
বন্যার অজুহাতে দুর্গত হাওর এলাকায় খাদ্যশস্যের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এ ধরনের কাণ্ড ঘটালে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বন্যাদুর্গত হাওর এলাকা পরিদর্শনকালে গতকাল রোববার সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলা সদরের শাহিদ আলী পাবলিক মডেল উচ্চবিদ্যালয় মাঠে আয়োজিত এক সুধী সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন। শেখ হাসিনা বলেন, ‘দেশে বর্তমানে খাদ্যের কোনো ঘাটতি নেই এবং হাওর এলাকা থেকে দেশের খাদ্য চাহিদার একটি স্বল্প অংশই পূরণ হতো। কাজেই খাদ্যশস্যের সরবরাহ কমতির অজুহাতে কোনোভাবেই খাদ্যের দাম বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার পরীক্ষা করে দেখছে, হাওরাঞ্চলে বাঁধ নির্মাণে কারও গাফিলতি প্রমাণ হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বন্যার পানি নেমে নতুন ফসল ওঠার আগ পর্যন্ত¯ কৃষিঋণের টাকা ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ থাকবে এবং এর প্রদেয় সুদের টাকাও অর্ধেক করে দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী। এ ছাড়া তিনি দুর্গত প্রতিটি পরিবারকে মাসে ৫০০ টাকা এবং কৃষকদের বিনা মূল্যে সার, বীজ, কীটনাশকসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণ দেওয়ার ঘোষণা দেন।
শাল্লার শাহিদ আলী পাবলিক মডেল উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে অবতরণের আগে প্রধানমন্ত্রী হেলিকপ্টারে করে সমগ্র দুর্গত এলাকা ঘুরে দেখেন। এরপর তিনি ওই বিদ্যালয়ের মাঠে সুধী সমাবেশে ভাষণ দেন। ভাষণ শেষে বিদ্যালয় চত্বরে জনগণের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেন। ১ হাজার মানুষের মধ্য থেকে নির্বাচিত ২০ জনের মাঝে প্রত্যেককে ৩৮ কেজি চাল এবং ১ হাজার টাকা করে দেন প্রধানমন্ত্রী।
ত্রাণ বিতরণ শেষে প্রধানমন্ত্রী স্পিডবোটে করে কয়েকটি প্রত্যন্ত¯হাওর ও সংলগ্ন এলাকা পরিদর্শন করেন। ওই সব এলাকা পরিদর্শনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বন্যাদুর্গত ১০০টি পরিবারের মধ্যে তাঁর নিজস্ব তহবিল থেকে নগদ অর্থ ও চাল বিতরণ করেন।
পরিদর্শনকালে প্রধানমন্ত্রী এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলেন এবং তাঁদের খোঁজখবর নেন। তিনি শিশুদের কাছে জানতে চান তারা বছরের প্রথম দিন পাঠ্যবই পেয়েছে কি না, শিশুরা ইতিবাচক জবাব দিয়ে সমস্বরে একসঙ্গে বলে, ‘আমরা বছরের প্রথম দিন পাঠ্যবই পেয়েছি।’
পরিদর্শন শেষে প্রধানমন্ত্রী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে সবাই যেন পর্যাপ্ত ত্রাণসুবিধা পান, তা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন।
এর আগে সুধী সমাবেশে ভাষণে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভয় না পাওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকারের নির্দেশে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, কর্মকর্তা, স্থানীয় প্রশাসনসহ সব মহল নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট রয়েছে। কাজেই খাদ্য সরবরাহ এবং দুর্গত জনগণের সাহায্যের বিষয়ে সংশয়ের কোনো অবকাশ নেই।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি নিশ্চিত করে বলতে চাই, আমরা সব সময় আপনাদের পাশে আছি। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়, বরং জাতির পিতার কন্যা হিসেবে আপনাদের পাশে আছি এবং যখন বিরোধী দলে ছিলাম, যেকোনো দুর্যোগে আমরা আপনাদের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি।’ প্রধানমন্ত্রী তাঁর দলীয় নেতা-কর্মীদের পরিস্থিতি তদারকি এবং সম্ভাব্য সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়ার নির্দেশ দেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভিক্ষুক জাতির কোনো মর্যাদা থাকে না। এ জন্য তাঁর সরকার বিদেশ থেকে কোনো খাদ্য সাহায্য নেবে না। ‘যদি প্রয়োজন হয় আমরা খাদ্য আমদানি করব’—এ কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, একটি মর্যাদাবান জাতি হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে।
হাওর এলাকার গুরুত্ব তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই এলাকার মানুষের জীবনযাত্রার উন্নয়নে সরকার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এই এলাকায় টেকসই বাড়ি নির্মাণ এবং সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। শিশুরা যাতে ঝক্কি-ঝামেলা ছাড়া প্রতিদিন স্কুলে যেতে পারে, সে জন্য হাওর ও পার্বত্য এলাকায় আবাসিক স্কুল তৈরির প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত স্কুলশিশুদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হবে।
আগামী দিনগুলোয় বাণিজ্যিকভাবে মৎস্য চাষের উন্নয়নে হাওর এলাকায় সরকার মাছের পোনা অবমুক্ত করবে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর সরকার হাওর এলাকায় কেবল ধান উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীলতার পরিবর্তে এখানকার জনসাধারণের বহুমুখী জীবিকার পরিকল্পনা নিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর হাওর এলাকা পরিদর্শনকালে তাঁর সঙ্গে ছিলেন কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী, খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নজরুল ইসলাম, অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন এবং স্থানীয় সাংসদ জয়া সেনগুপ্ত।
দুর্যোগ ও ত্রাণ পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বন্যায় সুনামগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের ৬২টি উপজেলার ৫১৮টি ইউনিয়নের ৮ লাখ ৫০ হাজার ৮৮টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২ লাখ ৪৯ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমির বোরো ফসল নষ্ট হয়েছে এবং ১৮ হাজার ২০৫টি বাড়িঘরের পুরোপুরি বা আংশিক ক্ষতি হয়েছে।
এসব এলাকায় ত্রাণ বিতরণের জন্য ৫৮৭টি ত্রাণকেন্দ্র খোলা হয়েছে। ইতিমধ্যে ৪ হাজার ২২৪ মেট্রিক টন জিআর চাল এবং ২ কোটি ২৫ লাখ ৯৭ হাজার টাকা মানবিক সাহায্য হিসেবে দুর্গত ব্যক্তিদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে ভিজিএফ কর্মসূচিও চালু করা হয়েছে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: