ঢাকা | সোমবার, ২১ এপ্রিল ২০২৫, ৮ বৈশাখ ১৪৩২
সুপ্রিম কোর্ট চত্বর থেকে ভাস্কর্য অপসারণ

ক্ষোভ–বিক্ষোভ, পুলিশের বাধা

Admin 1 | প্রকাশিত: ২৭ মে ২০১৭ ১৮:০৩

Admin 1
প্রকাশিত: ২৭ মে ২০১৭ ১৮:০৩

সুপ্রিম কোর্টের মূল চত্বর থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে আলোচিত ভাস্কর্যটি। প্রবেশমুখ থেকে এটি নামিয়ে এখন ত্রিপলে মুড়িয়ে সুপ্রিম কোর্টের বর্ধিত ভবনের পেছন দিকে রাখা হয়েছে। ভাস্কর্য অপসারণের প্রতিবাদে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্ষোভ-বিক্ষোভ হয়েছে। রাজধানীতে বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও জলকামানের পানি ছুড়েছে।

 হেফাজতে ইসলামসহ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দল ও সংগঠন ভাস্কর্যটি সরিয়ে ফেলার দাবি জানিয়ে আসছিল। তাদের দাবির সাড়ে তিন মাসের মাথায় এটি সরানো হলো। দাবি আদায় হওয়ায় রাজধানীর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সামনের সড়কে ‘শুকরিয়া’ আদায় করে মিছিল করেছে ধর্মভিত্তিক দল ও সংগঠনগুলো।

ভাস্কর্যটি রাখা না-রাখা নিয়ে বিভিন্ন মহলে কয়েক মাস ধরে তর্ক-বিতর্ক চলছিল। ভাস্কর্যটির যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন প্রধানমন্ত্রীও। শেষ পর্যন্ত গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে ভাস্কর্যটি অপসারণের কাজ শুরু করে গতকাল ভোরে তা শেষ করা হয়। ভাস্কর্যটি এখন কোথায় স্থাপন করা হবে নাকি হবে না, তা কেউ স্পষ্ট করে বলতে পারছেন না।

ভাস্কর্য সরানোর প্রতিবাদে শাহবাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গতকাল শুক্রবার দুপুরের দিকে ছাত্র ইউনিয়ন, অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট ও ব্লগার, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, গণজাগরণ মঞ্চ, ছাত্র-শিক্ষক-লেখক-শিল্পী-সংস্কৃতিক কর্মী ও নাগরিকবৃন্দসহ বিভিন্ন সংগঠন বিক্ষোভ মিছিল বের করলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও রঙিন পানি ছিটিয়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এতে আহত হয়েছেন ১০ জন, গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৪ জনকে।

ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে গত বছরের ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে সুপ্রিম কোর্টে প্রবেশের মূল ফটক বরাবর লিলি ফোয়ারায় ভাস্কর্যটি বসানো হয়। দেড় মাসের মাথায় এটিকে গ্রিক দেবীর মূর্তি দাবি করে অপসারণের জন্য সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের দপ্তরে লিখিত আবেদন জানান আওয়ামী ওলামা লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাসান শেখ শরীয়তপুরী। এরপর ৬ ফেব্রুয়ারি হেফাজতের আমির শাহ আহমদ শফী বিবৃতি দিয়ে ভাস্কর্যটি অপসারণের দাবি জানান। দাবি আদায় না হলে তাঁরা কঠোর আন্দোলনের হুমকি দেন। হেফাজতের সর্বশেষ বিবৃতিতে রমজান মাস শুরু হওয়ার আগেই ভাস্কর্যটি অপসারণের দাবি জানানো হয়।

১১ এপ্রিল গণভবনে কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসের সরকারি স্বীকৃতি ঘোষণার রাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই এই ভাস্কর্য নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘সত্য কথা বলতে কি, আমি নিজেও এটা পছন্দ করিনি। কারণ, গ্রিক থেমিসের মূর্তি আমাদের এখানে কেন আসবে? এটা তো আমাদের দেশে আসার কথা না।’ ২১ এপ্রিল চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ রমজান মাস শুরুর আগে ভাস্কর্যটি সরাতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়।

গত বৃহস্পতিবার দুপুরে এ বিষয়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের মতামত নেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। আইনজীবীদের একটি সূত্র জানায়, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক ও বর্তমান সভাপতি এবং সম্পাদকদের ডাকেন প্রধান বিচারপতি। তাঁর খাসকামরায় বেলা দেড়টা থেকে সোয়া দুইটা পর্যন্ত আইনজীবী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক চলে। ওই আলোচনায় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ড. কামাল হোসেন, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, খন্দকার মাহবুব হোসেন, রোকনউদ্দিন মাহমুদ, এ জে মোহাম্মদ আলী, বর্তমান সভাপতি জয়নুল আবেদীন, সাবেক সম্পাদক নুরুল ইসলাম সুজন, মাহবুব আলী, এ এম আমিন উদ্দিন ও শ ম রেজাউল করিম এবং বর্তমান সম্পাদক মাহবুব উদ্দিন খোকন উপস্থিত ছিলেন।

জয়নুল আবেদীন গতকাল বলেন, ‘মূলত আমাদের ডেকেছিলেন বিচার বিভাগের জন্য বার (আইনজীবী সমিতি) কীভাবে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে, সে বিষয়ে আলোচনার জন্য। আলোচনায় ভাস্কর্যের বিষয়টিও ওঠে। উনি (প্রধান বিচারপতি) বলেন, যেহেতু এটি নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে, দেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে এ নিয়ে বিতর্ক হোক তা তিনি চান না। আমরাও বললাম, যেহেতু আপনি দেশের প্রধান বিচারপতি, কাজেই দেশের প্রধান বিচারপতি বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকবেন, এটিই স্বাভাবিক। প্রধান বিচারপতি বলেছিলেন, যেকোনো সময় ভাস্কর্যটি সরিয়ে ফেলা হবে।’

ভাস্কর্য তৈরি প্রসঙ্গ

গতকাল যোগাযোগ করা হলে ভাস্কর মৃণাল হক বলেন, সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃপক্ষের মৌখিক আদেশে তিনি ১৭-১৮ লাখ টাকা খরচ করে ভাস্কর্যটি তৈরি করে সেখানে স্থাপন করেন। এখন পর্যন্ত বিলও পাননি।

হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার (প্রশাসন ও বিচার) মো. সাব্বির ফয়েজ বলেন, সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃপক্ষ সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য গণপূর্ত অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে দায়িত্ব দেয়। লিলি ফোয়ারার জন্য নতুন ঝরনা, লাইটিংসহ আরও কয়েকটি বিষয় ছিল। গণপূর্ত বিভাগ ভাস্কর মৃণাল হককে নতুন ওই ড্যান্সিং ফোয়ারার দায়িত্ব দেয়। এই বাজেটের ভেতরেই ভাস্কর্যের বিষয়টি আলোচনা করে যুক্ত করেন শিল্পী মৃণাল হক। এ ক্ষেত্রে বাজেট কত ছিল, তা গণপূর্ত অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট পূর্ত এবং ইএম বিভাগ বলতে পারবে। প্রশাসনিক অনুমোদন দিয়ে প্রাক্কলন গণপূর্ত অধিদপ্তরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়ে থাকে। পরে প্রক্রিয়া অনুসারে সংশ্লিষ্ট বিভাগ কার্যক্রম পরিচালনা করে।

লেখক-সাংবাদিক সৈয়দ আবুল মকসুদ এই ভাস্কর্য স্থাপন ও সরানোর প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে গতকাল বলেন, এই ভাস্কর্য স্থাপন প্রকল্পটির সিদ্ধান্ত কবে গৃহীত হয় এবং সে ব্যাপারে কোনো দরপত্র হয়েছিল কি না, তা জানা যায়নি। এটি স্থাপনের ব্যয়ই বা কত ধার্য করা হয়েছিল, তা-ও অজানা। এ ব্যাপারে সরকার থেকে একটি স্পষ্ট বক্তব্য থাকা দরকার, যেহেতু টাকাটা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে যাচ্ছে। এটি বসানো ও সরানো—দুটোর কারণই সাধারণ মানুষের কাছে অস্পষ্ট।

 


আপনার মূল্যবান মতামত দিন: