মাপকাঠি। “আরে ব্রো, তোর আইডিয়াটা তো খুব ক্রিয়েটিভ! চল এই উইকএন্ডে চিল করি!”—এ ধরণের কথাবার্তা শুনে মনে হয় তারা কোনো ভাষা পরীক্ষার ‘মিশ্রণ’ অংশের উত্তর দিচ্ছেন। বাংলা বলাটা যেন অনেকের কাছেই এখন ‘ক্ষেত’ বা কম মর্যাদার!
অনলাইন ভোজন ও হারিয়ে যাওয়া স্বাদ
সন্ধ্যায় মুড়ি-চানাচুর কিংবা জিলিপির বদলে এখন রাজত্ব করছে ফুড ডেলিভারি অ্যাপ। মায়ের হাতের রান্নার চেয়ে এখন রেস্তোরাঁর ‘রেটিং’ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এক ক্লিকেই খাবার হাজির হয় বটে, কিন্তু সেই খাবারে মায়ের হাতের মমতা বা বাড়ির রান্নার সেই চিরচেনা ঘ্রাণ থাকে না। সামাজিকতা এখন স্ক্রিনবন্দি, আর আন্তরিকতা আটকে গেছে ইমোজির ভিড়ে।
শেষ কথা: আজব হলেও আপন
এই সব ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ, গুজব, লোকদেখানো আভিজাত্য আর হাইব্রিড সংস্কৃতির নিচেও বাঙালির একটি উষ্ণ মানবিক হৃদয় আছে। বাঙালি অদ্ভুত, কিন্তু এই আজব সমাজব্যবস্থাই তার আত্মার রসদ। এখানে মানুষ একা বাঁচে না, অন্যকে নিয়ে বাঁচে, অন্যের জীবনের গল্প হয়ে বাঁচে।
কিন্তু ভয়ের বিষয় হলো, বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসনে আমাদের সেই শেকড় আলগা হয়ে যাচ্ছে কি না। যে ‘হাইব্রিড কালচার’ জীবনকে সহজ করছে, তা কি আমাদের সহজ-সরল আনন্দগুলো কেড়ে নিচ্ছে না? তবুও আমরা হাসি, কারণ জীবন থেমে থাকে না। কেবল হাসি-ঠাট্টার আড়ালে নিজের কাছে প্রশ্নটা থেকেই যায়—আমরা কি আধুনিক হচ্ছি, নাকি শেকড়হীন হচ্ছি?
(আপনার মতামত আমাদের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান। কমেন্ট বক্সে জানান আপনার ভাবনা। তবে অনুরোধ—বিনা কারণে রিলস বা অপ্রাসঙ্গিক ভিডিও শেয়ার করবেন না!)
- ড. মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা সম্পাদক, আমাদের অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com)
#BengaliCulture #CulturalShift #BengaliHeritage #SocialCritique #FeatureStory #HybridCulture #AmaderOdhikarPatra #BengaliSociety #DeshiAunties #PrivacyMyth #Bangladesh