12/28/2025 শর্টকাট গন্তব্য: আমরা আসলে যাচ্ছিটা কই?
Dr Mahbub
২৮ December ২০২৫ ০২:২৯
এই ব্যঙ্গাত্মক সাহিত্য-নিবন্ধে আমরা খুঁজে দেখেছি, কীভাবে "শর্টকাট সাকসেস", "ইনস্ট্যান্ট লাইফস্টাইল" ও "হামবড়া ভাব" আমাদের সমাজ, রাজনীতি, মূল্যবোধ ও সম্পর্ককে খণ্ড-বিখণ্ড করে দিচ্ছে। ব্যঙ্গ-রসবোধে মোড়ানো এক আত্মসমালোচনার রম্যচিত্র।
শুরুতেই একটা সিরিয়াস প্রশ্ন করি। আচ্ছা, আপনি শেষ কবে সময় নিয়ে, যত্ন করে, মশলা কষিয়ে রান্না করা খাবার খেয়েছেন? মনে করতে পারছেন না তো? পারার কথাও না। কারণ, আমরা এখন 'ইনস্ট্যান্ট' প্রজন্মে বসবাস করছি। দুই মিনিটে নুডলস সেদ্ধ হয়ে যায়, আর পাঁচ মিনিটে আমরা জীবন সাজিয়ে ফেলতে চাই। কষ্ট? ওরে বাবা! ওটা তো অভিধানে 'ক' এর পাতায় থাকে, আমাদের জীবনে নয়। আমরা চাই শর্টকাট। শ্রম না দিয়েই যদি হিমালয়ের চূড়ায় ওঠা যায়, তবে কষ্ট করে ট্রেকিং সু (জুতো) পরার দরকার কী?
আরেকটি গুরুতর প্রশ্ন—আপনি শেষ কবে নিজের হাতে ভাজা লুচির সাথে মায়ের হাতে বানানো আলুর দম খেয়েছিলেন? সে কি মায়ের গন্ধমাখা ঘরে একটুখানি অপেক্ষার মুহূর্ত ছিল? নাকি এখন সবকিছুই ফুড অ্যাপে চাপ দিয়ে গরমাগরম প্লাস্টিক মোড়ানো দুনিয়া? আমাদের সময়টা এখন ‘লুচি নয়, শুধু লোভে ফুলকপি খাওয়া’ সময়। দুই মিনিটে চা, তিন মিনিটে সম্পর্ক, পাঁচ মিনিটে আত্মজয়। এই হল আমাদের ইনস্ট্যান্ট যুগ।
"কষ্ট" নামক শব্দটা এখন শুধু বাংলা অভিধানের পাতায় আছে, বাস্তবে তা তামাশার জিনিস। আমাদের বর্তমান দর্শন: “যদি হিমালয় দেখা যায় গুগল ইমেজে, তবে কষ্ট করে কেন ট্রেক করব?”
আজকের এই রম্য রচনায় আসুন একটু খুঁজি, এই শর্টকাট আর 'হামবড়া' ভাব নিয়ে আমরা আসলে কোন গর্তের দিকে এগোচ্ছি।
মানসিক বিকৃতি ও সাফল্যের রেসিপি
আমাদের দর্শন এখন খুব সহজ—"পরিশ্রম ছাড়াই উন্নতি"। ব্যাপারটা অনেকটা এমন যে, জিমে ভর্তি হব, কিন্তু ডাম্বেল তুলবে আমার ট্রেইনার, আর মাসল ফুলবে আমার। রান্না করার ধৈর্য আমাদের নেই, তাই ইনস্ট্যান্ট ফুডই ভরসা। ঠিক একইভাবে জীবনের সব ক্ষেত্রেই আমরা 'রেডিমেড' চাই। পড়াশোনা না করেই জিপিএ-৫, কাজ না করেই প্রমোশন।
এখানেই লুকিয়ে আছে এক ভয়ংকর বীজ। আমরা যখন অন্যের কষ্ট দেখে মানসিক শান্তি পাই, তখন বুঝতে হবে আমাদের সফটওয়্যারে বড় কোনো গোলমাল আছে। অন্যের বিপদে আমরা এখন এগিয়ে যাই না, বরং পপকর্ন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে দেখি আর ভাবি, "আহ! যাক বাবা, বাঁশটা আমি খাইনি, ও খেয়েছে।" আমরা কষ্ট করতে চাই না, শুধু পরিতৃপ্তি চাই।
আজকাল উন্নতি মানেই শর্টকাট। কেরামতি করতে পারলেই সব জয়। আমাদের মনে হয়, জিমে ভর্তি হলেই পেট সিক্স-প্যাক হবে। ডাম্বেল তুলবে ট্রেইনার, কিন্তু চেহারা হবে আমার মতো হিরো। পরিশ্রম ব্যথা দেয়, ধৈর্য সময় নেয়—তাই আমরা দুটোকেই "বিপজ্জনক" মনে করি। এই যে অলসতা-কেন্দ্রিক চিন্তা, তাতে মানসিকভাবে একটা বিষ বুনে যাচ্ছে। এখন আমরা আর সহমর্মী হই না, বরং ফেইসবুকে “Sad” রিয়্যাক্ট দিয়ে বলে ফেলি, “ওরে! ভাগ্যিস এটা আমার সাথে হয়নি।” এক ধরণের আত্মতৃপ্ত পৈশাচিক আনন্দ তৈরি হয়েছে অন্যের দুর্দশায়। আমরা যেন এখন একেকজন 'ফিল্টার লাগানো ফটোগ্রাফার', বাস্তবতা আমাদের সহ্য হয় না। তাই আমরা 'রেডিমেড লাইফ' চাই, যেখানে ‘ব্রেকআপের ব্যথা’ও হালকা করে দেয় কোনো ইনফ্লুয়েন্সারের চটজলদি মোটিভেশনাল পোস্ট।
তালগাছটা শুধুই আমার!
আমাদের সমাজের বর্তমান স্লোগান হলো—"অন্য যাই বলুক ভাই, তালগাছটা আমার।" আমাদের 'আমিত্ব' এখন এতই বিশাল যে, এর ছায়ায় আর কেউ দাঁড়াতেই পারে না। নিজেকে আমরা একেকজন স্বঘোষিত 'মহাবীর' ভাবি। ভাবটা এমন—"আমি কি ডরাই সখি ভিখারি রাঘবে?" অর্থাৎ, আমি ছাড়া এই দুনিয়ার বাকি সবাই ভিখারি, সবাই তুচ্ছ। আমি হলাম হামবড়া (অহংকারী)। যেন আমি একাই বিশ্বজয় করে ফেলব।
আসলে আমিত্ব এমন জায়গায় পৌঁছেছে, যেখানে দল, পরিবার, বন্ধুত্ব—সবই বাম হাতের কাজ। আমি আছি, সেটাই যথেষ্ট। এই ভাব যেন চারিদিকে বাতাসে ভাসছে। সেলফি তুলতে গিয়ে পেছনে পড়ে যাওয়া মানুষটাকে আমরা তুলতে যাই না, কারণ আমাদের অ্যাঙ্গেল নষ্ট হয়! আমরা এখন নিজের ছায়াতেও ঈর্ষান্বিত হই। কেউ একটু এগিয়ে গেলে বলি, “দ্যাখ, কোন লাইনে উঠে গেছে! নিশ্চয়ই ঘুষ দিয়েছে।” আমরা আর কাউকে প্রশংসা করতে পারি না, কারণ আমাদের চোখে সবাই চোর, শুধু আমি-ই সততার প্রতিমূর্তি!
উন্নত দেশ গড়ব, মানবিক সম্পর্ক মজবুত করব—এসব শুনতে খুব ভালো শোনায়। কিন্তু এফোর্ট বা শ্রম কে দেবে? ওটা তো আমি দেব না। আমরা নিজের ওপরে গিয়ে ভাবতেই পারি না।
সম্পর্ক যখন 'অপশন' মাত্র!
এবার আসি সম্পর্কের বাতিঘরে। মানবিক বাঁধন? ওসব এখন জাদুঘরে রাখার জিনিস। তাই অপরের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমরা শ্রম কম দিই। আমাদের নীতি হলো—"একজন কষ্ট পেয়ে দূরে গেছে? হু কেয়ারস! ১০ জন লাইনে দাঁড়িয়ে আছে।" আমাদের কাছে মানুষ এখন আর মানুষ নয়, শুধুই 'অপশন'। আসলেই সম্পর্ক এখন অপশন! হ্যাঁ, আমাদের কাছে ভালোবাসা একটা “ট্রায়াল ভার্সন।” না মানালে আনইন্সটল করে ফেলি। বন্ধুত্ব? সেটা এখন ইনবক্সের “Seen” হয়ে পড়ে থাকে।
“কে কষ্টে আছে?” —“তো কী? আমার লাইফ তো চলছে মজা করে!” এই ভাবনা আমাদের হৃদয়ের সফটওয়্যারকে ভাইরাসে ভরিয়ে দিচ্ছে। সম্পর্ক মানেই এখন 'সর্বোচ্চ সুবিধা, সর্বনিম্ন দায়বদ্ধতা'। পড়ন্ত বিকেলে মা ফোন করলেন, বললেন—“তুই আসবি কবে?” আমরা বলি—“ব্যস্ত আছি মা, জুম মিটিং।” আসলে মিটিং নয়, নেটফ্লিক্সে সিরিজ চলছে!
আমরা এখন মানি (Money)-কে 'সেকেন্ড গড' বা দ্বিতীয় ঈশ্বর বানিয়ে ফেলেছি। পকেটে টাকা থাকলে নীতি-নৈতিকতার কী দরকার? ওসব তো পবিত্র কিতাবে সাজিয়ে রাখার জিনিস। বাস্তবে ওসবের ভ্যালু নেই। আমরা নিজের আমিত্ব জাহির করতেই ব্যস্ত, তাৎক্ষণিক সুখের পেছনে ছুটছি। কে কী ভাবল, তা তো আমার দেখার বিষয় না!
বিষেও ভেজাল, হায়রে কপাল—ভয়াবহ বাস্তবতা!
সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি? মরার ক্ষেত্রেও এখন ঠকছি!
সবচেয়ে মজার (এবং কষ্টের) ব্যাপার হলো আমাদের ঠকানোর প্রবণতা। কয়েক দশক আগেও মানুষ যা ভাবতে পারত না, এখন তা ডালভাত। বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, এখন তো আত্মহত্যা করতে গিয়েও মানুষ শান্তিতে মরতে পারে না। কারণ? কারণ বিষেও ভেজাল! ভেজাল খেয়ে মরতে গিয়ে দেখা যায় উল্টো গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। হায়রে সমাজ! আর কত নিচে নামব আমরা?
আত্মহত্যা করতে গিয়ে অনেকেই হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন—কারণ বিষেও ভেজাল! আগে মানুষ মরার পর সমাজ কাঁদতো, এখন বলছে—“আহা, ভালোই হইছে, লোড কমলো।” সামাজিক ট্র্যাজেডি এখন ‘কমেডি কনটেন্ট’। কেউ অপমানিত হলে, আমরা হাসি। কেউ ব্যর্থ হলে, বলি—“সে তো পারবেই না!” এ এক বিপজ্জনক ট্রেন্ড যেখানে অন্যের কষ্ট আমাদের বিনোদন।
আদর্শের নিলাম ও এমপি হওয়ার 'শর্টকাট'
ছোটবেলায় ভাবসম্প্রসারণে পড়েছিলাম—"ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়"। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ওটা ছিল ভুল সিলেবাস। বর্তমান প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে দেখছি—'দলের চেয়ে ব্যক্তি বড়, আর এমপিগিরি সবার বড়।' দেশে আসলে হচ্ছেটা কী? ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে নেতারা এখন নিজের দলটাকেই সেকেন্ড-হ্যান্ড মার্কেটপ্লেসে বিক্রি করে দিচ্ছেন।
নির্বাচনের বৈতরণী পার হতে ছোট দলের শীর্ষ নেতারা সুটকেস গুছিয়ে বড় দলে ভিড়ছেন, প্রয়োজনে নিজের আজন্মের দলকে বিলুপ্ত ঘোষণা করছেন। একেই বলে সত্যিকারের 'শর্টকাট সাকসেস'! প্রশ্ন জাগে, ভাই আপনাদের সেই পাহাড়সম আদর্শ গেল কই? নাকি আদর্শও এখন 'সিজনাল ফ্রুট'—নির্বাচন এলেই পাকে, আর পাস করলেই পচে যায়? এমপি হওয়ার এই ইঁদুর দৌড়ে আদর্শ এখন সাইডবেঞ্চে বসে বাদাম খাচ্ছে।
রাজনৈতিক শর্টকাট এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে নেতা সকালে এক দলে, বিকেলে আরেক দলে। দলের আদর্শ কি?—“দরকার থাকলে থাকবে, না থাকলে ওটাও ট্র্যাশ!” ছোট দলগুলো এখন 'বিগ বাজেট প্রজেক্ট'–এর মতো—সময় এলেই বন্ধ করে, বড় দলের প্রলোভনে পা রাখে। যেন মিনি সিজনাল ফল, নির্বাচনের মৌসুমে পাকে, পরে পচে। রাজনীতি এখন 'হালাল' পদ্ধতিতে নয়, বরং 'হাতের গরম' দিয়ে হয়। দেশসেবার নামে চলছে নিজের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার গেম।
আয়নায় মুখ দেখার সময় হয়েছে
আমরা কি আয়নায়স আমাদের চবি দেকছি? সবসময় অপরের দোষ কুজে ফিরছি। আসলে বিষয়টিা খুব ভয়ঙ্কর সহজ—আমরা আসলে কোথাও যাচ্ছি না, বরং ঘুরছি গোলকধাঁধার ভেতরে, এক নিঃসঙ্গ চিপস প্যাকেটের মতোই—বহিরঙ্গ চকচকে, ভেতরে ফাঁপা। আমরা ছুটছি। হ্যাঁ, খুব দ্রুত ছুটছি। কিন্তু কিসের দিকে? না মূল্যবোধ, না সম্পর্ক, না সেবামূলক কাজ। শুধু নিজস্ব আমিত্ব, অর্থ, স্বার্থ আর ইনস্ট্যান্ট খুশির পেছনে ছুটছি। “শর্টকাট”-এ আমরা হাঁটছি, কিন্তু দিক হারিয়েছি।
ভবিষ্যতে যখন আমাদের সন্তানরা প্রশ্ন করবে—“তোমরা কী রেখে গেলে?” আমরা হয়তো বলব—“আমরা তোমাদের একখানা WiFi ছেড়ে গেছি, পাসওয়ার্ড: Ego123!”
আমরা আসলে যাচ্ছিটা কোথায়? উত্তরটা খুব সহজ। আমরা একটা গোলকধাঁধায় দৌড়াচ্ছি। খুব দ্রুত দৌড়াচ্ছি, কিন্তু কোথাও পৌঁছাচ্ছি না। নিজের 'আমিত্ব', লোভ আর শর্টকাট খোঁজার নেশায় আমরা মানবিক সম্পর্কগুলোকে চিপসের প্যাকেটের মতো সস্তা বানিয়ে ফেলেছি।
এখনো সময় আছে একটু আয়নায় নিজের চেহারাটা দেখার। নিজের ওপর গিয়ে ভাবার। তা না হলে, এই 'শর্টকাট' পথ ধরে আমরা এমন এক গন্তব্যে পৌঁছাব, যেখানে গিয়ে দেখব—সেখানেও কোনো নেটওয়ার্ক নেই, আর ফেরারও কোনো পথ নেই। সেখানে থাকবে শুধু একটি সাইনবোর্ড— “নেটওয়ার্ক নাই, ফিরতি পথও নাই।”
এখনো সময় আছে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের দিকে ফিরে তাকানোর। আমাদের এই শর্টকাট সংস্কৃতি, আমাদের হামবড়া ভাব, আর অপার্থিব ‘ইনস্ট্যান্ট’ আকাঙ্ক্ষাগুলোকে একটু প্রশ্ন করার সময় এসেছে। না হলে, একদিন আমরা এমন এক গন্তব্যে পৌঁছে যাব, যেখানে থাকবে না কোনও GPS, থাকবে না কোনো মানুষ—শুধু থাকবে একাকীতা আর আফসোস। অতএব, জীবনকে রেডিমেড করতে গিয়ে যদি মানবিকতা, প্রেম, বন্ধুত্ব, শ্রদ্ধা আর নৈতিকতা ভুলে যাই—তাহলে গন্তব্য কিন্তু আর 'গন্তব্য' থাকবে না।
(আপনার মতামত আমাদের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান। কমেন্ট বক্সে জানান আপনার ভাবনা। তবে অনুরোধ—বিনা কারণে রিলস বা অপ্রাসঙ্গিক ভিডিও শেয়ার করবেন না!)
- প্রফেসর ড. মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা সম্পাদক, আমাদের অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com)
#শর্টকাটগন্তব্য #রম্যসাহিত্য #InstantSociety #BanglaSatire #অহংকার #ShortcutCulture #SocialCritique #HumorousFeature #RelationshipCrisis #MoralCollapse #PoliticalSatire