11/21/2025 ধর্মের নামে ব্যবসা বনাম আল্লাহর সতর্ক বাণী: কোরআনের পথে বিবেকের জাগরণে শান্তির আলো, না কি লোভের লালসালু?
Dr Mahbub
২১ November ২০২৫ ০৯:৪৩
এই নিবন্ধটি ডিজিটাল গুজব, ধর্মের নামে ব্যবসা আর মানুষের বিবেকজাগরণকে কোরআনের আয়াত, বাংলা সাহিত্য ও গ্রামবাংলার গল্পের ভেতর দিয়ে নতুন করে দেখার এক ছন্দময় ফিচার আখ্যান। ধর্মের নামে যখন কেউ সত্য আড়াল করে, ক্ষমতার লোভে কোরআনের ভাষ্য বিকৃত করে, তখন প্রয়োজন আল্লাহর নির্দেশনায় বিবেককে জাগিয়ে তোলা। এই লেখায় বিশ্লেষণ করা হয়েছে কীভাবে ধর্মব্যবসার মুখোশের আড়ালে চলছে মিথ্যার কারবার, আর কেন কোরআনের আয়াতে রয়েছে এর প্রতিরোধের দিকনির্দেশনা—সত্য, সচেতনতা ও মানবতার আলোয় গড়ে তোলার এক জরুরি আহ্বান।
একদিন প্রথম আলো ভোরে, গ্রামের পুরনো শস্যচাষী রফিক দাদা হাঁটছিলেন মাঠের বীজবপনের পর। ধানের সারি যত দীর্ঘ, আয়াম তত গভীর—উঁচু পাতার ফাঁকে হালকা বাতাস সরে যায়। হঠাৎ, সেই বাতাস এমন এক শব্দ নিয়ে এল—“ধর্মের কল বাতাসে নড়ে।”
রফিক দাদা থেমে দাঁড়ালেন। তিনি বুঝলেন—এটা শুধু পাতা দুলানোর শব্দ নয়; বিবেকের এক নিঃশব্দ শ্লোগান। বিস্ময়ে তিনি স্মৃতিতে ফিরলেন—যুবক কালে সে শুনেছিল, “সত্যকে ধারণ কর, বিবেককে জাগ্রত কর, আর আলোর পথে অটল থাকিয়া সমাজকে রক্ষা কর।”
এবার সেই বাক্য যেন কানে পড়ছে, মাঠের ধানের সারিতে গান হয়ে।
গ্রামের নাম ধরুন আলোরডাঙা। নামের মধ্যেই আলো, তবু আজ সেখানে খানিক অন্ধকার জমে আছে। সন্ধ্যার আজানের পরপরই মসজিদের মাইকে কোরআনের তিলাওয়াত, আর সেই সঙ্গে পাশের দোকানে মোবাইলের স্ক্রিনে ফেসবুক লাইভ। একদিকে সুরা রহমানের মায়াময় ধ্বনি, অন্যদিকে উত্তেজিত কণ্ঠে কেউ বলে উঠছে, “দেখছেন না, অমুক সম্প্রদায়ের লোকজন নাকি আমাদের ধর্ম নিয়ে কটূ কথা বলেছে!” দোকানের ভেতর বসা অষ্টম শ্রেণির ছাত্র তুহিন আর তার বাবা, স্কুলশিক্ষক আব্দুল্লাহ, দুই প্রজন্মের দুই ধরনের দৃষ্টি নিয়ে সেই লাইভ দেখে। তুহিনের চোখে আগুন, আব্দুল্লাহর চোখে সংশয়। দোকানের বাইরে বাতাসে তালগাছ দুলছে। আব্দুল্লাহ মনে মনে পুরোনো প্রবাদটি আওড়ান, যেন বাতাসও সেই কথার সুরে নড়ে ওঠে, “ধর্মের কল বাতাসে নড়ে।” মনে হয়, শুধু কলই নড়ে না, মানুষের বিবেকও একটু একটু করে কেঁপে ওঠে।
গুজবের আগুন, সমাজের ঘাসের মাঠ
তুহিন বলে, “আব্বা, যদি সত্যি এমন কথা বলে থাকে, তবে চুপ থাকা ঠিক না। কিছু করা উচিত।” আব্দুল্লাহ ছেলেকে শান্ত চোখে দেখে বললেন, “বাবা, আগুন কি দেখে কখনও জ্বলে? শুকনো ঘাস পেলেই দাউ দাউ করে ওঠে। গুজবও তেমন। একবার বিশ্বাসের মাঠে আগুন ধরলে, সত্য মাটি খুঁজে পায় না।” তারপর তিনি ধীরে ধীরে মোবাইলের স্ক্রিনটা পাশে রেখে বললেন, “হে মুমিনগণ! যদি কোনো ফাসিক ব্যক্তি তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ আনয়ন করে, তবে তোমরা তা যাচাই করে নাও, যাতে অজ্ঞতাবশত তোমরা কারো ক্ষতি না করে বসো” (সুরা হুজুরাত, ৪৯:৬) ।
এ নির্দেশনা শুধু ধর্মীয় আচরণ নয়—এটি একটি সার্বজনীন মানবিক নৈতিকতা। কারণ গুজব সমাজে অবিশ্বাস, হিংসা ও অস্থিরতা ছড়ায়। ইসলামের পাশাপাশি খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, হিন্দু—সব ধর্মেই মিথ্যা প্রচার ও অন্যকে বিভ্রান্ত করার বিরুদ্ধে সতর্কতা রয়েছে। হিন্দুধর্মে বলা হয়—“সত্যমেব জয়তে”—সত্যই শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়। বৌদ্ধধর্মে সম্যক বাক্যের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে—যেখানে মিথ্যা বা অপবাদ দেওয়া গুরুতর অনৈতিকতা। মানবতা ও মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকেও গুজব একপ্রকার সহিংসতা—কারণ এটি মানুষের নিরাপত্তা, মর্যাদা ও স্বাধীনতায় আঘাত হানে। ডিজিটাল যুগে তাই দায়িত্বশীল আচরণ শুধু ব্যক্তিগত মূল্যবোধ নয়—এটি সামাজিক কর্তব্য।
তুহিন একটু থেমে থাকে। কোরআনের আয়াত শুনলে সে চুপ করে যায়, ছোটবেলা থেকে এই শিক্ষা। আব্দুল্লাহ যোগ করেন, “দেখো, আল্লাহ খবর যাচাই না করে বিশ্বাস করতে মানা করেছেন। অথচ আমরা কী করি? ফেসবুকের শেয়ার বাটনে চাপ দিয়ে মিথ্যার আগুনকে আরও ছড়িয়ে দেই।” গুজব এখানে যেন অদৃশ্য আগুন, স্ক্রিন থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে যায় মানুষের হৃদয়ে, তারপর ঘরবাড়ি, মন্দির, মসজিদ, স্কুল, রাস্তা – সবকিছুই তার মধ্যে জড়িয়ে পড়ে।
ধর্মের বাগান অনেকটা রফিক দার গ্রামের পুকুরের মতো—শীতল, জীবনের আলো, শান্তির প্রতীক। কিন্তু মাঝে মাঝে, কেউ সেই পুকুরে আগাছা ফেলে দেয়—অবচেতনভাবে অথবা উদ্দেশ্য নিয়ে। ধীরে ধীরে পানি কুৎসিত হয়ে ওঠে। পাতার সাঁতারু মাছ হারিয়ে যায়। ঠিক তেমনই—যখন ধর্মের নামে কথাবার্তা পাওয়া যায় বিচারবুদ্ধি ছাড়া, অন্যের প্রতি সহমর্মিতা ছাড়া, সত্য যাচাই ছাড়া—তখন ধর্মের বাগানে আগাছা গজায়। ওই আগাছা হলো—গুজব, অপপ্রচার, অন্ধ অনুসরণ, নিজের স্বার্থে ধর্মব্যবহার। “শস্যের চেয়ে টুপি বেশি, ধর্মের আগাছা বেশি” — এই বার্তাটি যেন উপন্যাস লালসালু‑তে যেমন উঠে এসেছে।
রফিক দাদার ছোট ছেলে মারুফ এই বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। শহরে গিয়ে দেখেছে—ল্যাপটপ, সেল ফোন, তথ্যের স্রোত, এবং এক অদ্ভুত উৎসবময়তা—ধর্মীয় বক্তৃতা, ওয়াজ-মাহফিল, আড্ডা। কিন্তু এক সন্ধ্যায় সে হঠাৎ এমন প্রশ্ন করল— “আব্বা, ঈশ্বর কি বিলাসিতা চান? আমি দেখেছি ধর্মীয় বক্তার গাড়ি, বড় মঞ্চ, স্বর্ণালি আলোকসজ্জা—এগুলো কি ধর্মের আদর্শ?” রফিক দাদা প্রথমে নির্বাক। পরে বললেন— “মায়াস্বপ্ন নয়, মারু, সত্যই হলো—ধর্ম হলো মানুষকে মুক্ত করে, নয় দাস করে।” এই প্রশ্নই হলো নতুন প্রজন্মের সুর। তারা আরও বলছে— “মিথ্যার বিরুদ্ধে চুপ থাকা—সেটাই হয়তো বড় পাপ।” এভাবেই সামাজিক জাগরণ শুরু হয়েছে—চায়ের দোকান থেকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুম থেকে, অনলাইন চ্যাট থেকে।
ডিজিটাল নদী আর তথ্যের স্রোত: যেখানে সত্য ডুবে যেতে চায়
আলোরডাঙার পাশ দিয়ে ছোট্ট একটি নদী বয়ে গেছে। বর্ষাকালে নদী ফুলে ওঠে, শুকনো মৌসুমে স্রোত কমে যায়। আব্দুল্লাহ প্রায়ই ক্লাসে উদাহরণ দেন, “ইন্টারনেটও এক নদী। এই নদীতে তথ্য নামে নৌকা চলে। কেউ তাতে সত্য বোঝাই করে পাঠায়, কেউ মিথ্যা। তোমরা যদি দাঁড় টেনে দেখো না কোনটা কোন, তাহলে কখনও কখনও মিথ্যার নৌকাতেই উঠে বসবে।” কোরআন এদের সম্পর্কে আরেক জায়গায় বলে “যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতা বা অনাচার ছড়াতে চায়, তাদের জন্য আছে কঠিন শাস্তি” (সুরা নূর, ২৪:১৯)। এই অনাচার শুধু যৌন অনাচার নয়, সমাজে ফিতনা, গুজব, বিভাজন, বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়াও এর ভেতরে পড়ে। ফেসবুকের একটি পোস্ট যখন রাগ, ঘৃণা আর বিভাজন ছড়িয়ে দেয়, তখন তা যেন নদীতে বিষ ঢেলে দেওয়ার মতো। এক ঘাটের পানি আরেক ঘাটে পৌঁছাতে সময় লাগে না।
এক রাতের গুজব, এক গ্রামের নিঃশ্বাস
একদিন রাতের বেলায় হঠাৎ খবর ছড়িয়ে পড়ল, “গ্রামের পাশের পাড়ার লোকেরা নাকি কোরআন অবমাননা করেছে।” লোকেরা দলে দলে বেরিয়ে পড়ল। কারও হাতে লাঠি, কারও চোখে আগুন। তুহিনও বন্ধুদের সঙ্গে রওনা দিতে চাইলে, আব্দুল্লাহ তাকে থামিয়ে বললেন,“তুমি খবরটা নিজে দেখেছ?” উত্তরে প্রতিধ্বনিত হলো, “না।”। আবার প্রশ্ন: “কোনো নির্ভরযোগ্য মানুষ দেখেছে?” যথারীতি সেই একই উত্তর: “শুনেছি সবাই বলছে…”
আব্দুল্লাহ বললেন, “বাবা, যখন ‘সবাই বলছে’ শব্দটা বেশি শোনা যায়, তখন বুঝবে সেখানে গুজবের নাগাল আছে। সত্য নীরবে হাঁটে, গুজব দৌড়ে বেড়ায়।” সেই রাতে তিনি বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে আল্লাহর আরেকটি বাণী মনে করলেন “ফিতনা হত্যা থেকেও বড় অপরাধ” (সুরা বাকারা, ২:১৯১)। তিনি ভাবলেন, “যদি গুজবের ভিত্তিতে আমরা কাউকে পিটিয়ে মারি, তার ঘরে আগুন দেই, তার সন্তানদের ভয়ে কাঁপাই, তবে এই জুলুমের পাপ থেকে আমরা কেউ বাঁচব কীভাবে?” কিছু সময় পর সত্য বেরিয়ে এল। কোনো অবমাননা হয়নি, বরং কিছু ভিডিও কেটে মিথ্যা গল্প বানানো হয়েছিল। মানুষের মুখ শুকিয়ে গেল, কিন্তু ক্ষণিকের লজ্জা স্থায়ী অনুশোচনায় রূপ নিল না। কয়েকদিন পর তারা আবার নতুন গুজবের অপেক্ষা করতে লাগল।
নতুন প্রজন্মের ভিতরে এক নীরব বিক্ষোভ
তুহিন পরদিন তার ফেসবুক ওয়ালে লিখল, “ধর্মকে ভালোবাসি, কিন্তু ধর্মের নামে মিথ্যাকে নয়।” অনেকে তির্যক মন্তব্য করল, কেউ বলল সাহসী, কেউ বলল ‘অতিরিক্ত জ্ঞানী’। তবে কিছু তরুণ ইনবক্সে এসে লিখল, “ভাই, তুই যা লিখেছিস, আমরা মনে মনে অনেকদিন ধরে তাই ভাবছিলাম।” এই নীরব কথোপকথনই একদিন বড় ঢেউ হয়ে উঠবে, আব্দুল্লাহ জানেন। কোরআন এদেরই পক্ষে কথা বলে যারা মন, চোখ আর কানে চিন্তার দরজা খোলা রাখে। যারা মানবতার কথা ভাবে, শুধু নিজের দলের কথা না।
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত যেন কানে কানে বলে যান, “কালো আর ধলো বাহিরে কেবল, ভিতরে সবারই সমান রাঙা।” তুহিনের মনে হয়, পুরো গ্রামকে যদি এই এক লাইন মুখস্থ করিয়ে দেওয়া যেত, তবে হয়তো অনেক গুজবের আগেই লজ্জা পেত নিজে নিজে।
মাঠের বাতাস যেমন দ্রুত শস্যের সারি দুলিয়ে দেয়, ঠিক তেমনই তথ্য-প্রবাহ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু সেই তথ্য সত্য নয়তো মিথ্যা—ফারক করা জরুরি। কোরআনে বলা হয়েছে— “হে মুমিনগণ! যদি কোনো অবিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ আনয়ন করে, তাহলে যাচাই করো (… )” — সূরা হুজুরাত ৪৯ : ৬
— এই নির্দেশনা শুধু ধর্মীয় আচরণ নয়; এটি মানুষের বিবেককে জাগ্রত করার আহ্বান। যেমন একবার রফিক দাদা লাইভ খোঁজ পেলেন—এক ধর্মীয় বক্তার বক্তব্য ভুল ব্যাখ্যামূলক। তিনি সেভ করে রেখে দেন, বাড়ি ফিরে পড়েন যাচাই করে। ছোট ছেলে মারুফও পাশে বসে ‘সত্য-মিথ্যা’ গেম খেলতে লাগল। আর “জ্ঞান না থাকলে অনুসরণ করো না।” — এই আয়াত (সূরা বনী ইসরাঈল ১৭ : ৩৬) যেন নতুন প্রশ্নের সুরে বাজছে।
মাঠে রফিক দেখেছেন কিভাবে সাধারণ কৃষক ঘাম হাওয়ায় মেশিয়ে কাজ করেন, কিভাবে বিকালে ধান কেটে বাড়ি ফিরেন সন্তুষ্ট মুখে। তিনি মনেহল—মানুষ মানুষের জন্য। কোরআনে বলা হয়েছে— “আমি আদম সন্তানকে মর্যাদাবান করেছি।” — সূরা ইসরা ১৭ : ৭০
এটি শুধু ধর্মীয় আদেশ নয়; একটি মানবিক ঘোষণা। আর বাংলা কবিতায়—কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন— “গাহি সাম্যের গান—মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!” এভাবেই ধর্ম, মানুষ, ন্যায় ও করুণা এক হয়ে ওঠে। কাজী নজরুল ইসলামের উচ্চারণ আর কোরআনের ঘোষণা যেন একই নদীর দুই তীর, মাঝখানে মানবতার স্রোত বয়ে চলে।ৎ আব্দুল্লাহ ক্লাসে বুঝিয়েছিলেন, “দেখো, কোরআন বলে মানুষ মর্যাদাবান সৃষ্টি, নজরুল বলেন মানুষই শ্রেষ্ঠ। ধর্ম, বর্ণ, জাতি, দেশ সবকিছুর আগে আছে ‘মানুষ জাতি’। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তও লেখেন, ‘জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে, সে জাতির নাম মানুষ জাতি।’ তোমরা কেউ যেন ভুলে যেও না, গুজব যখন কাউকে টার্গেট করে, তখন সে প্রথমে মানুষকে আঘাত করে, তারপর ধর্মকে।” আজ দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি সেই ক্লাসের কথাই মনে মনে গুনগুন করেন।
সামগ্রিক মানবাধিকার ও ধর্মীয় নীতিতে মানুষের মর্যাদা রক্ষার গুরুত্ব
মানবাধিকারের মূলভিত্তি হলো—মানুষ মানুষের জন্য, এবং সকল মানুষ জন্মগতভাবেই মর্যাদা ও অধিকারসম্পন্ন। বিভিন্ন ধর্মেও মানুষকে “মর্যাদাবান সৃষ্টি” হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। কুরআনে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন: “আমি আদম সন্তানকে মর্যাদাবান করেছি।” (সুরা ইসরা ১৭:৭০)। অপরদিকে খ্রিষ্টধর্মে বলা হয়—মানুষ ঈশ্বরের প্রতিচ্ছবি। অন্যদিকে হিন্দুধর্মে—“অত্মা ব্রহ্ম”—সবাই একই সত্যের অংশ, এবং বৌদ্ধধর্মে বলা হয়—“সকল প্রাণী সমান।” —এই মানবিক দর্শনগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়—মানুষের বিরুদ্ধে অপমান, গুজব, বিদ্বেষ ছড়ানো শুধু আইনবিরোধী নয়, এটি মানবতারও বিরোধী। সমাজে শান্তি, শৃঙ্খলা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন মানুষের মর্যাদা রক্ষা, সহমর্মিতা ও দায়িত্বশীলতা।
ডিজিটাল যুগে দায়িত্বশীলতা—সবার জন্য এক নৈতিক কর্তব্য
তথ্যের গতি এখন অস্ত্রের চেয়েও দ্রুত। তাই গুজব রোধে প্রয়োজন— তথ্য যাচাই; দায়িত্বশীল আচরণ; ধর্মীয় ও মানবিক মূল্যবোধের চর্চা। ভেদাভেদ নয়, একতা ও সহমর্মিতা এবং সর্বোপরি—মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখা, কারণ মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, এবং—ৎসত্য, মানবতা ও ন্যায়—এই তিনেই সমাজের প্রকৃত শান্তি। গুজববিরোধী বার্তা, মানবাধিকার, ধর্মীয় নির্দেশনা, “লালসালু”–র উদ্ধৃতি, নজরুল ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা–—সবকিছু রেখে, সম্পূর্ণ ছন্দবদ্ধ ও কাব্যময় ভাষায় রূপান্তর করা হলো।ডিজিটাল যুগে আমাদের প্রতিনিয়তই মানুষ হওয়ার নতুন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হচ্ছে। খবর এখন তীরের মতো উড়ে যায়, গুজব আগুনের শিখা। তাই সত্যজ্ঞান, মানবতার মন্ত্র— সবাইকে আজই শেখা। ধর্ম শেখায়, সাহিত্য বলে— মানুষই সবার আগে, সত্য, ন্যায়, সহমর্মিতা—এই তিনেই সমাজের ভাগে, শান্তির সোনালি আলো জ্বলে, মানুষ মানুষকে ভালোবাসে, ঘুচে যায় বিভেদের কালে— এক মানবতার দুনিয়া হাসে।
ধর্মের প্রকৃত আলো: ভয় নয়, ভালোবাসা ও ন্যায়
একদিন মসজিদের বারান্দায় বসে গ্রামের কিছু মানুষ আলোচনা করছিল। এক ভদ্রলোক বললেন, “ধর্মের কথা বেশি বললে আবার কেউ কটূ কথা বলবে।” আব্দুল্লাহ শান্ত গলায় বললেন, “ধর্মের সত্য কথা বলতে ভয় নেই, ভয় আছে যখন ধর্মের নামে মিথ্যাকে লুকাতে চাই। মিথ্যার পক্ষে চুপ থাকা, সেটাই পাপ।” তিনি সবাইকে বললেন, “ধর্ম কখনও মানুষকে ছোট করার অস্ত্র না। বরং ধর্মের আসল চেহারা মানবতা, ন্যায়, করুণা আর সত্যের আলো। যে ধর্ম মানুষকে ভয় দিয়ে বশ মানাতে চায়, সে ধর্ম নয়, সে ক্ষমতার রাজনীতি।” তারপর তিনি সবার দিকে তাকিয়ে পড়লেন নিজের লেখা একটি ছোট্ট লাইন, “সত্যকে ধারণ কর, বিবেককে জাগ্রত কর, আর আলোর পথে অটল থাকিয়া সমাজকে রক্ষা কর।” বাতাসে যেন অদৃশ্য কিছু নড়ে উঠল। তালপাতার মতো কেঁপে উঠল মন।
অন্ধ আনুগত্যের শেকল, প্রশ্নের আলো
একদিন মজলিসে বসে গ্রামে একজন ভক্ত বলল,“হুজুর যা বলবে তাই ঠিক, আমরা কে যে প্রশ্ন করি?” আব্দুল্লাহ তখনও কিছু বলেননি, ফিরে এসে mushaf খুলে দেখেছিলেন এই আয়াতটি “জ্ঞান না থাকলে অনুসরণ করো না। নিশ্চয় শ্রবণ, দৃষ্টি ও হৃদয় – সবকিছুই জিজ্ঞাসিত হবে।” (সুরা বনী ইসরাঈল, ১৭:৩৬)। তার মনে হলো, প্রশ্ন না করেও পাপ হয়। অন্ধ আনুগত্য, অন্ধকারের আরেক নাম। পরের দিন ক্লাসে তিনি ছাত্রদের বললেন, “ধর্ম আপনাকে চিন্তা করতে শেখায়, ভয় পেতে নয়। যে ধর্ম শুধু ভয় দিয়ে আপনাকে চুপ করিয়ে রাখে, সেখানে কিছু একটা গড়বড় আছে।” তুহিন তখন হাতে খাতা নিয়ে লিখে রেখেছিল, “সত্যকে ধারণ কর, বিবেককে জাগ্রত কর, আর আলোর পথে অটল থাকিয়া সমাজকে রক্ষা কর।” সে জানত না, কয়েক বছর পর এই বাক্যই তার নিজের জীবনের পথনির্দেশ হবে।
একদিন মারুফকে স্কুল থেকে ফোন আসে—গ্রামে একটি ভুল ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে, মুসলমান–হিন্দু বিভেদকে উত্তেজিত করছে। পুকুরেরপাড়ের কিছু যুবক সেখানে গড়িয়ে পড়ল। রফিক দাদা দ্রুত বুঝলেন—এটা আগাছা নয়, আগুনের শিখা। কারণ গুজব শুধু বিভাজন করে না– এটি হয় এক ধ্বংসাত্মক আগুনের সূচনা। —আরি, এই আগুন দ্রুত ছড়ায়, ধারণা ছড়িয়ে পড়ে আত্মিকভাবে ও সামাজিকভাবে। রফিক দাদা বাড়ি ফিরে বললেন—“নিজ চোখে দেখো, নিজ কানে শুনো, তারপর বিশ্বাস করো, মিথ্যার শালিকায় নয়।”
‘লালসালু’র মজিদদের ছায়া: যখন শস্যের চেয়ে টুপি বেশি হয়
আলোরডাঙা গ্রামে একসময় এক ভণ্ড পীর ছিল। তার আস্তানার সামনে লাল কাপড় টানিয়ে রাখা, ভক্তরা সেখানে মাথা নত করত। সে আস্তানার অথরিটি, গ্রামবাসীর ভয় আর অন্ধবিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল। আব্দুল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় প্রথম সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘লালসালু’ পড়ে বুঝেছিলেন, এই গ্রামের ভণ্ড পীর আর উপন্যাসের মজিদ যেন একই ছায়া। সেখানে লেখা আছে, “শস্যের চেয়ে টুপি বেশি, ধর্মের আগাছা বেশি।” —কথাটি কৃষকের মাঠের মতো সহজ, অথচ মনের ভেতর কাঁটার মতো বিঁধে থাকে। শস্য মানে ধর্মের সত্য, টুপি মানে ধর্মের সাজসজ্জা, বাহ্যিক প্রদর্শন। আগাছা মানে ভণ্ডামি, ব্যবসা, বিভাজন। আজ সেই একই ছায়া তিনি দেখেন: ক) কোটি টাকার ওয়াজ মাহফিল; খ) অনুদানের নামে বিলাসবহুল গাড়ি; গ) গরিবের টাকার নামে তৈরি ব্যক্তিগত সাম্রাজ্য, এবং ঘ) লাইভে কাঁদা কণ্ঠ, পর্দার আড়ালে হিসাবের খাতা। কোরআন যেন আগেই বলে রেখেছে, “আল্লাহর আয়াত অল্প মূল্যে বিক্রি করো না” (সুরা বাকারা, ২:৪১)। আব্দুল্লাহ ভাবেন, “কত কম দামে বিক্রি করি আমরা আল্লাহর বাণী, একটু লাইকের দামে, একটু ফলোয়ারের দামে, একটু প্রভাব আর কিছু টাকার দামে।”
জাগরণ ও নতুন আলো: সত্যের পথে অটল থাকা
মারুফ শহরে ফিরে আসলে তার বন্ধুরা বলল—“ঈশ্বরের পথে কি প্রভাব নেই? আমরা দেখছি রাজনৈতিক রঙ, মুনাফা, ফরমালিটি।”
মারুফ ভাবল—হয়তো সত্য হলো একটু অন্যরকম: সত্য হলো মানবতা, ন্যায়, সহমর্মিতা। যেমন ধানের মাঠে সূর্য উঠলে অন্ধকার সরে যায়, ঠিক তেমনই— সত্য যদি ঠিকভাবে জাগ্রত হয়, মানুষ–মানবতা–ধর্মের মিলন হয়। রফিক দাদা বললেন—“সত্যকে ধারণ কর, বিবেককে জাগ্রত কর, আর আলোর পথে অটল থাকিয়া সমাজকে রক্ষা কর।”
গ্রামের শস্যতলা, শহরের সড়ক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুম—সবখানেই আজ যেন মিচিকানি করছে একটি নতুন হাওয়া। “ধর্মের কল বাতাসে নড়ে”—এটি এখন শুধু একটি প্রবাদ নয়; এটি সামাজিক বাস্তবতা। যেদিন আমরা সত্যকে বড় করে দেখি, ভেদাভেদ নয়, একতা করি, গুজবের আগাছা তুলে ফেলে দিই, সেদিনই সেই দিন হবে— যেদিন ধর্ম হবে মানুষের হৃদয়ের আলো, নায়কের কথা আলোরডাঙার ওপর দিয়ে যে বাতাস বয়ে যায়, তা এখন আগের চেয়ে বেশি সচেতন। মোবাইল ক্যামেরা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, মানুষের প্রশ্ন করার সাহস, কোরআনের বারবার করা সত্য যাচাইয়ের ডাক – সব মিলিয়ে ধর্মের কল সত্যিই বাতাসে নড়ছে। এই বাতাস কখনও কখনও ভণ্ডকে উন্মোচন করে, মিথ্যাবাদী বক্তাকে সামনে এনে দাঁড় করায়, গুজব তৈরিকারীর মুখোশ খুলে দেয়। আবার একই বাতাস যদি অপরীক্ষিত গুজবের ঝড় হয়ে ওঠে, তবে সেও ভয়ংকর। তাই আজ আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা বাতাসকে ব্যবহার করব সত্যের বার্তা ছড়াতে, না মিথ্যার অগ্নিশিখা বানাতে।
শেষবাণী: সত্যকে ধারণ কর, সমাজকে রক্ষা কর
তুহিন আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। একদিন বাড়ি এসে দেখল, আব্দুল্লাহ নতুন ব্যাচের ছেলেমেয়েদের ক্লাসে বিভিন্ন সময়ে বলছেন,:
ক্লাসের শেষ বোর্ডে তিনি আবারও লিখলেন, “সত্যকে ধারণ কর, বিবেককে জাগ্রত কর, আর আলোর পথে অটল থাকিয়া সমাজকে রক্ষা কর।” তুহিন বারান্দা থেকে দেখল, কিছু ছাত্র সেই লাইনটি মোবাইলে ছবি তুলে নিল, কেউ খাতায় লিখল, কেউ নিজের মনে গেঁথে রাখল। এই গেঁথে রাখা সত্যই একদিন সমাজের প্রহরী হবে। যেদিন গুজবের আগুনের আগে মানুষের বিবেক কথা বলবে, যেদিন ধর্মের নামে ব্যবসার আগে কোরআনের আয়াত সামনে আসবে, যেদিন “মানুষ জাতি” পরিচয় “দল” আর “ঘরানা”র বাইরে সবার আগে দাঁড়াবে, সেদিন সত্যিই শান্তির বাতাসে ঘুরবে ধর্মের কল, আর আমরা সবাই মিলে বলতে পারব,
আমরা চেষ্টা করেছি,
সত্যকে ধারণ করতে,
বিবেককে জাগ্রত রাখতে,
আর আলোর পথে অটল থেকে,
আমাদের সমাজকে রক্ষা করতে।
✍️ –অধ্যাপক ড. মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা্ সম্পাদক, অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com)
#সত্যেরআলো #ধর্মেরকলবাতাসেনড়ে #গুজববিরোধী #কোরআনের_শিক্ষা #মানবতা #মানবাধিকার #ডিজিটালযুগ #ধর্মব্যবসা #নজরুল #লালসালু #বিবেকজাগরণ #BanglaFeature