odhikarpatra@gmail.com ঢাকা | Tuesday, 11th November 2025, ১১th November ২০২৫
একটি আইনি ও নৈতিক বিশ্লেষণ

অধিকার আদায়ে মর্যাদার লড়াই: আইনি ভিত্তি ও ন্যায্যতার আলোকে প্রতিবন্ধী গ্র্যাজুয়েটদের পাঁচ দফা দাবি

odhikarpatra | প্রকাশিত: ১১ November ২০২৫ ০৩:৫০

odhikarpatra
প্রকাশিত: ১১ November ২০২৫ ০৩:৫০

সম্পাদকীয়

বাস্তবিক অর্থেই এই পাঁচটি দাবি কোনো বিশেষ সুবিধার দাবি নয়, বরং আইনের আলোকে বিচার, সমতা ও মর্যাদার দাবিতে দাঁড়ানো এক স্পষ্ট কণ্ঠস্বর। এখন সময়—রাষ্ট্রকে এই কণ্ঠ শুনে দায়বদ্ধতার স্থান থেকে দাবীগুলো মেনে নিয়ে বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার।

বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরেই বৈষম্য, বঞ্চনা ও উপেক্ষার শিকার। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা অর্জন করার পরও প্রতিবন্ধী গ্র্যাজুয়েটরা যখন চাকরির বাজারে প্রবেশ করতে গিয়ে একের পর এক প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হন, তখন তা শুধু ব্যক্তি নয়—রাষ্ট্রের সমতা ও ন্যায্যতার আদর্শকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে। এই প্রেক্ষাপটে চাকরি প্রত্যাশী প্রতিবন্ধী গ্র্যাজুয়েট পরিষদ (বাংলাদেশ) যে পাঁচ দফা দাবি উত্থাপন করেছে, তা নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী, ন্যায্য এবং আইনি ও নীতিগতভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত।

চাকরি প্রত্যাশী প্রতিবন্ধী গ্র্যাজুয়েট পরিষদের পাঁচ দফা দাবি

প্রথমত, প্রধান উপদেষ্টার নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী নাগরিকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিতকরণ শুধু একটি প্রশাসনিক পদক্ষেপ নয়—এটি সংবিধানের ২৭ ও ২৯ অনুচ্ছেদ এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩ অনুসারে একটি বাধ্যবাধকতা।

দ্বিতীয়ত, একটি স্থায়ী বিশেষ নিয়োগব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবি যেমন বাস্তবিক সমস্যা সমাধানে কার্যকর, তেমনই এটি সরকারে প্রতিবন্ধী অন্তর্ভুক্তির একটি স্থায়ী কাঠামো গঠনের পূর্বশর্ত।

তৃতীয়ত, শ্রুতি লেখক নীতিমালার প্রতিবন্ধীবান্ধব সংশোধন সময়ের দাবি। একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী পরীক্ষার্থীকে তার প্রাপ্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা যেন তার প্রতিভা ও শ্রমের অপমান।

চতুর্থত, ব্রেইল ও পিএইচটি কেন্দ্র থেকে শিক্ষালাভকারী গ্র্যাজুয়েটদের জন্য আলাদা নিয়োগের সুযোগ তৈরি না করা হলে তাদের শিক্ষা ও দক্ষতা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় এক প্রকার অপচয় হিসেবে পরিণত হয়।

পঞ্চম দাবি—সরকারি চাকরিতে বয়সসীমা ৩০ থেকে ৩৫ বছরে উন্নীত করার প্রস্তাব—বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের শিক্ষাগত ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতাকে বিবেচনায় নিয়ে ন্যায্য প্রতিযোগিতার পথ সুগম করবে।

এই দাবিগুলোর নীতিগত গুরুত্ব অসামান্য। এগুলোর বাস্তবায়ন না হলে প্রতিবন্ধী নাগরিকদের কর্মসংস্থান অধিকার শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকবে। অন্যদিকে, দাবি বাস্তবায়ন করলে বাংলাদেশ একটি দাতা-নির্ভর কল্যাণমুখী মডেল থেকে একটি অধিকারভিত্তিক অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন কাঠামোর দিকে এগিয়ে যাবে, যেখানে মানবিক মর্যাদা, সাম্য এবং সক্রিয় রাষ্ট্রীয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে।

এই পাঁচ দফা কোনো ভিক্ষার দাবি নয়—এগুলো ন্যায্যতা, সংবিধানিক অধিকার এবং সামাজিক সুবিচারের দাবি। রাষ্ট্র যদি সত্যিই "সবার জন্য সমান সুযোগ"-এর কথা বিশ্বাস করে, তবে এখনই সময়—এই দাবিগুলোর বাস্তবায়নের মাধ্যমে সেই অঙ্গীকার প্রমাণ করার।

আরো পড়ুন: অঙ্গীকারের পাথর ও মেধাবী প্রতিবন্ধী গ্র্যাজুয়েটদের অশ্রু-স্রোত: বৈষম্যমুক্তির আখ্যান।

প্রতিবন্ধী গ্র্যাজুয়েটদের পাঁচ দফা দাবির আইনি ভিত্তি নীতিগত যৌক্তিকতা

বর্তমানে দেশের চাকরি প্রত্যাশী প্রতিবন্ধী গ্র্যাজুয়েটদের অধিকার সুরক্ষায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩ (Rights and Protection of Persons with Disabilities Act,  2013) এবং বাংলাদেশ সংবিধানের সংবিধানিক অনুচ্ছেদগুলো আইনগত ও নীতিগতভাবে একটি শক্ত ভিত প্রদান করেছে। সেক্ষেত্রে চাকরি প্রত্যাশী প্রতিবন্ধী গ্র্যাজুয়েট পরিষদ (বাংলাদেশ)–এর পাঁচ দফা দাবি বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক ও সময়োপযোগী। নিচে এক‑একটি দাবি‑নিচাড়া আইনগত ভিত্তি ও তাৎপর্য বিশ্লেষণ করা হলো।

বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকারের প্রশ্নটি এখন আর মানবিক সহানুভূতির বিষয় নয়—এটি একটি সংবিধানিক, আইনগত এবং আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতার প্রশ্ন। "চাকরি প্রত্যাশী প্রতিবন্ধী গ্র্যাজুয়েট পরিষদ (বাংলাদেশ)"-এর উত্থাপিত পাঁচ দফা দাবি শুধু সময়োচিতই নয়, বরং গভীরভাবে সংবিধান, জাতীয় আইন এবং আন্তর্জাতিক সনদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩ এবং বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭, ২৮ ও ২৯—এই দাবিগুলোর আইনগত ভিত্তি।

. কর্মসংস্থান স্থায়ী বিশেষ নিয়োগব্যবস্থা (দাবি)

আইনি ভিত্তি: সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭ (অধিকারসমান সুরক্ষা) এবং ২৯ (সরকারি নিয়োগে সমান সুযোগ) উল্লেখযোগ্য। পাশাপাশি, প্রতিবন্ধী আইন, ২০১৩-এর ধারা ১৬(ক) অনুযায়ী সরকারি চাকরিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য অন্তত ১ % কোটা বিধান রয়েছে।
তাৎপর্য: বহু বছর ধরে এই আইনগত বাধ্যবাধকতা সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। এই দাবিগুলো সেই অভাব পূরণের জন্য—একটি স্পষ্ট, স্থায়ী ও কার্যকর নিয়োগব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আহ্বান। এটি আইনশৃঙ্খলা, সামাজিক ন্যায্যতা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থাপনায় অগ্রগতি নিশ্চিত করার দিকে একটি ইঙ্গিত।

. একীভূত শ্রুতিলেখক নীতিমালার সংশোধন (দাবি)

আইনি ভিত্তি: প্রতিবন্ধী আইন‑২০১৩-এর ধারা ১৫ (কর্মসংস্থানের অধিকার) এবং জাতিসংঘের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকারবিষয়ক সনদ (UNCRPD)‑এর ‘reasonable accommodation’ ধারণা।

তাৎপর্য: পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বা শারীরিক প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের জন্য শ্রুতি‑লেখক সার্বিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়লে তাদের প্রাপ্য সুযোগ ক্ষুণ্ণ হয়। সংশোধিত নীতি নিশ্চিত করবে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সমান সুযোগ ও প্রশাসনিক ন্যায়বিচার।

. বিশেষ শিক্ষা কেন্দ্রের গ্র্যাজুয়েটদের জন্য নিয়োগ সুযোগ (দাবি)

আইনি ভিত্তি: প্রতিবন্ধী আইন‑২০১৩-এর ধারা ১১ (শিক্ষার অধিকার) ও ধারা ১৫ (কর্মসংস্থানের অধিকার) অনুসারে রাষ্ট্রের দায়িত্ব রয়েছে।
তাৎপর্য: ব্রেইল‑ভিত্তিক ও পিএইচটি (Practical Handicap Training) প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে স্নাতক হওয়া প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা অন্যদের মতো নিয়োগের সুযোগ পায়নি; এই দাবি তাদের যোগ্যতা স্বীকৃতি ও সরকারি নিয়োগ ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তির দাবি জানায়। এটি শিক্ষায় বিনিয়োগের সামাজিক ফলদায়ক ব্যবহার নিশ্চিত করবে।

. সরকারি চাকরিতে বয়সসীমা বৃদ্ধি (দাবি)

আইনি ভিত্তি: সংবিধানে ন্যায্যতার প্রেক্ষাপটে এবং প্রতিবন্ধী আইন‑২০১৩‑র মূলনীতি হিসেবে ‘সমান সুযোগ’ ধারণা প্রাসঙ্গিক।
তাৎপর্য: প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য শিক্ষা, চিকিৎসা বা পরিবেশগত চ্যালেঞ্জের কারণে সাধারণ শিক্ষার্থীর তুলনায় বেশি সময় প্রয়োজন হয়। বয়সসীমা ৩০ থেকে ৩৫ বছরে উন্নীত করলে তারা নিয়োগের প্রতিযোগিতায় ন্যায়সঙ্গতভাবে অংশ নিতে পারবে। মানবিক মর্যাদা, উৎপাদনশীলতা এবং ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হবে।

সার্বিক বিশ্লেষণ যৌক্তিকতা

উপরের সব দাবিই কোনো বিশেষ সুবিধার দাবি নয়; এগুলো হল ন্যায়বিচার, সমান অধিকার মর্যাদার দাবি। আইনগতভাবে যখনই অধিকার প্রদত্ত হয় কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না, তখন সে অধিকার কার্যকর হয় না। এই কারণে, এই দাবিগুলো বাস্তবায়ন হলে:

  • সংবিধান ও আইন অনুযায়ী বাধ্যবাধকতা পূরণ হবে;
  • প্রতিবন্ধী অন্তর্ভুক্তিমূলক নিয়োগ ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় প্রতিষ্ঠানিক রূপ পাবে;
  • প্রতিবন্ধী গ্রাজুয়েটগণ সমাজ ও পরিবারে অবদান রাখতে সক্ষম হবেন।
  • বাংলাদেশ‑র আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার যেমন UNCRPD ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG 8 ও SDG 10) –‑এর প্রতি অঙ্গীকার দৃঢ় হবে;
  • মানুষের মর্যাদা, সামাজিক অংশগ্রহণ ও সাম্য নিশ্চিত হবে।

পাঁচ দফা দাবির সার্বিক গুরুত্ব

এই পাঁচ দফা দাবি বাস্তবায়ন হলে শুধু আইনগত বাধ্যবাধকতা পূরণ হবে না, বাংলাদেশ তার আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার—বিশেষ করে UNCRPD এবং ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG 8: মর্যাদাপূর্ণ কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং SDG 10: বৈষম্য হ্রাস)—বাস্তবায়নে দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দেখাবে।

এ ছাড়া:

  • রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস পুনঃপ্রতিষ্ঠা হবে।
  • শাসনব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তি ও সমানাধিকার নিশ্চিত হবে।

শেষের মন্তব্য

এই পাঁচ দফার আন্দোলন কেবল চাকরির জন্য নয়—এটি একটি সমাজব্যবস্থাকে নাড়া দেওয়ার আন্দোলন। চোখে আলো নেই বলেই কেউ “অযোগ্য”—এমন একটি নির্মম ধারণার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এই তরুণরা যে লড়াই চালাচ্ছেন, তা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের কাছে শুধুই বিব্রতকর নয়, এটি তাঁদের মানবিক ও সাংবিধানিক দায়ের আয়নাও বটে।

সম্প্রতি আইন এবং নীতিমালায় যে অগ্রগতি হয়েছে, তা সত্ত্বেও বাস্তব বদল এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছে। তাই এই দাবিগুলো শুধু প্রতীক্ষিত নয়—উচ্চমাত্রায় বাস্তবায়নের দাবি রয়েছে। রাষ্ট্র যদি সত্যিই “সবার জন্য সমান সুযোগ” নিশ্চিত করতে আগ্রহী হয়, তাহলে এগুলো দ্রুত গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক।

বাস্তবিক অর্থেই এই পাঁচটি দাবি কোনো বিশেষ সুবিধার দাবি নয়, বরং আইনের আলোকে বিচার, সমতা ও মর্যাদার দাবিতে দাঁড়ানো এক স্পষ্ট কণ্ঠস্বর। এখন সময়—রাষ্ট্রকে এই কণ্ঠ শুনে দায়বদ্ধতার পথে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার। নীতিগত সদিচ্ছা আর বাস্তবায়নের মধ্যে যেন আর ব্যবধান না থাকে।

অধ্যাপক মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা্ সম্পাদক, অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com)



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: