ঢাকা | রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫, ৭ বৈশাখ ১৪৩২
করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়বে

শরীরের ইমিউনিটি ধ্বংস করে কার্বাইডে পাকানো আম

Mahbubur Rohman Polash | প্রকাশিত: ১৭ মে ২০২০ ০২:৪১

Mahbubur Rohman Polash
প্রকাশিত: ১৭ মে ২০২০ ০২:৪১

  •  
কার্বাইডে পাকানো আম শরীরের ইমিউনিটি ধ্বংস করে
 

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের এই কঠিন সময়ে দৈনিক কালের কণ্ঠে ১০ মে ২০২০ তারিখের সংবাদটি মর্মন্তুদ লেগেছে। করোনার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে মানুষ যখন হিমশিম খাচ্ছে, কোয়ারেন্টিন ও সোশ্যাল ডিসটেন্সিংসহ নানা রকম প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে, সরকারও যখন মানুষকে নানা বিষয়ে সতর্ক করছে, বিজ্ঞানীরাও তখন মানুষকে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ইমিউনিটি কিভাবে বাড়ানো যায় সে বিষয়ে বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছেন। তাঁরা বলছেন, ইমিউনিটি ভালো থাকলে ও স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চললে করোনা সহজে কাউকে সংক্রমিত করতে পারবে না। পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত যখন করোনার কোনো টিকা বা ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি, তখন যার যার শরীরের ইমিউনিটিকে রক্ষা করার জন্য আমরা কত চেষ্টাই না করছি, কারণ এটাই তো এখন আত্মরক্ষার জন্য আমাদের বর্ম। একে কিছুতেই নষ্ট করা যাবে না, বরং এটা কিভাবে বাড়ানো যায় সেই চেষ্টা করতে হবে। এখন সামনে আমের সময় আসছে। যে আম অসাধু ব্যবসায়ীরা মুনাফার উদগ্র লোভে জোর করে পাকাচ্ছেন সেটা নয়। বরং যেটা প্রকৃতি তার সন্তানদের জন্য অপত্য স্নেহে পাকিয়েছে, যেখানে চমত্কার স্বাদ আর গন্ধ ছাড়াও রয়েছে পুষ্টির জন্য প্রোটিন, ভিটামিন, সুগার, মিনারেল আর মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস্, সেই আম খেলে শরীরে ইমিউনিটি বাড়ে। এটা পৃথিবীজুড়ে বিজ্ঞানীদের কথা। শুধু আম নয়, যেকোনো প্রাকৃতিকভাবে পরিপক্ব বা পাকানো ফলেরই, সেই সঙ্গে শাকসবজিরও ইমিউনিটি বাড়ানোর ক্ষমতা অসীম। তাই করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেলে ইমিউনিটি বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু ফল-সবজি খেয়ে সেই ইমিউনিটি বাড়ানোর বদলে যদি ভেজালের কারণে তা নিজের অজান্তেই কমে যায় তাহলে তা মর্মন্তুদ বৈকি।

কালের কণ্ঠের খবর অনুযায়ী যদিও প্রাকৃতিকভাবে পাকা কোনো জাতের আমই কমপক্ষে আরো ১০-১৫ দিন পরে আসার কথা বাজারে, কিন্তু একশ্রেণির লোভী ব্যবসায়ী বিভিন্ন জাতের কাঁচা অপরিপক্ব আমের মধ্যে ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার করে রঙিন হলুদ টসটসে করে বাজারে বিক্রি করছেন। বাইরে থেকে দেখতে এসব আম নাকি খুবই লোভনীয়, কিন্তু ভেতরটা একেবারে কাঁচা, আঁটি পর্যন্ত শক্ত হয়নি। গত রবিবার ১০ মে রাজধানীর বাদামতলীতে অভিযান চালায় র্যাব এবং সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। মেয়াদোত্তীর্ণ খেজুরও নাকি ছিল সেখানে। কী সর্বনাশ! রোজার উপকরণগুলো নিয়েও অপব্যবসা করতে হবে? র্যাবের মতে আরো সপ্তাহখানেক আগে থেকেই এসব রঙিন কাঁচা আম আড়তগুলোতে বিক্রি হচ্ছিল। 

 

মানুষ মৌসুমি ফলের স্বাদ ও পুষ্টি পাওয়ার জন্য আম কেনে। কিন্তু এসব আমের কোনো স্বাদ নেই, পুষ্টিগুণও নেই। উল্টো এসব আম খেলে শরীরের বিভিন্ন ক্ষতি হয়। কী কী ক্ষতি হয় তা আমরা একযুগেরও বেশি সময় ধরে বলে আসছি। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও গণমাধ্যম তার সাক্ষী। কিন্তু তার পরেও একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী কার্বাইড দিয়ে আম ও অন্যান্য ফল পাকানোর পক্ষে সাফাই গান। তাঁদের পক্ষে টক শোতে ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের বাইরেও কাউকে কাউকে ওকালতিও করতে দেখা যায়। একটি টিভি চ্যানেলের একজন জনপ্রিয় কৃষিবিষয়ক উপস্থাপক তো একবার বলেই বসলেন যে কৃত্রিমভাবে ফল—টমেটো না পাকালে কৃষক নাকি মরে যাবে। এসব কার্বাইড আর বিভিন্ন রকম ‘কৃত্রিম পক্বকারক’ আবিষ্কারের আগে কতজন কৃষক এভাবে মারা গেছে তার হিসাব অবশ্য তিনি দেননি। গত বছর আরেক টক শোতে একজন ব্যবসায়ী প্রতিনিধি র্যাব-পুলিশ-সরকারের মহা সমালোচনা করে বেশ কিছু আম নষ্ট করা হয়েছে বলে খুব দুঃখ প্রকাশ করলেন, কিন্তু একটিবারের জন্যও অনেক মানুষের জীবন বাঁচিয়েছেন বলে তাঁদের ধন্যবাদ দিলেন না। অবশ্য এখন আর এটা আশা করাও যায় না। উদগ্র মুনাফালোভীদের র্যাকেট বলে কথা! তাঁরা মনে করেন রাষ্ট্রটি শুধু এই অসাধু ব্যবসায়ীদেরই, জনগণের নয়।

বর্তমানের এই করোনাকালে যা জানা এবং অন্যদের জানানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো এসব কার্বাইড মেশানো আম ভোক্তার শরীরের ইমিউনিটি নষ্ট করে। অসাধু ব্যবসায়ীরা যেহেতু পিয়ার রিভিউড জার্নালে ছাপা না হলে অন্য কিছু বিশ্বাস করেন না (!), সেহেতু পত্রিকায় জায়গার সীমাবদ্ধতা আছে বলে আমার মতের বিষয়ে আপাতত অতি সাম্প্রতিক (গত দুই বছরের) মাত্র দুটি জার্নালের বক্তব্য নিচে তুলে ধরছি। প্রয়োজনে এ বিষয়ে আরো পরীক্ষা ও জার্নালের রেফারেন্স দেওয়ার জন্য প্রস্তুত আছি।

প্রথমটিতে বলছে, ইঁদুরকে খাবারের সঙ্গে অতি স্বল্প মাত্রায় প্রতি কেজি শরীরের ওজনের জন্য পাঁচ মিগ্রা করে ক্যালসিয়াম কার্বাইড ৩০ দিন খাওয়ানো হয়েছিল। ফলাফল হলো ১৪ দিনের মধ্যে ৮৫ শতাংশ ইঁদুর মারা যায়। ইঁদুরগুলোর শরীরে লোহিত রক্তকণিকা ও হিমোগ্লোবিন কমে যায়, শ্বেত রক্তকণিকা ও প্লেটলেট, বিশেষ করে লিমফোসাইটস, প্রচুর বেড়ে যায়। টোটাল প্রোটিন, এলবিউমিন এবং ইউরিয়াও বেড়ে যায়। 
হিস্টোপ্যাথোলজিক্যাল পরীক্ষায় অতিমাত্রায় প্রয়োগে ইঁদুরের শরীরে বিষাক্ততার লক্ষণ দেখা যায়। ক্যালসিয়াম কার্বাইড নামের কৃত্রিম ফল পক্বকারক ব্যবহারে ইঁদুরের শরীর-অভ্যন্তরস্থ অঙ্গগুলোতে বিষাক্ত প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। এর ফলে প্রদাহের কারণে শরীরের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হয়ে পড়ে। (সূত্র : জার্নাল অব বেসিক ক্লিনিক্যাল ফিজিওলজি অ্যান্ড ফার্মাকোলজি, ২০১৯ নভেম্বর, ২৯:৩১(১), পৃষ্ঠা ১২৬)। 

 

দ্বিতীয়টিতে বলা হয়েছে যে ক্যালসিয়ম কার্বাইড দিয়ে কৃত্রিমভাবে পাকানো দুটি জাতের আমের রস ইঁদুরের খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে তিন সপ্তাহ ধরে খাওয়ানো হয়েছিল। তাদের হেমাটোলজিক্যাল ও প্লাজমা বায়োকেমিক্যাল এনালাইসিস পরীক্ষায় দেখা যায় যে ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে পাকানো আমের রস খাওয়ানো ইঁদুরগুলোর লোহিত রক্তকণিকা, হিমোগ্লোবিন ও প্যাকড্ সেল ভলিউম উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায় এবং শ্বেত রক্তকণিকা ও লিম্ফোসাইট বেড়ে যায়। তাছাড়া ক্রিয়েটিনিন, প্রোটিন, কোলেস্টেরল, পটাশিয়াম ও বাইকার্বোনেট কমে যায় এবং এলবিউমিন ও বিলিরুবিন উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। এসব পরীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে যে ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে পাকানো আম ভোক্তার হেমাটোলজিক্যাল ও প্লাজমা বায়োকেমিক্যাল প্রোফাইলের পরিবর্তন ঘটিয়ে লোহিত রক্তকণিকার ধ্বংস বাড়িয়ে দেয়, তিনটি প্রধান সেল লাইনকে অবদমিত করে এবং কিছু খনিজ ও ভিটামিনের কাজে ও লিপিড মেটাবোলিজমে বাধা দেয়। এভাবে একের পর এক ঘটনার ফলে নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়, যার মধ্যে রয়েছে জীবাণু সংক্রমণ ঠেকাতে শরীরের সক্ষমতা হ্রাস এবং কার্বাইড খাওয়াকালে শরীরের সম্পূর্ণ ইমিউনিটি সিস্টেম দুর্বল হয়ে যাওয়া। (সূত্র : ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ফুড সাইন্স অ্যান্ড নিউট্রিশন ইঞ্জিনিয়ারিং, ২০১৮, ৮(২): ২৭-৩৬)।

তাই আসুন, আমরা সতর্ক হই। রঙিন দেখলেই আম না কিনি। যেন মনে রাখি যে প্রতিটি আমের বাজারে আসার একটি প্রকৃতি নির্ধারিত সময় আছে। এর আগে যে আম বাজারে পাওয়া যায় সেগুলো অপরিপক্ব এবং কার্বাইড বা এথ্রিল ধরনের কেমিক্যাল দিয়ে রং করা হয় (পাকানো হয়, বলা হয় ঠিক নয়, কারণ আমটা পাকে না, শুধু রঙিন হয়)। আসুন, নিজের শরীরের সুরক্ষার দিকে তাকাই। বিশেষ করে করোনার এই ভয়াল আক্রমণের দিনগুলোতে কিছুতেই শরীরের ইমিউনিটিকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে বরং বাড়ানোর চেষ্টা করি। বিশেষ করে যখন করোনার সংক্রমণের এবং মৃত্যুর সংখ্যা সম্প্রতি আরো বেড়ে যাচ্ছে তখন আরো সতর্ক হয়ে এসব ভেজাল আম বর্জন করি। 

র‍্যাব-পুলিশ-মাঠ প্রশাসনসহ সরকারকে অভিনন্দন যে তারা বিগত দুই বছর কোনো আম যেন গ্রোথ হরমোন দিয়ে দ্রুত বড় করতে না পারে কিংবা কার্বাইড দিয়ে পাকাতে না পারে সে জন্য কঠোর হয়েছে। কেউ ফাঁকি দিয়ে এসব অপকর্ম করে থাকলে জনকল্যাণে ও জনস্বাস্থ্য রক্ষায় এসব দূষিত আম ধ্বংস করে সঠিক কাজটি করেছেন। এ বছরও তা করা দরকার। করোনা ঠেকানোর জন্য অন্য সব প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার মতো কৃত্রিমভাবে পাকানো আম যেন কেউ না খায় তা নিশ্চিত করাও জরুরি। জনস্বাস্থ্য রক্ষায় কোনো আপোস নয়। আমরা অসাধু ব্যবসায়ীদের হাতে বন্দি থাকতে চাই না। বরং আমরা চাই বাংলাদেশের সবাই সাধু ব্যবসায়ী হোন। আমরা যেন খাবার-ওষুধ-প্রসাধন সব কিছুতেই ভেজালমুক্ত ও স্বনির্ভর হতে পারি সে জন্য অসাধু ব্যবসায়ীদের ব্যাপকভাবে বড় শাস্তি ও সাধু ব্যবসায়ীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত করা হোক। ফলে আমাদের ব্যবসায়ীরা ভালো ওষুধ-খাদ্য-প্রসাধন উত্পাদনে বেশি প্রতিযোগিতায় আসবেন। আমরা যেন বিদেশি পণ্যের বাজার না হই। 

তবে বাদামতলীর অসাধু ব্যবসায়ীদের যে পরিমাণ জরিমানা করা হয়েছে তা জনস্বাস্থ্যের ক্ষতির বিবেচনায় সামান্য। এই জরিমানা আরো ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে দৃষ্টান্তমূলক করার জন্য আমরা সরকারের কাছে আবেদন জানাই। 

জানি লোকবলের সংকট রয়েছে। ভেজালের এই সমস্যা কোনো আজকের সমস্যা নয়। অতীতের অনেক সরকারের আমলে এই ভেজাল দেওয়ার সংস্কৃতি শুরু হলেও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা ও আইনের অভাবে এই সমস্যা ফুলে ফেঁপে উঠেছে। কিন্তু বছর পাঁচেক আগে তো আইন করা হয়েছে, শুধু বাস্তবায়নের সমস্যা। এই ভেজালবিরোধী অভিযানগুলো কি কোনো উপায়ে আরো ঘন ঘন ও সারা দেশে করা যায় না? 

লেখক : অধ্যাপক ও পরিচালক, বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: