odhikarpatra@gmail.com ঢাকা | বৃহঃস্পতিবার, ২৮ আগস্ট ২০২৫, ১৩ ভাদ্র ১৪৩২
বুয়েটসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল শিক্ষার্থীরা রাজপথে

কনফ্লিক্ট অব ডিসসিপ্লিন: একাডেমিক মর্যাদা বনাম প্রফেশনাল স্বার্থ

odhikarpatra | প্রকাশিত: ২৮ আগস্ট ২০২৫ ০৪:৩৪

odhikarpatra
প্রকাশিত: ২৮ আগস্ট ২০২৫ ০৪:৩৪

সম্পাদকীয় নোট (Editorial Note) 

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও বিভিন্ন বেসরকারি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তিন দফা দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নিয়েছেন। প্রধান দাবির মধ্যে রয়েছে—ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের নামের আগে ‘প্রকৌশলী’ ব্যবহার না করা, তাদের কাউকে নবম গ্রেডে পদোন্নতি না দেওয়া এবং দশম গ্রেডের চাকরিতে স্নাতক প্রকৌশলীদের অগ্রাধিকার নিশ্চিত করা। প্রশ্ন উঠছে—এতদিন পরে কেন এই আন্দোলন? শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের পেশাগত সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হলে চার বছর মেয়াদি স্নাতক প্রকৌশলীদের মর্যাদা ও কর্মসংস্থান সংকুচিত হবে। এ কারণে একাডেমিক মর্যাদা রক্ষার পাশাপাশি পেশাগত স্বার্থ রক্ষায় তারা রাস্তায় নেমেছেন।

এবার বিষয়টি একাডেমিক ও পেশাগত দৃষ্টিকোন থেকে আলোচনা করা উচিত। বাংলাদেশে প্রকৌশল শিক্ষার অঙ্গনে দীর্ঘদিন ধরে এক অদৃশ্য টানাপোড়েন বিদ্যমান। একদিকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রিধারী B.Sc. Engineer, অন্যদিকে পলিটেকনিক থেকে পাশ করা Diploma Engineer। উভয়েই নিজেদের অবস্থানকে বৈধ ও মর্যাদাপূর্ণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান। সাম্প্রতিক সময়ের শাহবাগ অবরোধ এই দ্বন্দ্বকে নতুন করে আলোচনায় নিয়ে এসেছে।

একাডেমিক পার্থক্য

B.Sc. Engineer’রা চার বছর মেয়াদি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষায় গবেষণাভিত্তিক, তাত্ত্বিক জ্ঞান ও উদ্ভাবনী দক্ষতা অর্জন করেন। ভর্তি প্রক্রিয়াও প্রতিযোগিতামূলক ও কঠিন। উচ্চমাধ্যমিকে নির্দিষ্ট গ্রেড পেলেই আবেদন করা যায়। অপরদিকে, Diploma Engineer’রাও চারবছর মেয়াদি কারিগরি শিক্ষা বোর্ড পরিচালিত পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে পড়াশোনা করেন, যেখানে হাতেকলমে কাজ শেখানো হয় বেশি। তাদের জ্ঞান মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নকেন্দ্রিক। সাধারণত মাধ্যমিক পাশের পরে পলিটেকনিকে ভর্তি হতে হয়। তবে অনেকে উচ্চমাধ্যমিকের পরেও ভর্তি হয়। প্রথমটি উচ্চ শিক্ষার অংশ, আর দ্বিতীয়টি মাধ্যমিক শিক্ষা পরবতীৃ কিন্তু উচ্চ শিক্ষার পূর্বস্তর। সাধারণত দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি হচ্ছে কারিগরী ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ (TVET) ধারার মূল উদ্দেশ্য। 

অতএব, একজন স্নাতক প্রকৌশলী পরিকল্পনাকারী ও নকশাবিদ, আর একজন ডিপ্লোমা প্রকৌশলী মূলত মাঠপর্যায়ের বাস্তবায়নকারী। এই মৌলিক পার্থক্য থেকেই মর্যাদা ও পরিচয় নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু।

প্রফেশনাল স্বার্থের লড়াই

স্নাতক প্রকৌশলীরা মনে করেন, ডিপ্লোমাধারীরা যদি নামের আগে “প্রকৌশলী” ব্যবহার করেন বা নবম-দশম গ্রেডে পদোন্নতি পান, তবে তাদের মর্যাদা ক্ষুন্ন হবে। তারা দাবি করছেন—“প্রকৌশলী” শব্দের ব্যবহার সীমিত রাখতে হবে এবং সরকারি চাকরিতে উচ্চপদে বিশ্ববিদ্যালয় গ্রাজুয়েটদেরই অগ্রাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

অন্যদিকে, ডিপ্লোমা প্রকৌশলীরা পাল্টা প্রশ্ন তুলছেন—তারা একই মেয়াদি পড়াশোনা করে, হাতে-কলমে কাজ জানে, মাঠপর্যায়ের প্রকল্প চালিয়ে যায়, অথচ তাদের পরিচয় কেড়ে নেওয়া হচ্ছে কেন? তাদের মতে, বৈষম্য আরোপ করলে তা ন্যায়সংগত হবে না।

প্রকৌশল বনাম কারিগরি: ইগোর লড়াইয়ে শিক্ষাঙ্গন

বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে সম্প্রতি নতুন এক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের ছয় দফা, প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের তিন দফা এবং ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের সাত দফা দাবি নিয়ে পাল্টাপাল্টি আন্দোলন এখন মুখ্য আলোচনার বিষয়। এসব কর্মসূচি প্রকৌশল ও কারিগরি শিক্ষাঙ্গন অচল করে দিচ্ছে, সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে পড়ছে।

মূলত এ আন্দোলন এখন ন্যায্য দাবি-দাওয়ার চেয়ে ইগোর লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। দেশের দুই বৃহৎ পেশাজীবী সংগঠন—ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইইবি) এবং ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইডিইবি)—এক্ষেত্রে দুই মেরুতে অবস্থান নিয়েছে। আইইবি প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের পক্ষ নিচ্ছে, অন্যদিকে আইডিইবি ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সরাসরি সমর্থন জানাচ্ছে।

এভাবে পেশাজীবী সংগঠনগুলোর শক্তি প্রদর্শনের ফলে সমস্যার সমাধান না হয়ে বরং সংঘাত আরও ঘনীভূত হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা বিভক্ত হচ্ছে, ভবিষ্যৎ পেশাজীবী সমাজ দ্বিধাবিভক্ত হচ্ছে। অথচ দেশের প্রয়োজন একটি দক্ষ ও সমন্বিত মানবসম্পদভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা, যেখানে কারিগরি ও প্রকৌশল শিক্ষার মধ্যে পারস্পরিক সম্মান ও সহযোগিতা থাকবে। আজ প্রয়োজন অহংকার নয়, আলোচনার মাধ্যমে সমাধান। শিক্ষা খাতকে অস্থিরতা থেকে মুক্ত করে জাতীয় স্বার্থে একটি সমন্বিত কৌশল গ্রহণ করাই এখন সময়ের দাবি।

রাজপথে দ্বন্দ্ব উত্তেজনা

এই বিতর্ক এখন শুধু একাডেমিক অঙ্গনেই সীমাবদ্ধ নেই, পৌঁছে গেছে রাজপথে। শিক্ষার্থীদের দাবি আদায়ে আন্দোলন, অবরোধ, লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাস—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠছে। বুয়েট ভিসি স্বয়ং আন্দোলনকারীদের পাশে দাঁড়িয়ে পুলিশের আচরণকে অগ্রহণযোগ্য বলেছেন। কিন্তু বাস্তবে সমাধানের পথ এখনও অন্ধকারে।

সংকটের মূল কারণ

এ দ্বন্দ্ব আসলে “কনফ্লিক্ট অব ডিসসিপ্লিন”—একাডেমিক মর্যাদা বনাম প্রফেশনাল স্বার্থ। সমস্যা তখনই প্রকট হয় যখন দায়িত্ব ও পদমর্যাদা পরিষ্কারভাবে নির্ধারণ করা না থাকে। উন্নত বিশ্বে প্রকৌশল ও টেকনিক্যাল কাজকে আলাদা ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশে সেই সুস্পষ্ট বিভাজন নেই। ফলে সংঘাত দিন দিন ঘনীভূত হচ্ছে।

উপসংহার

বাংলাদেশের প্রকৌশল খাত দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন, শিল্পায়ন ও প্রযুক্তি অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি। সেখানে যদি একাডেমিক মর্যাদা আর পেশাগত স্বার্থের দ্বন্দ্ব দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পুরো খাত। তাই প্রয়োজন বাস্তবমুখী নীতিমালা, যেখানে মর্যাদা ও অবদান উভয়ই স্বীকৃতি পাবে। অন্যথায়, রাজপথের আন্দোলন থেকে যে বিভাজন শুরু হয়েছে, তা প্রকৌশল অঙ্গনকে আরও বিভক্ত করবে।

বি: দ্র:

সামাধান কোন পথে- এর জন্য দেখুন সম্পাদকীয় প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলন https://odhikarpatra.com/news/31635

এবং

প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের একাডেমিক অবস্থান বুঝতে পড়ুন ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং বনাম বিএসসি ইন ইঞ্জিনিয়ারিং: যোগ্যতার পার্থক্য ও প্রেক্ষাপট (https://odhikarpatra.com/news/31633

 

— লেখক: ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান (লিটু), অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং উপদেষ্টা সম্পাদক, আমাদের অধিকা্রপত্র, odhikarpatranews@gmail.com

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: