12/04/2025 অধিকারের আড়ালে বঞ্চনা: যখন আন্তর্জাতিক দিবস আসে, কিন্তু প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বঞ্চনার অবসান হয় না
Dr Mahbub
২ December ২০২৫ ১৫:০৭
—উপসম্পাদকীয়—
আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস (৩ ডিসেম্বর) সামনে রেখে এক দশক ধরে উপেক্ষিত থাকা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সাংবিধানিক ও আইনি অধিকারের তীক্ষ্ণ পর্যালোচনা। ১% সরকারি চাকরির কোটা কেন পূরণ হচ্ছে না, হাইকোর্টের নির্দেশনার পরও বৈষম্য কেন বিদ্যমান, এবং 'প্রতিবন্ধী উন্নয়ন অধিদপ্তর' প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি কেন আজও অধরা? গণতন্ত্রে তাদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব এবং একটি 'বিশেষ বিসিএস'-এর জরুরি দাবিসহ বাংলাদেশের আইন প্রয়োগের অসঙ্গতি নিয়ে চূড়ান্ত উপসম্পাদকীয়।
কালের পরিক্রমায় আবারও দোরগোড়ায় আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস (৩ ডিসেম্বর)। বিশ্বের ক্যালেন্ডারে সময় মেনে বাংলাদেশে প্রতিবছর এই দিনটি ঘটা করে পালিত হয়। বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতারসহ অন্যান্য ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় স্ক্রলে প্রচার হচ্ছে এবারের প্রতিপাদ্য: ‘প্রতিবন্ধিতা অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ি, সামাজিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত করি’। জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে ক্রোড়পত্র, গণসচেতনতা বাড়াতে মোবাইল অপারেটররা পাঠাবে বার্তা—সব মিলিয়ে সাজ সাজ রব। কিন্তু যাদের জন্য এই দিবস, তাদের জীবনযাত্রার মান ও দীর্ঘদিনের বঞ্চনার কি কোনো উন্নতি হয়েছে?
এদেশের সবচেয়ে মেধাবী, বিশ্ববিদ্যালয় গ্র্যাজুয়েট প্রতিবন্ধী তরুণ-তরুণীদের দীর্ঘদিনের বঞ্চনার অবসান আজও ঘটেনি। তাদের জীবন এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি, যেখানে শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রায় মূল্যহীন, আর রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি কেবলই আনুষ্ঠানিকতা।
চাকরি ও ক্ষমতায়ন: উপেক্ষিত সাংবিধানিক ও আইনি অধিকার
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও ক্ষমতায়নের প্রসঙ্গে রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা শুধু দিবস পালনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়। বরং, সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা ও সাংবিধানিক অঙ্গীকারের বাস্তবায়নই হতে পারে তাদের প্রতি প্রকৃত সম্মান প্রদর্শন।
প্রায় এক দশক আগে (২০১২ সালে) সরকারি চাকরিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ১% কোটা সংরক্ষিত হলেও, বিশেষ করে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে—বিসিএস ও বিচার বিভাগীয় নিয়োগে—এর কার্যকর বাস্তবায়ন আজবদী অধরা।
মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের রায় উপেক্ষিত
২০২৪ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট তার ঐতিহাসিক রায়ে প্রতিবন্ধী নাগরিকদের জন্য ১% সংরক্ষিত কোটা বজায় রাখার নির্দেশ দেন। এরপরেও যদি এই কোটায় নিয়োগ না দেওয়া হয়, তবে তা আদালত অবমাননার শামিল। শত বাধা অতিক্রম করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাস করা প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা চাকরির অসম প্রতিযোগিতা, বৈষম্যমূলক মনোভাব ও সুযোগের অভাবে পেশাগত জীবনে প্রবেশ করতে পারছে না।
আইন আছে কিন্তু তার চোখ নাই
২০১৩ সালের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন এবং হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও এক দশক ধরে বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরি ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়নি। আইন থাকা সত্ত্বেও তা বাস্তবে প্রয়োগের অভাবে সরকারি চাকরিতে ১% কোটা পূরণ হয় না এবং বেসরকারি খাতে অন্তর্ভুক্তি নীতি অনুপস্থিত। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী স্নাতক যেমন বলেন, চাকরির বাজারে তাদের যোগ্যতা নয়, প্রতিবন্ধকতায় প্রাধান্য দেওয়া হয়। ২০১৫ সালের হাইকোর্টের রুল ও সংবিধানের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি তুলে ধরেও নিয়োগে বৈষম্য দূরীকরণে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন না আসায় এটিই স্পষ্ট হয় যে, বাংলাদেশে এই আইনটি 'আছে, কিন্তু তার চোখ নেই'।
বিশেষ বিসিএস-এর দাবি
বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (PSC) অতীতে বিশেষ কোটার প্রার্থীদের জন্য আলাদা বিসিএস পরীক্ষার (যেমন: ২৩তম বিসিএস) আয়োজন করেছে। সেই নজির অনুসরণ করে, বঞ্চনার অবসান ঘটাতে ১% কোটা পূরণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে, প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের জন্য অবিলম্বে একটি “বিশেষ বিসিএস” আয়োজনের দাবি এখন সময়ের দাবি। সাম্প্রতিক নিয়োগগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১% কোটা অনুসারে যে সংখ্যক পদ বরাদ্দ হওয়ার কথা, তা পূরণ হয়নি। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সর্বশেষ নিয়োগ পরীক্ষায় শতাধিক গ্র্যাজুয়েট প্রতিবন্ধী প্রার্থী উত্তীর্ণ হয়েও নিয়োগ পাননি—যা বৈষম্যের এক জ্বলন্ত উদাহরণ।
"আমরা নিরুপায় হয়ে, যখন সব দিক থেকে সাহায্য পাওয়ার আশা হারিয়ে ফেলি, তখন কঠিন পথ বেছে নিতে বাধ্য হই—যেমন অনশন। আমাদের কণ্ঠস্বর পদ্ধতিগতভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে, কারণ বিদ্যমান সক্ষমতাভিত্তিক আলোচনায় আমাদের প্রান্তিক করে দেখা হয়।" — আন্দোলনকারী প্রতিবন্ধী গ্র্যাজুয়েটদের মন্তব্য
রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব: গণতন্ত্রের অপূর্ণতা
প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী (আনুমানিক ১ কোটি ৬০ লক্ষ) বাংলাদেশে বর্তমানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, এবং ন্যায়বিচারসহ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে কাঠামোগত বৈষম্যের শিকার। অথচ জাতীয় সংসদে আজ পর্যন্ত তাদের একজন স্বতন্ত্র, নির্বাচিত কণ্ঠস্বর নেই। তাদের জন্য আইন তৈরি হয়—কিন্তু তাদের না জেনেই।
একটি খোলা চিঠি ও জোরালো আহ্বান:
একদল সচেতন নাগরিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ শিক্ষা বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান-এর নেতৃত্বে এক খোলা চিঠিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি জোরালো আহ্বান জানানো হয়েছে। চিঠিতে রাজনৈতিক সংস্কার প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জাতীয় সংসদে অর্থবহ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার দাবি তোলা হয়েছে।
আরো পড়ুন: প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার নিশ্চিতে সরকারি চাকরি ও ক্ষমতায়ন (প্রকাশিত: ৩ July ২০২৫)
আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা:
বাংলাদেশ জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী অধিকার সনদ (UNCRPD) ২০০৯ সালে অনুসমর্থন করেছে, যার ২৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের রাজনৈতিক ও জনজীবনে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
সুপারিশসমূহ
চিঠিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো জরুরি ভিত্তিতে গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে:
চূড়ান্ত প্রতিফলন
জুলাই চেতনার প্রতি অবিচার নয়
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ক্ষমতায়নে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে না পারলে এবং সমাজের মূল স্রোতধারায় না আনতে পারলে তা 'জুলাই চেতনার' প্রতি অবিচার হবে। এই রাজনৈতিক রূপান্তরের সন্ধিক্ষণে রাষ্ট্রের অঙ্গীকার হওয়া উচিত—"গণতন্ত্র কারো দয়ায় নয়, এটি সকলের অধিকার।" এবারের আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবসে সরকারের প্রতি প্রত্যাশা, কেবল বাণী ও আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার নিশ্চিত করতে দৃশ্যমান ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
- ড. মাহবুব লিটু, অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান, বিশেষ শিক্ষা বিভাগ, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং উপদেষ্টা সম্পাদক, আমাদের অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com
#আন্তর্জাতিকপ্রতিবন্ধীদিবস #প্রতিবন্ধীঅধিকার #প্রতিবন্ধীকোটা #বাংলাদেশের_আইন #চাকরিতেবৈষম্য #বিশেষবিসিএস #UNCRPD #প্রতিবন্ধীউন্নয়ন #আইনের_প্রয়োগ #জুলাইচেতনা #মানবাধিকার #সামাজিকন্যায়বিচার #উপসম্পাদকীয় #DisabilityRightsBD #RuleOfLaw #DrMahbubLitu