12/25/2025 বেথলেহেমের ধুলোমাখা পথ থেকে আজকের বৈষম্যপূর্ণ পৃথিবী: বড়দিনের আসল তাৎপর্য
Dr Mahbub
২৫ December ২০২৫ ১৩:৫৪
শুভ বড়দিন।
কুয়াশামাখা ডিসেম্বর। হিমেল হাওয়া আর শিশিরভেজা ঘাসের ওপর যখন ভোরের প্রথম আলো এসে পড়ে, তখন পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে বেজে ওঠে আনন্দের সুর। আজ বড়দিন। যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন। গির্জায় গির্জায় ক্যারল গান, বাড়িতে বাড়িতে ক্রিসমাস ট্রি, আর কেক কাটার ধুম। ওপর থেকে দেখলে মনে হয়, পৃথিবীটা যেন আজ এক বিশাল উৎসবের মঞ্চ।
কিন্তু এই উৎসবের জৌলুস আর নিওন আলোর ঝলকানি কি সত্যিই ছুঁতে পারছে পৃথিবীর সব মানুষের হৃদয়? নাকি এই আলোকসজ্জার ঠিক নিচেই ঘাপটি মেরে বসে আছে এক বিশাল অন্ধকার? আজকের এই বড়দিনে দাঁড়িয়ে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে দুই হাজার বছর আগের সেই জরাজীর্ণ গোয়ালঘরটির দিকে, আর মেলাতে হবে আজকের এই বিভক্ত পৃথিবীর হিসাব-নিকাশ।
ইসলামের দৃষ্টিতে বড়দিন: হযরত ঈসা (আ.)-এর পবিত্র স্মৃতি ও মানবতার বার্তা
শীতের নীরব এক সকালকে ঘিরে ইতিহাসের পাতায় জ্বলজ্বল করে ওঠে এক পবিত্র স্মৃতি। বড়দিন খ্রিস্টানদের কাছে যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন হিসেবে পরিচিত হলেও, ইসলামের দৃষ্টিতে এই দিনটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় আল্লাহর প্রেরিত এক মহান রাসূল—হযরত ঈসা (আ.)-এর কথা। কুরআনে তাঁর জন্মের অলৌকিক ঘটনা বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে বর্ণিত হয়েছে, যেখানে পবিত্র মারইয়াম (আ.)-এর ধৈর্য, ঈমান ও আল্লাহর ওপর অটল ভরসার কথা উঠে আসে। ইসলামে হযরত ঈসা (আ.) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল; তিনি মানুষকে একত্ববাদে বিশ্বাস, ন্যায়পরায়ণতা এবং আত্মশুদ্ধির পথে আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাঁর জীবন ছিল অহংকারহীন, দুনিয়ার মোহ থেকে মুক্ত, একান্তভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রয়াসে নিবেদিত।
আল্লাহ হযরত ঈসা (আ.)-এর ওপর নাযিল করেছিলেন আসমানী কিতাব ইঞ্জিল, যা ছিল সত্য, করুণা ও নৈতিকতার আলোকবর্তিকা। এই কিতাব মানুষকে দয়া, ক্ষমা ও মানবিকতার শিক্ষা দেয়—যা ইসলামের মৌলিক আদর্শের সঙ্গেও গভীরভাবে সঙ্গতিপূর্ণ। ইসলামে হযরত ঈসা (আ.) শুধু একজন নবীই নন, তিনি আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন, ধৈর্য ও তাকওয়ার প্রতীক। তাই এই দিনটি কেবল একটি ঐতিহাসিক স্মরণ নয়; এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে শান্তি, সহমর্মিতা ও আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আনুগত্যই সকল যুগে মানুষের প্রকৃত মুক্তির পথ।
তাই বড়দিন ইসলামের দৃষ্টিতে কোনো উৎসব না হলেও, এটি এক মহান নবীর স্মরণ, যাঁর জীবন ও বার্তা মানবজাতিকে আল্লাহর পথে ফিরে আসার আহ্বান জানায়। এই স্মৃতি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে ধর্মের মূল উদ্দেশ্য বিভেদ সৃষ্টি নয়, বরং মানুষকে শান্তি, সহনশীলতা ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত করা। হযরত ঈসা (আ.)-এর জীবন তাই আজও মুসলমানদের কাছে ঈমান, ধৈর্য ও মানবতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
সেই নক্ষত্রম্লান গোয়ালঘর এবং মুক্তির বার্তা
গল্পটা আমাদের সবার জানা। রোমক সাম্রাজ্যের প্রতাপ তখন তুঙ্গে। বেথলেহেমে কোনো সরাইখানায় ঠাঁই হয়নি আসন্নপ্রসবা মেরির। শেষমেশ আশ্রয় মিলল এক গোয়ালঘরে। সেখানেই, খড়কুটার বিছানায় জন্ম নিলেন যিশু। কোনো রাজপ্রাসাদে নয়, জাঁকজমকপূর্ণ কোনো হাসপাতালেও নয়—ঈশ্বরের পুত্র এলেন সমাজের সবচেয়ে নিচু তলার মানুষ, মেষপালক আর দিনমজুরদের কাতারে। “তিনি এলেন দীনহীন বেশে, যাতে দীনেরা তাঁকে আপন করে নিতে পারে।”
বড়দিনের মূল সুরটিই এখানে—বিনীত ভালোবাসা এবং সাম্য। যিশু আজীবন লড়াই করেছেন শোষিত, নিপীড়িত আর সমাজের প্রান্তিক মানুষের জন্য। তাঁর বার্তা ছিল ভালোবাসার, ক্ষমার এবং ভাগের। তিনি শিখিয়েছিলেন, নিজের খাবারের ভাগ ক্ষুধার্তকে না দিলে ঈশ্বরের আরাধনা পূর্ণ হয় না।
আজকের পৃথিবী: উৎসব বনাম বাস্তবতা
কিন্তু আজকের বড়দিন কি সেই সাম্যের বার্তা বহন করছে? আমরা যখন উৎসবের আনন্দে মাতোয়ারা, তখন পৃথিবীর মানচিত্রের দিকে তাকালে বুক কেঁপে ওঠে। একদিকে উন্নত বিশ্বের শপিং মলগুলোতে ক্রিসমাস সেলের উন্মাদনা, উপহারের পাহাড়; অন্যদিকে ফিলিস্তিন, ইউক্রেন, সুদান বা ইয়েমেনের বিধ্বস্ত জনপদে শিশুদের আর্তনাদ। বেথলেহেমে, যেখানে যিশুর জন্ম, আজ হয়তো সেখানেও বারুদের গন্ধে ভারী হয়ে আছে বাতাস। যে যিশু ছিলেন ‘শান্তির রাজপুত্র’ (Prince of Peace), তাঁর জন্মভূমিতেই আজ শান্তির বড় আকাল।
আজকের গ্লোবাল ভিলেজে বৈষম্য এক প্রকট রূপ নিয়েছে। এক শ্রেণীর মানুষের কাছে বড়দিন মানে দামী ওয়াইন আর পাঁচতারকা হোটেলের বুফে ডিনার। আর পৃথিবীর বিশাল এক জনগোষ্ঠীর কাছে বড়দিন মানে—আরেকটি ক্ষুধার্ত দিন, আরেকটি অনিশ্চিত রাত। শরণার্থী শিবিরগুলোতে যখন শিশুরা শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে, তখন আমরা হয়তো ব্যস্ত আমাদের ক্রিসমাস ট্রি-টি কত দামী আলো দিয়ে সাজানো যায়, সেই ভাবনায়।
আমাদের বাংলাদেশ: আলো ও আঁধারের ব্যবধান
বৈশ্বিক এই বৈষম্যের ঢেউ থেকে আমাদের প্রিয় স্বদেশও মুক্ত নয়। বাংলাদেশে বড়দিন একটি সর্বজনীন উৎসবের আমেজ নিয়ে আসে ঠিকই, কিন্তু এর ভেতরের চিত্রটি বড়ই করুণ। শহরের অভিজাত পাড়াগুলোতে বড়দিনের পার্টির চাকচিক্য চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। কেকের দাম যেখানে হাজার টাকা ছাড়িয়ে যায়, সেখানে ফুটপাতের ধারে শুয়ে থাকা শীতার্ত মানুষটি হয়তো ১০ টাকার একটা রুটিও জোগাড় করতে পারেনি।
আমাদের দেশে এখন অর্থনৈতিক টানাপড়েন চলছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস। এক প্যাকেট ভালো কেক বা সন্তানদের জন্য নতুন জামা কেনা অনেকের জন্যই এখন বিলাসিতা। তবুও মানুষ হাসে, উৎসব করে। কিন্তু এই হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকে দীর্ঘশ্বাস। চা-বাগানের শ্রমিক কিংবা উত্তরবঙ্গের হাড়কাঁপানো শীতে কষ্ট পাওয়া মানুষগুলোর কাছে বড়দিনের আনন্দ কি আদৌ পৌঁছায়?
শহরের গির্জাগুলো যখন রঙিন আলোয় সেজে ওঠে, ঠিক তার পাশেই কোনো এক পথশিশু হয়তো ছেঁড়া চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছে। এই যে বৈপরীত্য, এই যে ব্যবধান—এটাই আজকের বড়দিনের সবচেয়ে বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন।
আসল বড়দিন কোথায়?
তবে কি বড়দিন উদযাপন করা ভুল? না, মোটেও না। উৎসব মানুষের মনকে বিশাল করে, মানুষকে কাছে টানে। কিন্তু বড়দিনের সার্থকতা তখনই, যখন আমরা গোয়ালঘরের সেই শিশুটির প্রকৃত শিক্ষা ধারণ করতে পারি। বড়দিন মানে কেবল নিজেকে সাজানো নয়, বরং অন্যের মুখে হাসি ফোটানো। যিশু বলেছিলেন, “তোমরা যা আমার এই ভাইদের মধ্যে অতি ক্ষুদ্রতম একজনের প্রতি করেছ, তা আমারই প্রতি করেছ।”
যে যিশু ছিলেন 'শান্তির রাজপুত্র', তাঁর পৃথিবীতেই আজ যুদ্ধের দামামা। গাজা থেকে ইউক্রেন—শিশুদের আর্তনাদ কি আমাদের উৎসবে পৌঁছায়? আসুন প্রার্থনায় রাখি তাদের, যারা আজ উৎসবহীন, গৃহহীন। আজকের এই বৈষম্যপূর্ণ পৃথিবীতে বড়দিন আমাদের কাছে একটি ‘চ্যালেঞ্জ’ নিয়ে আসে:
শেষ কথা ও প্রত্যাশা
ক্রিসমাস ট্রি-র নিচে রাখা উপহারের চেয়ে অনেক বেশি দামী উপহার হলো—সহমর্মিতা। আসুন, এবারের বড়দিনে আমরা জৌলুসের প্রতিযোগিতায় না নেমে, অন্তরের আলো জ্বালি। বেথলেহেমের সেই নক্ষত্রটি যেন আমাদের পথ দেখায়—ভোগের পথে নয়, ত্যাগের পথে; ঘৃণার পথে নয়, ভালোবাসার পথে।
বেথলেহেমের সেই জরাজীর্ণ গোয়ালঘর আর আজকের নিওন আলোয় সাজানো শহর—মাঝখানের ব্যবধানটা কি আমরা ঘুচাতে পেরেছি? যিশু এসেছিলেন দীনহীন বেশে, আর আমরা আজ ব্যস্ত বিলাসিতায়। উৎসব হোক, তবে তা যেন দেয়াল না তুলে সেতু বন্ধন তৈরি করে। যিশুর জন্ম হয়েছিল গোয়ালঘরে, প্রাসাদে নয়। বড়দিনের সার্থকতা তাই জৌলুসে নয়, সহমর্মিতায়। আলো জ্বলে উঠুক অন্তরে, কেবল বাইরে নয়। আর এই দিনে ভোগের পথে নয়, আসুন ত্যাগের পথে হাঁটি। আপনার উৎসবের বাজেট থেকে সামান্য কিছু বাঁচিয়ে কোনো শীতার্ত মানুষকে উষ্ণতা দিন, কোনো এতিম শিশুকে একবেলা ভালো খাবার দিন। ওটাই হবে আপনার সেরা বড়দিনের উপহার।
পৃথিবীর সমস্ত জরাজীর্ণতা মুছে যাক, বড়দিন হয়ে উঠুক বৈষম্যহীন এক নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন।
শুভ বড়দিন।
- ড. মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা সম্পাদক, আমাদের অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com)
#বড়দিন #ChristmasEditorial #যিশুখ্রিস্ট #হযরতঈসা #মানবতা #সহমর্মিতা #ধর্মীয়সম্প্রীতি #বৈষম্যবিরোধী #PeaceNotWar #Bethlehem #PrinceOfPeace #ইসলামওবড়দিন #EditorialBangla #SocialJustice #ChristmasMeaning