12/24/2025 কামড়াকামড়ির মহোৎসব ও ‘উত্তম’ হওয়ার বিড়ম্বনা: একটি উত্তর-আধুনিক ব্যবচ্ছেদ
Dr Mahbub
২৪ December ২০২৫ ১৫:৩৩
—বিশেষ সম্পাদকীয় ফিচার
কেউ খারাপ ব্যবহার করলে পাল্টা খারাপ ব্যবহার করা মানুষের শোভা পায় না। আধুনিক সমাজে নিজেকে 'উত্তম' মানুষ হিসেবে ধরে রাখতে এবং রাগের মুহূর্তে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে রাখতে অনুসরণ করুন এই ১০টি বাস্তবসম্মত আচরণবিধি। জীবনবোধ ও মনস্তত্ত্বের সমন্বয়ে তৈরি এই চেক-লিস্টটি আপনার মানসিক শান্তি ও ব্যক্তিত্বের আভিজাত্য বজায় রাখতে গ্যারান্টিসহ কাজ করবে।
সকালবেলা চায়ের কাপে চুমুক দিতেই খবরের কাগজের পাতায় চোখ আটকে গেল। শিরোনাম: “সামান্য কথা কাটাকাটি থেকে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ”। খবর পড়ে জানা গেল, এক প্রতিবেশী অন্য প্রতিবেশীর গাছের ডাল কাটতে গিয়ে ঝগড়া শুরু করেছিলেন। শেষমেশ পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, উভয়েই এখন হাসপাতালে এবং পুলিশি মামলার জালে বন্দি। খবরটি পড়ার সময় বারবার কানে বাজছিল শৈশবে পড়া সেই পঙক্তি — “কুকুরের কাজ কুকুর করেছে কামড় দিয়েছে পায় / তা বলে কুকুরে কামড়ানো কিরে মানুষের শোভা পায়?”
আজকের এই দ্রুতগামী, উচ্চরক্তচাপের যুগে আমাদের চারপাশটা যেন একটা বড়সড় ‘কামড়াকামড়ির’ আখড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা সবাই যেন ওত পেতে আছি—কে কাকে কখন একটা ‘কামড়’ দেব, অর্থাৎ কার অপমানের বদলে ডবল অপমান ফিরিয়ে দেব। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সেই অমোঘ প্রশ্ন— “তুমি অধম তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?”—আজ যেন আমাদের সমাজ থেকে নির্বাসনে গেছে।
সমসাময়িক কামড়াকামড়ির সবচেয়ে বড় মঞ্চ হলো সোশ্যাল মিডিয়া। ফেসবুক বা এক্স-এর (সাবেক টুইটার) নিউজফিডে স্ক্রল করলে দেখা যায়, কেউ একজন হয়তো কোনো বিষয়ে নিজের মত প্রকাশ করেছেন। ব্যাস, অমনি একদল ‘অধম’ প্রকৃতির মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ল আক্রমণাত্মক মন্তব্য নিয়ে। গালিগালাজ, ব্যক্তিগত আক্রমণ আর চরিত্রের ব্যবচ্ছেদ—সবই চলছে অবলীলায়।
সবচেয়ে ট্র্যাজিক ব্যাপার হলো, যার ওপর আক্রমণ হলো, তিনিও তখন ভাবেন— “ও আমাকে গালি দিল, আমি যদি পালটা গালি না দেই, তবে তো আমার মান থাকবে না!” এই যে ‘মান রাখা’র চক্কর, এখানেই মানুষ তার ‘উত্তম’ সত্তা হারিয়ে ফেলে। কুকুরের কাজ ঘেউ ঘেউ করা বা কামড়ানো, কিন্তু মানুষ যদি সেই কুকুরের সাথে পালটা ঘেউ ঘেউ শুরু করে, তবে দূর থেকে দর্শক বুঝতে পারে না—আসলে কুকুর কে আর মানুষ কে!
সেদিন দেখলাম এক বিখ্যাত লেখকের পোস্টে একজন অত্যন্ত নোংরা ভাষায় মন্তব্য করেছেন। লেখক পাল্টা গালি না দিয়ে শুধু লিখলেন, “আপনার রুচি আপনার মন্তব্যে প্রকাশ পেয়েছে, আমার শুভকামনা রইল।” এই একটা বাক্য ওই আক্রমণকারীকে যতটা ধরাশায়ী করেছে, একশটা গালিও তা পারত না। এটাই হলো ‘উত্তম’ হওয়ার তেজ।
রাস্তার ট্রাফিক জ্যাম এখন শুধু গাড়ির জট নয়, মানুষের মেজাজেরও জট। সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বিরক্তি যখন চরমে, তখন যদি পেছন থেকে কেউ অযথা হর্ন দেয় বা পাশ থেকে রিকশার চাকা আপনার পায়ে লাগিয়ে দেয়, তখনই শুরু হয় আসল কুস্তি।
আমার পরিচিত এক ছোটভাই, নাম তার রাহাত। রাহাত এমনিতে খুব শান্ত, কিন্তু সেদিন রাস্তায় এক সিএনজিওয়ালার সাথে তার যা তুমুল ঝগড়া হলো, তা দেখে আমি থ। সিএনজিওয়ালা তাকে একটা কুরুচিপূর্ণ কথা বলেছিল, আর রাহাত তার জবাবে সিএনজির গ্লাস ভাঙতে উদ্যত হলো। আমি তাকে সরিয়ে এনে বললাম, “রাহাত, ও তো অশিক্ষিত বা কুশিক্ষিত হতে পারে, কিন্তু তুই তো শিক্ষিত। ও বিষ ঢালছে বলে তোকেও কি বিষাক্ত হতে হবে?”
রাহাত কিছুক্ষণ পর শান্ত হয়ে বলল, “ভাই, আসলে ইগোতে লেগে গিয়েছিল।” আমাদের এই ‘ইগো’ বা অহংবোধই আমাদের অধমের স্তরে নামিয়ে আনে। আমরা ভুলে যাই যে, কাঁদা নিয়ে খেললে শরীরটা কিন্তু নিজেরই নোংরা হয়।
অফিস আদালত বা কর্পোরেট জগতেও এই ‘কামড়’ সংস্কৃতি বেশ প্রকট। সহকর্মী আপনার নামে বসের কাছে আজেবাজে কথা লাগিয়েছেন? আপনিও ভাবলেন, এবার তার প্রোমোশন কীভাবে আটকানো যায় সেই ফন্দি আঁটবেন। আপনি যখন অন্যের ক্ষতি করার জন্য ফন্দি আঁটছেন, তখন আপনি আর তার মধ্যে পার্থক্য কী থাকল?
বঙ্কিমবাবুর সেই ‘উত্তম’ হওয়ার দর্শনটা এখানে সবচেয়ে বেশি দরকার। কেউ অধম হয়ে আপনার গীবত করছে মানেই সে আপনার চেয়ে নিচে অবস্থান করছে। আপনি যদি তার লেভেলে নেমে পাল্টা গীবত শুরু করেন, তবে আপনি স্বেচ্ছায় আপনার উঁচু স্থানটি ছেড়ে নিচে নেমে গেলেন।
একজন সফল মানুষ তিনি নন যিনি সবার কামড়ের পাল্টা জবাব দেন, বরং তিনি—যিনি অন্যের ছুড়ে দেওয়া পাথর দিয়ে নিজের সাফল্যের সিঁড়ি তৈরি করেন।
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, মানুষ যখন অরক্ষিত বোধ করে বা হীনম্মন্যতায় ভোগে, তখনই সে অন্যের ওপর আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। অন্যের নীচতার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিজে নীচ হওয়া এক ধরনের মানসিক ফাঁদ। আমরা ভাবি প্রতিবাদ না করলে লোকে আমাদের ‘দুর্বল’ ভাববে।
কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী দেয়, মহৎ মানুষরা কখনোই অন্যের গালিতে গাল মেলাতেন না। সক্রেটিসকে যখন প্রকাশ্য দিবালোকে এক ব্যক্তি লাথি মেরেছিল, তিনি কিছুই বলেননি। তার অনুসারীরা যখন ক্ষুব্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করল আপনি চুপ কেন? তিনি শান্তভাবে বলেছিলেন, “একটা গাধা যদি আমাকে লাথি মারে, তবে আমি কি তাকে পাল্টা লাথি মারব? নাকি তাকে আদালতে নিয়ে যাব?”
এই যে নিজেকে উচ্চতর অবস্থানে রাখা, এটাই হলো ব্যক্তিত্বের আসল আভিজাত্য।
উত্তম হওয়াটা সহজ কাজ নয়। যখন কেউ আপনাকে বিনা কারণে অপমান করছে, তখন শান্ত থাকাটা পাহাড় টপকানোর চেয়েও কঠিন। এর জন্য প্রয়োজন প্রবল ইচ্ছাশক্তি আর আত্মবিশ্বাস।
উত্তম হওয়ার উপকারিতা কী?
আমরা কীভাবে এই ‘উত্তম’ হওয়ার পথে হাঁটতে পারি? ১. পজ (Pause) নেওয়া: কেউ কিছু বললে সাথে সাথে উত্তর না দিয়ে ১০ সেকেন্ড সময় নিন। দেখবেন রাগের প্রথম ঢেউটা কেটে গেছে। ২. উপেক্ষা করতে শেখা: সব কথার উত্তর দিতে নেই। কিছু কিছু মানুষের অস্তিত্বই উপেক্ষা করা উচিত। ৩. নিজের মানদণ্ড ঠিক করা: আমার ব্যবহার কেমন হবে তা আমি ঠিক করব, অন্য কেউ নয়। কেউ খারাপ ব্যবহার করল মানেই আমার রিঅ্যাকশন খারাপ হবে—এই চেইনটা ভাঙতে হবে।
এই সুদীর্ঘ আলোচনার পর, আমি অধিকারপত্রের পাঠকদের জন্য একটি সংক্ষিপ্ত ‘চেক লিস্ট’ বা ‘আচরণবিধি’ নিচে তুলে ধরলাম, যা রাগের মাথায় আপনাকে ‘উত্তম’ থাকতে সাহায্য করবে। গ্যারান্টি ১০০ ভাগ। তাই রাগের মাথায় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে ‘উত্তম’ মানুষ হিসেবে ধরে রাখার জন্য নিচের বাস্তবসম্মত ‘মানসিক চেক-লিস্ট’ বা ‘আচরণবিধি’ মেনে চলুন। এটি আপনি আপনার ফোনের নোটবুকে বা ডায়েরিতে লিখে রাখতে পারেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিবেন।
১. ১০ সেকেন্ডের বিরতি (The 10-Second Rule): কারো কটু কথা শুনে সাথে সাথে উত্তর দেবেন না। মনে মনে ১ থেকে ১০ পর্যন্ত গুনুন। এই সামান্য সময়টুকু আপনার মস্তিষ্ককে ‘আবেগ’ (Emotion) থেকে সরিয়ে ‘যুক্তি’ (Logic) দিয়ে ভাবতে সাহায্য করবে।
২. জায়গা পরিবর্তন করুন: যদি দেখেন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাচ্ছে, তবে সেই স্থানটি সাময়িকভাবে ত্যাগ করুন। এক গ্লাস ঠান্ডা জল পান করুন। হাঁটাচলা করলে শরীরের জমে থাকা নেতিবাচক এনার্জি বের হয়ে যায়।
৩. নিজের মানদণ্ড মনে রাখুন: নিজেকে নিজে প্রশ্ন করুন— “ওই ব্যক্তি যা করছে তা তার পরিচয়, কিন্তু আমি পাল্টা যা করব তা কি আমার পরিচয়ের সাথে মানানসই?” মনে রাখবেন, আপনি ‘উত্তম’ হওয়ার ব্রত নিয়েছেন।
৪. নিঃশ্বাসের ব্যায়াম: খুব রাগ হলে লম্বা করে নাক দিয়ে শ্বাস নিন এবং মুখ দিয়ে ধীরে ধীরে ছাড়ুন। এটি আপনার স্নায়ুকে শান্ত করবে এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করবে।
৫. উপেক্ষা করতে শিখুন (Power of Ignoring): সব কথার জবাব দিতে নেই। কিছু মানুষের অজ্ঞতা বা নীচতাকে করুণা করতে শিখুন, ঘৃণা নয়। মনে মনে বলুন, “উনি উনার স্বভাব দেখাচ্ছেন, আমি আমার আভিজাত্য দেখাই।”
৬. শব্দ চয়নে সতর্কতা: এমন কোনো শব্দ মুখ দিয়ে বের করবেন না যা পরে ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। মনে রাখবেন, গায়ের ক্ষত শুকিয়ে যায়, কিন্তু কথার ক্ষত আমৃত্যু থেকে যায়।
৭. আইনি বা যৌক্তিক প্রতিবাদ: উত্তম হওয়া মানে কিন্তু অন্যায় সহ্য করা নয়। যদি কারো আচরণ সীমা লঙ্ঘন করে, তবে চিল্লাপাল্লা না করে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানান বা আইনি ব্যবস্থা নিন। শান্ত থেকে প্রতিবাদ করাটা অনেক বেশি শক্তিশালী।
৮. ডিজিটাল ডিটক্স: সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনো কমেন্ট দেখে রাগ হলে সাথে সাথে রিপ্লাই দেবেন না। ফোনটি সরিয়ে রাখুন। কয়েক ঘণ্টা পর দেখবেন সেই বিষয়টি নিয়ে আপনার আর অতটা রাগ হচ্ছে না।
৯. হাস্যরসের আশ্রয় নিন (Humor): পরিস্থিতিটাকে রম্য বা মজার ছলে দেখার চেষ্টা করুন। মনে মনে ভাবুন, “আহা, লোকটা কী সুন্দর করে মুখ ভেংচে ঝগড়া করছে, ঠিক যেন অ্যানিমেটেড সিনেমার ভিলেন!” হাসি রাগ কমিয়ে দেয়।
১০. দিনশেষে ক্ষমা: ঘুমানোর আগে ওই দিনের সমস্ত তিক্ততা মন থেকে মুছে ফেলুন। কাউকে ক্ষমা করা মানে তাকে জিতে যেতে দেওয়া নয়, বরং নিজের মনকে শান্ত রাখা।
পরিশেষে, আমাদের মনে রাখা দরকার যে, পৃথিবীটা এমনিতেই অস্থিরতায় ভরপুর। এখানে আমরা যদি একে অপরকে কামড়াতে শুরু করি, তবে শেষ পর্যন্ত সবাই ক্ষতবিক্ষত হয়েই পড়ে থাকব।
কুকুর কামড় দিলে মানুষ যদি পাল্টা কুকুরকে কামড়াতে যায়, তবে হাসিখোরাকি বাদে আর কিছুই জোটে না। তেমনি, নীচ মনের মানুষের সাথে পাল্লা দিয়ে নিজেকে নিচে নামানোটা স্রেফ বোকামি। আমরা অধম নই, আমরা উত্তম হতে চাই। কারণ দিনশেষে আমাদের পরিচয় আমাদের কর্মে ও ব্যবহারে।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আজ বেঁচে থাকলে হয়তো বলতেন, “আমি তো উত্তম হওয়ার কথা বলেছিলাম, তোমরা দেখি অধম হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছ!” আসুন, সেই প্রতিযোগিতা থেকে বেরিয়ে আসি। অন্যকে বদলে দেওয়ার আগে নিজের ভেতরের ‘উত্তম’ সত্তাটাকে একটু জাগিয়ে তুলি। জগতটা এমনিতেই অনেক সুন্দর হয়ে উঠবে।
শেষ উপদেশনা:
বঙ্কিমচন্দ্রের সেই শিক্ষাটি সবসময় মনে গেঁথে রাখুন। “সে অধম হতে পারে, কিন্তু আমি কেন আমার শ্রেষ্ঠত্ব হারাব?” এই ছোট ছোট অভ্যাসগুলো আপনাকে কেবল একজন শান্ত মানুষ হিসেবেই নয়, বরং একজন সত্যিকারের শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে গড়ে তুলবে।
(আপনার মতামত আমাদের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান। কমেন্ট বক্সে জানান আপনার ভাবনা। তবে অনুরোধ—বিনা কারণে রিলস বা অপ্রাসঙ্গিক ভিডিও শেয়ার করবেন না!)
বি.দ্র. আগামী কাল থেকে পড়ুন অধিকারপত্র ধারাবাহিক সম্পাদকীয় বিশেষ কলাম (Odhikarpatra Editorial Feature Column Series) “'পথিক, তুমি কি আসলেই পথ হারাইয়াছো?”
- ড. মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা সম্পাদক, আমাদের অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com
#CulturalShift #BengaliHeritage #SocialCritique #FeatureStory #HybridCulture #AmaderOdhikarPatra #LifeLessons #AngerManagement #SelfControl #PersonalityDevelopment #SocialAwareness #PositiveThinking #উত্তম_মানুষ #রাগ_নিয়ন্ত্রণ #জীবনবোধ #অধিকারপত্র #সুস্থ_সমাজ