11/25/2025 কাক-চালাকের আখ্যান: দম্ভ ও পরিণতির তিনটি গল্প এবং একটি ঘটনা
Dr Mahbub
২৪ November ২০২৫ ২২:৩৯
—একটি প্রতীকময় রূপকগল্প, যেখান থেকে উঠে আসে বর্তমান সমাজের এক নগ্ন বাস্তবতা
“কাক-চালাক” পরিচিত এক বাংলা প্রবচনের আড়ালে লুকিয়ে আছে সমাজ-মনস্তত্ত্বের গভীর পাঠ। এই ফিচার আর্টিকেলটি কাক ও কোকিলের প্রকৃতি ও পরজীবী আচরণের গল্পের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে মানুষ সমাজের আত্মপ্রবঞ্চনা, অহংকার, এবং কৃত্রিম ‘চালাকির’ মুখোশ। এ এক সত্রক গল্প—ক্ষমতা, বুদ্ধি ও আত্মবিস্মৃতির দম্ভে কীভাবে মানুষ নিজেরই পতনের পথ তৈরি করে।
বাংলা সাহিত্যে “কাক” শুধু একটি পাখি নয়—এ এক প্রতীকের নাম। অতি চালাকির প্রতিচ্ছবি, আত্মপ্রশংসায় মোহিত এক চরিত্র, যে নিজের কৌশলকে সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করে; অথচ বারবার পতনের মুখে পড়ে। এই কাক, এই কাক-চালাক, আমাদের চারপাশে আছে, আছে সমাজে, রাজনীতিতে, এমনকি আমাদের নিজেদের মধ্যেও। আজ আমরা সেই চালাক কাকের গল্প বলব—তার দম্ভ, তার ভুল, এবং তার করুণ পরিণতির কথা।
তিনটি গল্প
দিনের আলো সবেমাত্র মরে এসেছে, ঠিক তখনই একটি ধূর্ত কাক তার ঠোঁটে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল এক ঝলমলে ধাতব চামচ। এই চকচকে সম্পদটি সে কোনো গৃহস্থের উঠোন থেকে চুরি করে এনেছে, আর এখন তার বাসায় ফিরবার পালা। কিন্তু তার স্বজাতিরা, যারা দূর থেকে এই দৃশ্য দেখছিল, তাদের চোখে পড়ল সেই ঔজ্জ্বল্য। তাদের মনে হলো—যেহেতু তারা একই গোত্রের অংশ, তাই এই সম্পদে তাদেরও ন্যায্য ভাগ রয়েছে। তাই তারা প্রতিবাদী 'কা কা' রব তুলে সেই বিত্তশালী কাকটির পিছু নিল। কিন্তু চোর কাকটি ছিল একরোখা, তার মতে এই সম্পদ কেবল তারই, কারণ সে কষ্ট করে এটি চুরি করে এনেছে। সে কিছুতেই কাউকে ভাগ বসাতে রাজি নয়।
পিছন ধাওয়াকারী কাক দুটির অবিরাম তাড়া আর চিৎকারে চুরি করে আনা কাকটি একসময় পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ল। সে উড়ে গিয়ে একটি ঘন পাতার আড়ালে মুখটি ঢুকিয়ে বসে পড়ল, মনে মনে ভাবল—কেউ তাকে দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু পিছনের কাক দুটি উড়ে এসে ঠিক তার কাছাকাছি বসলো এবং কিচিরমিচির শুরু করলো। এবার সম্পদ রক্ষার শেষ চেষ্টা হিসেবে কাকটি এক ধূর্ত বুদ্ধি প্রয়োগ করলো: মুখ লুকিয়েই সে চুরি করা চামচটি পাতার ফাঁক দিয়ে নিচে ফেলে দিল। তার ধারণা ছিল, এখন আর কেউ এই সম্পদ পাবে না। কিন্তু মুহূর্তের ভুলে সে নিজে আর সেই চামচের নাগাল পেল না। এভাবে তার চালাকিই তার সম্পদ হারানোর কারণ হলো।
আরেকদিনের ঘটনা। নীল আকাশ সেদিনও ছিল চিল ও ঈগলের রাজত্ব। কিন্তু কাকরা নিজেদের এই অঞ্চলের আকাশ ও কর্তৃত্বের মালিক মনে করে। তাদের দম্ভ—বুদ্ধিতে তারা চিল-ঈগলের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। তাই তারা চিল বা ঈগলের সেই গদাইলস্করি দৌরাত্ম্য মানতে নারাজ। প্রায়শই দেখা যায়, একদল কাক মিলে ঈগলের পিছনে লাগে। একটি কাক সাহস করে উড়ে গিয়ে ঈগলের মাথার উপরে উঠে বসে, এমনকি ঠোকর বা কামড় পর্যন্ত দেয়। তার উদ্দেশ্য হলো ঈগলকে বোঝানো—সে কত চালাক আর কত শক্তিশালী। অন্য কাকরা নিজেদের এই সাহস ও দম্ভে গর্বিত হয়। কিন্তু ঈগল তখন কোনো প্রতিবাদ করে না। সে ধীরে ধীরে কেবল উপরের দিকে ওঠা বাড়াতে থাকে, তার স্বাভাবিক গতিতে।
উপরে চড়ে বসা সেই দাম্ভিক কাকটি এটিকে ভুল ব্যাখ্যা করে। সে ভাবতেই থাকে—‘দেখ আমাদের কত বুদ্ধি, কত শক্তি! পাখির রাজা দাবি করা ঈগল আমাদের আজ্ঞাবহ হয়ে আমাদের নিয়ে উড়ে চলছে!’ সে তার স্বজাতিদের কাছে নিজের বাহাদুরি জাহির করতে থাকে। ঈগল তখন মনে মনে হাসে এবং তার উচ্চতা বাড়িয়ে যেতে থাকে। একসময় ঈগল এমন উচ্চতায় পৌঁছায়, যেখানে বাতাসের ঘনত্ব কম এবং অক্সিজেনের অভাব তীব্র। সেই উচ্চতায় পৌঁছে কাকের শ্বাসকষ্ট শুরু হয় এবং সে আর সেখানে থাকতে পারে না। বাধ্য হয়ে ঈগলের মাথা ছেড়ে দেয়। ফলাফল যা হওয়ার তাই হয়—ভূমিতে নিপতিত হয়ে তার দম্ভের পরিসমাপ্তি ঘটে। ঈগল তার শক্তি প্রদর্শন না করেও কেবল কৌশল ও স্থিতাবস্থা বজায় রেখে তার প্রতিশোধ নেয়।
এই দুটি আখ্যান আমাদের সমাজে এক ধরনের 'কাক-চালাক' মানুষের চারিত্রিক কাঠামো তৈরি করে। এই ভূখণ্ডে এমন অনেকেই আছেন যারা সবসময় নিজেকে জাহির করতে ব্যস্ত। তারা যেন অহংকারের সুধা পান করে সঞ্জীবনী মন্ত্র প্রয়োগ করছেন—‘আমি সেরা, আমি সব পারি।’ তারা নিজেদের দুর্বলতা বা সীমাবদ্ধতা মোটেও বুঝতে চান না, নিজেকে অত্যন্ত চালাক মনে করেন। এদের কাছে তুচ্ছ বিষয়ও মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। যেমন, তারা ঘরের সামনে দিয়ে মশা উড়ে গেলে চিৎকার করে ওঠে—'কত বড় সাহস মশা যায়!'—কিন্তু তাদের দৃষ্টির সামনে দিয়ে সমাজের বড় অন্যায় বা বড় বিপদ (হাতি) চলে গেলেও সেটি তারা দেখতে পায় না বা দেখেও এড়িয়ে যায়। এই 'কাক-চালাক' মানুষগুলো সাময়িক বুদ্ধির ঝলক দেখিয়ে সম্পদ বা প্রতিপত্তির সামান্য অংশ লাভ করলেও, অহংকার ও আত্ম-অবহেলার কারণে শেষ পর্যন্ত নিজেদের আসল লক্ষ্য ও সম্মান হারিয়ে ফেলে। তাদের চালাকি কেবল নিজেদের সর্বনাশই ডেকে আনে।
কাক-চালাকের আখ্যানের এই পর্যায়ে যুক্ত হয় আরও এক চতুর চরিত্র—কোকিল। কোকিল ও কাকের গায়ের রং ও দৈহিক গঠনে বেশ মিল রয়েছে, যা তাদের চালবাজির জন্য এক প্রাকৃতিক আশীর্বাদ। কোকিল ডিম পাড়ে, কিন্তু কোকিল দম্পতি ডিম তা দিয়ে বাচ্চা ফুটিয়ে লালন-পালন করার কষ্টটুকু করতে নারাজ। অথচ নিজের সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখানো প্রতিটি জীবেরই সহজাত বাসনা। তাই কোকিলা ডিম পেড়ে চলে। অপরদিকে তার সঙ্গী কোকিলটি তখন আর দশটি পাখির মতো সঙ্গীর পাশে না থেকে, একটি বিশেষ মিশনে নামে। সে গোয়েন্দা তথ্যের মতো করে এ গাছ থেকে সে গাছে উড়ে উড়ে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে—পাশের কোনো কাক দম্পতি ডিম পেড়ে তাতে তা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে কিনা।
যথারীতি সে খোঁজ পেয়েও যায়। এরপর নিজের সন্তানের আকাঙ্ক্ষায় কোকিল দম্পতি ডিমগুলো মুখে নিয়ে কাকের বাসার কাছাকাছি কোথাও অপেক্ষা করতে থাকে। এরপরে কাক দম্পতি যখন খাদ্য সংগ্রহের জন্য বাসা থেকে বাইরে যায়, সুযোগ বুঝে কোকিল দম্পতি অতি দ্রুততার সাথে কাকের বাসায় প্রবেশ করে। তারা অত্যন্ত সযত্নে কাকের ডিমের সঙ্গেই নিজেদের ডিম সাজিয়ে রেখে আসে। কখনো কখনো এই ঝামেলা এড়াতে কোকিলা সরাসরি কাকের বাসাতেই ডিম পাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সেক্ষেত্রে কাকেরা বাইরে গেলেই কোকিলা প্রবেশ করে ডিম পেড়ে দ্রুত সটকে পড়ে।
এরপর কাক দম্পতি খাবার সংগ্রহ করে যখন বাসায় ফিরে আসে, তখন মি. কাক বলে, "যাই, আমার ভবিষ্যৎ বাচ্চাদের একবার দেখে আসি।" সে বাসা থেকে যাওয়ার আগে ডিমের সংখ্যা গুনে গিয়েছিল। ফিরে এসে ডিমের দিকে চোখ দিতেই দেখে—ডিমের সংখ্যা বেড়ে গেছে। সে বিস্ময়ে মিসেস কাককে জানায়। মিসেস কাক ছুটে এসে দেখে, সত্যিই ডিমের সংখ্যা বেড়ে গেছে। তখন মিসেস কাক বেশ অহংকারের সাথে মি. কাককে বলে, "তুমি এতো বোকা কেন? আমরা বুদ্ধিমান প্রাণী! তোমার নিজের শক্তির উপর আস্থা নাই থাকতে পারে, কিন্তু আমার আছে। আসলে দেখো, তোমারও পরিশ্রম করতে হয়নি, আর আমারও পি..."
কিন্তু তার বাক্য শেষ হওয়ার আগেই একটি উপলব্ধি তাদের চোখে জ্বলে ওঠে। চতুর কোকিল তাদের অজ্ঞতা এবং অহংকারকে ব্যবহার করেছে। কোকিলেরা তাদের বুদ্ধিমত্তা ও সাদৃশ্য কাজে লাগিয়ে নিজেদের সন্তান পালন করার দায়িত্ব কাকদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে। কাক দম্পতি এখন বুঝল, তাদের বুদ্ধিমত্তা ও অহংকারই তাদের অসাবধান করে তুলেছিল। তারা বাইরের শত্রুর প্রতি মনোযোগী ছিল, কিন্তু নিজেদের বাসার ভেতরের অতি সূক্ষ্ম প্রতারণাটি ধরতেই পারেনি। এভাবে কোকিল তার ছদ্মবেশী চালাকি দ্বারা কাকের বুদ্ধিমত্তার দম্ভকে পরাজিত করে। এই ঘটনা সমাজে সেই চালাক মানুষের উদাহরণ, যারা চোখের সামনে ঘটে যাওয়া সূক্ষ্ম প্রতারণাগুলো ধরতে ব্যর্থ হন, কারণ তারা নিজেদের বুদ্ধির অহংকারে এতটাই মগ্ন থাকেন যে সরল সত্যটুকুও দেখতে পান না।
এবার একটি বাস্তব ঘটনা তুলে ধরি । অবশ্যই। কাক-চালাকের আখ্যানের মূল শিক্ষণীয় বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে মানুষের জন্য একটি ছোট গল্প (গল্পে ব্যক্তি ও স্থানের ছদ্মনাম ব্যবহার হয়েছে)বা রূপক কাহিনি এখানে তুলে ধরা হলো:
গ্রামের নাম ছিল হিরণ্যপুর। সেই গ্রামে বাস করত চতুর এক কাঠমিস্ত্রি—নাম তার মজিদ। মজিদ নিজেকে গ্রামের সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষ বলে মনে করত। তার দক্ষতা ছিল সামান্য, কিন্তু আত্মবিশ্বাস ছিল আকাশছোঁয়া। সে সবসময় অন্যের ভুল খুঁজে বেড়াতো আর নিজের তুচ্ছ সাফল্য নিয়ে অহংকার করত। তার স্বভাব ছিল অনেকটা প্রথম গল্পের সেই কাকটির মতো—একটি সামান্য জিনিস চুরি করে এনেও সে নিজেকে সেরা চোর বা সবচেয়ে ক্ষমতাশালী দাবি করত।
একদিন মজিদ তার পুরোনো ঘরে একটি সামান্য ফাটল দেখতে পেল। তার প্রতিবেশী, অভিজ্ঞ রাজমিস্ত্রি করিম, তাকে সতর্ক করে বলল, "মজিদ ভাই, ঘরের ভিত্তিমূলে সমস্যা আছে। সামান্য ভূমিকম্পেই এটি ভেঙে যেতে পারে। এখনই মেরামতের ব্যবস্থা করুন।" কিন্তু মজিদ হেসে উড়িয়ে দিল। সে বলল, "আমি এই অঞ্চলের সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষ। সামান্য একটি ফাটল, এটি কোনো বিষয় নয়। আমি তো আমার এই হাতুড়ি-বাটালি দিয়েই পুরো গ্রাম বানিয়েছি। আমার ঘরের ভিত্তি দুর্বল হতে পারে না! করিম, তুমি বুড়ো হয়ে গেছো, শুধু ভয় পাও।" মজিদের এই দম্ভ ছিল দ্বিতীয় গল্পের সেই কাকটির মতো, যে সামান্য ঠোকর মেরেই ঈগলকে চ্যালেঞ্জ করত।
কিন্তু বিপদ এল অন্যভাবে। মজিদের বাড়িতে একটি নতুন কাজের লোক এল—নাম তার শফিক। শফিক দেখতে খুব শান্তশিষ্ট, অনেকটা কোকিলের মতো নিরীহ। মজিদ একদিন তার ব্যক্তিগত কাজের জন্য শফিককে কিছু টাকা গোনার দায়িত্ব দিল। মজিদ টাকাগুলো গুনে, তার পাশে একটি কাগজে মোট সংখ্যা লিখে রেখেছিল। কিছুক্ষণ পর শফিক কাজ শেষ করে টাকাগুলো ফিরিয়ে দিল। মজিদ গোনার সময় দেখল, সংখ্যায় কোনো হেরফের নেই। শফিক ছিল আসলে খুব চালাক। সে জানত, মজিদ অহংকারের কারণে নিজেকে বুদ্ধিমান প্রমাণ করতে দ্রুত সব কাজ শেষ করতে চাইবে এবং তাই সামান্য ত্রুটি ধরতেই পারবে না। শফিক গুনে রাখা টাকার সাথে কৌশলে আরও কিছু জাল নোট ঢুকিয়ে দিয়েছিল। মজিদ অহংকারের বশে দ্রুত গুনে কেবল সংখ্যা মিলিয়ে দেখল, কিন্তু নোটের গুণগত মান (আসল-নকল) দেখতে ভুলে গেল। সে ভাবল, "আমি তো সব বুঝে গেছি, আর কী দেখার দরকার?" মজিদ সন্তুষ্ট হয়ে শফিককে কাজে বহাল রাখল। মজিদের এই অসাবধানতা ছিল তৃতীয় গল্পের সেই কাকটির মতো, যে ডিমের সংখ্যা গুনে সন্তুষ্ট হলেও কোকিলের ডিমের গুণগত পার্থক্য ধরতেই পারেনি।
এরপর একদিন সামান্য ভূমিকম্পে মজিদের সেই দুর্বল ঘরের ছাদের একটি অংশ ধসে পড়ল। সৌভাগ্যবশত, কেউ আহত হয়নি, কিন্তু ঘরের জিনিসপত্র নষ্ট হলো। সে বুঝতে পারল, নিজের 'অল্প বুদ্ধি' ও অহংকার তাকে দুর্বলতা বুঝতে দেয়নি। একই সাথে, যখন পুলিশ জাল নোটের সন্ধান করতে লাগল, তখন মজিদের কাছে থাকা সেই জাল নোটগুলো ধরা পড়ল। তখন মজিদ বুঝল—সে নিজেকে সবচেয়ে চালাক ভাবলেও, শফিকের মতো শান্ত চেহারার মানুষ তাকে বোকা বানিয়ে গিয়েছে। তার দম্ভ ও অসাবধানতা তাকে আসল ক্ষতি থেকে দূরে রাখেনি।
সাম্প্রতিক বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কাক-চালাকের এই তিনটি গল্পের শিক্ষণীয় বিষয় গভীর তাৎপর্য বহন করে। আমাদের সমাজে এই 'কাক-চালাক' মানসিকতার বহু প্রতিচ্ছবি বিদ্যমান, বিশেষত দ্রুত পরিবর্তনশীল সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতায়। এই ভূখণ্ডে অনেকেই যেন সেই প্রথম গল্পের কাকটির মতো ব্যক্তিগত স্বার্থকে জাতীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দেন, যেখানে সম্পদ, সুযোগ বা ক্ষমতাকে কেবল ব্যক্তিগত ভোগের বস্তু মনে করা হয় এবং অন্যের ন্যায্য ভাগ (যেমন: সাধারণ মানুষের সুযোগ) কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়। এই আত্মকেন্দ্রিক চালাকি সমাজে কেবল বঞ্চনা সৃষ্টি করে এবং সামগ্রিক সুফল বয়ে আনে না। আর দ্বিতীয় গল্পের কাকের মতো মিথ্যা অহংকার এবং আত্ম-প্রচারের প্রবণতাও সমাজের উচ্চস্তরে প্রায়ই দেখা যায়; যেখানে সত্যিকারের কাজ না করে কেবল গালভরা বুলি বা বাইরের সাজসজ্জা দিয়ে নিজেকে সেরা প্রমাণের চেষ্টা চলে। কিন্তু বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সত্যিকারের প্রতিযোগিতার উচ্চতা বাড়লে, এই আত্মপ্রচারের বেলুন চুপসে যেতে বাধ্য হয় এবং জাতীয় অগ্রগতির পতন ঘটে। সর্বোপরি, সবচেয়ে বড় বিপদ লুকিয়ে আছে তৃতীয় গল্পের কোকিলের কৌশলে। আমাদের সমাজের কিছু অংশ নিজেদের অতীত সাফল্য, নৈতিক ভিত্তি বা রাজনৈতিক ক্ষমতার গর্বে এতটাই আত্মতুষ্ট যে, তাদের চোখ এড়িয়ে সমাজের অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া সূক্ষ্ম দুর্নীতি, পরিবেশের ক্ষতি বা দুর্বল কাঠামোগত অবহেলাগুলো তারা ধরতেই পারে না। এই অন্ধ আত্মবিশ্বাস আমাদের অসতর্ক করে তোলে এবং ভবিষ্যতের বড় বিপর্যয়ের ঝুঁকি (যেমন—ভূমিকম্প বা আর্থিক সংকট) নীরবে লালন করে। অতএব, এই সময়ে বাংলাদেশের মানুষের জন্য সবচেয়ে জরুরি শিক্ষা হলো: দম্ভ নয়, বিনয় চাই; আত্মপ্রতারণা নয়, আত্মসমালোচনা চাই; এবং ব্যক্তিগত চালাকি নয়, বরং সামগ্রিক কল্যাণের জন্য সতর্কতা ও স্থিতিশীলতা চাই।
এই গল্পের মজিদ আমাদের সমাজে সেইসব ‘কাক-চালাক’ মানুষদের প্রতিচ্ছবি, যারা সীমিত জ্ঞানের দম্ভে নিজেদের অতিমূল্যায়ন করে, অথচ বাস্তব সংকট কিংবা বড় বিপদকে চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়। তারা মশার মতো তুচ্ছ বিষয়ে অতিরিক্ত মনোযোগ দেয়, কিন্তু হাতির মতো স্পষ্ট ও গভীর সংকটকেও অবহেলা করে। অহংকার তাদের এতটাই আচ্ছন্ন করে যে, সূক্ষ্ম প্রতারণা—যেমন কোকিলের ডিম কিংবা জাল নোট—তাদের নজর এড়িয়ে যায়। এই গল্প আমাদের শিখায়: প্রকৃত বুদ্ধিমত্তা মানে অহংকার নয়, বরং আত্মজ্ঞান, বিনয় ও সতর্ক পর্যবেক্ষণ। জীবনের পথে সামনে আসা ঈগলের মতো বড় বিপদ কিংবা কোকিলের মতো সূক্ষ্ম প্রতারণার ফাঁদ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হলে প্রয়োজন দূরদৃষ্টি, মনঃসংযম এবং আত্মসমালোচনামূলক বোধ। বাংলাদেশসহ উপমহাদেশীয় সমাজে আজ আমরা প্রচুর কাক-চালাকের ছায়া দেখি। নিজের সীমাবদ্ধতা না মেনে সবাই ভাবছে, "আমি সব পারি", "আমি সেরা"। অথচ বাস্তবতা হলো—এই অতি আত্মপ্রচারের যুগে মানুষের আন্তঃসম্পর্কে এসেছে ফাটল, বেড়েছে সন্দেহ, ছড়িয়ে পড়েছে কৃত্রিমতার গন্ধ।
চালাকি, যদি সীমা না মানে, তা হয় দম্ভ; আর দম্ভ শেষমেষ মানুষকে নিঃস্ব করে দেয়।
মানবের জীবন ও গল্পসমূহের অর্ন্তনিহিত তাৎপর্য
কাক-চালাকের এই তিনটি গল্প মানবচরিত্রের কয়েকটি গভীর দুর্বলতা ও পরিণতির দিক উন্মোচন করে। একই সাথে মজিদের কেস বাস্তবতাকে তুলে ধরে। সাম্প্রতিক বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কাক-চালাকের এই তিনটি গল্পের শিক্ষণীয় বিষয় গভীর তাৎপর্য বহন করে। আমাদের সমাজে এই 'কাক-চালাক' মানসিকতার বহু প্রতিচ্ছবি বিদ্যমান, বিশেষত দ্রুত পরিবর্তনশীল সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতায়। এই ভূখণ্ডে অনেকেই যেন সেই প্রথম গল্পের কাকটির মতো ব্যক্তিগত স্বার্থকে জাতীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দেন, যেখানে সম্পদ, সুযোগ বা ক্ষমতাকে কেবল ব্যক্তিগত ভোগের বস্তু মনে করা হয় এবং অন্যের ন্যায্য ভাগ (যেমন: সাধারণ মানুষের সুযোগ) কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়। এই আত্মকেন্দ্রিক চালাকি সমাজে কেবল বঞ্চনা সৃষ্টি করে এবং সামগ্রিক সুফল বয়ে আনে না। আর দ্বিতীয় গল্পের কাকের মতো মিথ্যা অহংকার এবং আত্ম-প্রচারের প্রবণতাও সমাজের উচ্চস্তরে প্রায়ই দেখা যায়; যেখানে সত্যিকারের কাজ না করে কেবল গালভরা বুলি বা বাইরের সাজসজ্জা দিয়ে নিজেকে সেরা প্রমাণের চেষ্টা চলে। কিন্তু বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সত্যিকারের প্রতিযোগিতার উচ্চতা বাড়লে, এই আত্মপ্রচারের বেলুন চুপসে যেতে বাধ্য হয় এবং জাতীয় অগ্রগতির পতন ঘটে। সর্বোপরি, সবচেয়ে বড় বিপদ লুকিয়ে আছে তৃতীয় গল্পের কোকিলের কৌশলে। আমাদের সমাজের কিছু অংশ নিজেদের অতীত সাফল্য, নৈতিক ভিত্তি বা রাজনৈতিক ক্ষমতার গর্বে এতটাই আত্মতুষ্ট যে, তাদের চোখ এড়িয়ে সমাজের অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া সূক্ষ্ম দুর্নীতি, পরিবেশের ক্ষতি বা দুর্বল কাঠামোগত অবহেলাগুলো তারা ধরতেই পারে না। এই অন্ধ আত্মবিশ্বাস আমাদের অসতর্ক করে তোলে এবং ভবিষ্যতের বড় বিপর্যয়ের ঝুঁকি (যেমন—ভূমিকম্প বা আর্থিক সংকট) নীরবে লালন করে। অতএব, এই সময়ে বাংলাদেশের মানুষের জন্য সবচেয়ে জরুরি শিক্ষা হলো: দম্ভ নয়, বিনয় চাই; আত্মপ্রতারণা নয়, আত্মসমালোচনা চাই; এবং ব্যক্তিগত চালাকি নয়, বরং সামগ্রিক কল্যাণের জন্য সতর্কতা ও স্থিতিশীলতা চাই।
"অতি চালাকের গলায় দড়ি"—এই প্রবাদ কেবল বচন নয়, এটি এক জীবনদর্শন। কাক-চালাকের গল্প আমাদের শেখায় যে আত্মপ্রবঞ্চনা দিয়ে চালাকি এবং আত্মশক্তির বড়াই হয়তো কিছু সময়ের জন্য বাহবা পায়, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তার ফলাফল হয় পতন, নিঃসঙ্গতা ও ব্যর্থতা। আত্মসমালোচনা, সহানুভূতি, ও বুদ্ধিদীপ্ত বিনয়—এই গুণাবলিই একমাত্র মানুষকে মনুষ্যত্বের সত্যিকারের উঁচুতে নিয়ে যেতে পারে।
✍️ –অধ্যাপক ড. মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা সম্পাদক, অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com)
#কাকচালাক #রূপকগল্প #সামাজিকবিশ্লেষণ #অতি_চালাকি #পরিণতিরগল্প #সমাজমনস্তত্ত্ব #অহংকার_বিপদ_ডাকে #বাংলা_ফিচার #সতর্কগল্প #আত্মপ্রবঞ্চনা #কৃত্রিমবুদ্ধি #বাংলাদেশ_সমাজ #কাক_কোকিল