ঢাকা | শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১

নিয়মিত কোল্ড ড্রিংকস্ খাওয়া থেকে সাবধান

আ ব ম ফারুক | প্রকাশিত: ৩০ এপ্রিল ২০২২ ১১:৫২

আ ব ম ফারুক
প্রকাশিত: ৩০ এপ্রিল ২০২২ ১১:৫২

 

আ ব ম ফারুক
অধ্যাপক ও পরিচালক, বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


কোমল পানীয় হিসেবে কোল্ড ড্রিংকস্গুলোর জনপ্রিয়তা নিয়ে আজ আর সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। সব বয়সের মানুষই নির্দ্বিধায় এর দিকে হাত বাড়ায়, শুধু ঠান্ডা পানির বিকল্প হিসেবেই নয়, এর স্বাদের জন্যও। উন্নত বিজ্ঞাপন ও বাজার কৌশলের মাধ্যমে এসব পানীয় বিক্রিও হয় দেদার। প্রস্তুতকারকরাও ক্রেতাদের মনে এমন একটি ধারণা সুকৌশলে গেঁথে দিয়েছে যে এসব পানীয় আধুনিকতার আর তারুণ্যের প্রতীক এবং যতোই ব্যবহার করা হোক না কেন, নিরাপদ।

বাংলাদেশে আমরা গত কয়েক বছর ধরে কোল্ড ড্রিংকস্ প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা প্রত্যক্ষ করছি। নিত্যনতুন বাজার কৌশলেরই অংশ হিসেবে এরা আয়োজন করে লটারির, ঘোষণা করে আকর্ষণীয় হরেক পুরষ্কার। তারা মানুষকে লোভে ফেলে অবচেতনভাবে ঠেলে দিচ্ছে তাদের সামগ্রী কেনার নেশায়। মানুষ নেশার ঘোরে বাধ্য হচ্ছে কোল্ড ড্রিংকসের অপ্রয়োজনীয় এবং কখনো কখনো অতিরিক্ত পানে।

অথচ এই নেশা ও লোভে না পড়লে যে টাকা দিয়ে কোল্ড ড্রিংকস্ কেনা হচ্ছে সে টাকায় তারা পুষ্টিকর খাবার কিনতে পারতো। আমিষ ও ক্যালরি ঘাটতির এ দেশে এই ক্ষতি একটি জাতীয় ক্ষতি। এছাড়া সুস্বাস্থ্যের ওপর অত্যধিক কোল্ড ড্রিংকস্ পানের যে ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে সে দিকটিও উপেক্ষণীয় নয়।

কোল্ড ড্রিংকসে সাধারণভাবে থাকে সোডিয়াম বাইকার্বোনেট, সাইট্রিক এসিড ও টারটারিক এসিড। খাওয়ার সোডা বা সোডি বাই কার্ব নামে পরিচিত এই সোডিয়াম বাইকার্বোনেট পানির উপস্থিতিতে সাইট্রিক এসিড ও টারটারিক এসিডের সাথে বিক্রিয়া করে। ফলে তৈরি হয় কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাস। ছিপিবদ্ধ অবস্থায় এই গ্যাস বোতলের পানিতে প্রবল চাপে দ্রবীভূত আবস্থায় থাকে এবং ছিপি খোলামাত্র অর্থাৎ প্রবল বায়ুচাপ অপসারিত হওয়ার সাথে সাথে বুদ্বুদ্ আকারে বেরিয়ে আসতে থাকে। তবে এরপরেও বেশ কিছু গ্যাস পানিতে মিশে থাকে, যা অতি ধীরে ধীরে নির্গত হয়, যে কারণে কোল্ড ড্রিংকসের অন্য একটি নাম হলো কার্বোনেটেড ওয়াটার বা বেভারেজ। এই কার্বোনেটেড ওয়াটার খাওয়ার সময় এক ধরণের ঝাঁজালো আ স্বাদের পাশাপাশি নির্গত হতে থাকা বুদ্বুদেরও একটি মুড়মুড়ে স্বাদ পাওয়া যায়।

মিষ্টত্ব আনার জন্য কোল্ড ড্রিংকসে দেয়া হয় কিছু চিনির সিরাপ, সরবিটল, ম্যানিটল ও স্যাকারিন। এছাড়া যোগ করা হয় কিছু প্রিজারভেটিভ, সুগন্ধি ও কোনো কোনোটিতে কৃত্রিম রং। কিন্তু মানুষ জানে না যে কমলার বণর্, গন্ধ ও স্বাদযুক্ত কোল্ড ড্রিংকসে এক ফোঁটাও কমলার রস নেই। যেমন নেই লেবুর গন্ধযুক্ত পানীয়তে লেবুর কোন উপস্থিতি। এসবের সবটাই কৃত্রিম। যদিও মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য এসবের বিজ্ঞাপনে কমলা বা লেবুর তরতাজা ছবি ব্যবহার করা হয়।

মানুষকে আকৃষ্ট করার কায়দা অবশ্য এই কোম্পানিগুলো ভালোই জানে। বিগত শতাব্দীজুড়ে বিখ্যাত পানীয় কোকা কোলা বিজ্ঞাপন দিত ‘আইডিয়াল ব্রেইন টনিক’ বলে। বিজ্ঞাপনে বলা হতো কোকা কোলা পানে মাথাধরা, মাথা ব্যথা ও ক্লান্তি দূর হয়। সর্বনাশা নেশা সৃষ্টিকারী মাদক কোকেন পাওয়া যায় কোকা পাতা থেকে। তখন অভিযোগ ছিলো যে কোকা কোলাতে কোম্পানি কোকা পাতার নির্যাস বা এক্সট্রাক্ট কিছুটা মিশিয়ে দিত। ফলে অই এক্সট্রাক্টের সামান্য কোকেনের উপস্থিতিতে কোকা কোলা মাথাব্যথা ও ক্লান্তি কিছুটা দূর করে শরীরকে উদ্দীপ্ত করতো। মানুষও বারবার এটা খেতে চাইতো। এভাবে সারা শতাব্দী জুড়ে ব্যবসা করেছে কোম্পানি। সারা আমেরিকা জুড়ে প্রবল সমালোচেনার মুখে ১৯২০ সালে কোম্পানি বোতলের গায়ে লিখতে শুরু করলো যে তারা কোকা পাতার নির্যাস থেকে কোকেনকে বাদ দিয়ে সেই নির্যাস ব্যবহার করছে। কিন্তু ১৯২০-এর আগে তারা কোকেনযুক্ত নির্যাস মিশিয়েছে কিনা এসম্পর্কে কোন উচ্চবাচ্য করেনি। দুনিয়ায় এত জিনিস থাকতে কোকা কোলার কোম্পানি কেন কোকা পাতার নির্যাস তাদের পানীয়ে মিশাতো তা বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

কোল্ড ড্রিংকস্গুলোতে যেসব উপাদান মেশানো হয় আপাতদৃষ্টিতে সেগুলো নিরাপদ মনে হলেও দীর্ঘদিন ধরে বা অতিরিক্ত ব্যবহারে এসব উপাদানও শরীরের ক্ষতি করতে পারে।

কৃত্রিম রংগুলোর কথাই প্রথমে ধরা যাক। এদের অধিকাংশই শরীরের জন্য ক্ষতিকর। যেগুলো ক্ষতিকর নয় বা কম ক্ষতিকর বলে দীর্ঘদিনের গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে সেগুলোকে বিজ্ঞানীরা তিনভাগে ভাগ করেছেন। এক, যেসর রং খাদ্য ওষুধ ও প্রসাধনীতে ব্যবহার করা হয়। দুই, যেগুলোকে খাদ্যে নয় তবে ওষুধ ও প্রসাধনীতে ব্যবহার করা যেতে পারে। অর্থাৎ এই গ্রুপের রংগুলো প্রথম গ্রুপের চাইতে কম নিরাপদ বলে এগুলোকে খাদ্যে ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কারণ পরিমাণগত বিবেচনায় ওষুধ বা প্রসাধনীর চাইতে খাদ্যের মাধ্যমে অনেক বেশি পরিমাণ রং শরীরে প্রবেশ করে। তিন, ঠোঁট মুখমন্ডল ও হাত বাদে শরীরের অন্যান্য অংশের প্রসাধনীতে ব্যবহার্য রং। অর্থাৎ এই রংগুলো যাতে কোনভাবে মুখের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করতে না পারে সেবিষয়ে সতর্কতা নেয়া হয়েছে। এই তিনভাগের বাইরে যেসব রং সেগুলো ক্ষতিকর এবং এগুলো কাপড় রাঙানো থেকে শুরু করে বিবিধ কাজে ব্যবহৃত হয়।

উপরের এই তিন ধরণের কৃত্রিম রংয়ের মধ্যে সবচেয়ে নিরাপদ হচ্ছে প্রথম গ্রুপের ‘ফুড কালার’ রংগুলো। একটু বেশি পরিমাণে খেলেও এগুলোতে স্বাস্থ্যহানির কারণ নেই বলে আন্তর্জাতিকভাবে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক এগুলো খাদ্য ও পানীয়তে ব্যবহারের জন্য অনুমোদিত। কিন্তু এই বিশ্বাসেও প্রথম বড় ধাক্কাটি আসে ১৯৭৫ সালে, যখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘এমারান্থ’ নামের একটি লাল রং ও ‘টারট্রাজিন’ নামের একটি হলুদ রংয়ের ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কারণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রথমে ছাড়পত্র দিলেও পরবর্তীকালের গবেষণায় ধরা পড়েছে যে সবচেয়ে নিরাপদ গ্রুপের বলে এতকাল ধরে পরিচিত এই দুটি রং নিয়মিত ব্যবহারে মানবদেহে ক্যান্সার সৃষ্টির আশংকা রয়েছে। এই ঘটনার পর থেকে নিরাপদ বলে পরিচিত রংগুলোকেও আর নিরাপদ বলা যায় কিনা সে বিষয়ে ঘোরতর সন্দেহ দেখা দেয়।

কোল্ড ড্রিংকসে যে সাইট্রিক এসিড থাকে সেটি সম্পর্কেও কথা রয়েছে। ঘন ঘন কোল্ড ড্রিংকস্ সেবনে এই সাইট্রিক এসিড দাঁতের ওপরিভাগকে ক্ষয় করে এর চক্চকে ভাবকে নষ্ট করে দেয়। একারণে যে কোল্ড ড্রিংকস্ যত বেশি টক স্বাদের, তার উপরিউক্ত ক্ষতি করার ক্ষমতাও তত বেশি।

কোল্ড ড্রিংকসের অন্য যে উপাদানটি ক্ষতিকর সেটি হলো সোডিয়াম বাইকার্বোনেট। প্রতিটি কোল্ড ড্রিংকসেই এর উপস্থিতি রয়েছে এবং প্রচুর বুদবুদ্ সৃষ্টি করার জন্য একে পরিমাণে বেশিই ব্যবহার করা হয়। সোডিয়াম বাইকার্বোনেট নিয়মিত বা অধিক মাত্রায় ব্যবহারে শরীরে রক্তের ক্ষারত্ব বৃদ্ধি বা এ্যালকালোসিস্ সৃষ্টি হয়, যা স্বাভাবিক নয়। এই এ্যালকালোসিস্ ৫ বছরের কম বয়সী বাচ্চা এবং বৃদ্ধদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হতে পারে। বৃদ্ধদের মধ্যে যাদের কিডনীর জটিলতা বা প্রস্রাবের কষ্ট রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে সোডিয়াম বাইকার্বোনেট অর্থাৎ কোল্ড ড্রিংকস্ পরিহার করা উচিত। এ্যালকালোসিসের সাধারণ লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে দ্রুতলয়ের শ্বাসপ্রশ্বাস, মাংসপেশীর দুর্বলতা ও মানসিক সমস্যাদি।

এছাড়া কোল্ড ড্রিংকসের কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাস অস্বস্তিকর ঢেঁকুর বা বেলচিং সৃষ্টি করে, যা বিশেষ করে অ¤øাধিক্যের রোগীদের জন্য ক্ষতিকর। কারো কারো ক্ষেত্রে কোল্ড ড্রিংকস্ একারণেই পাকস্থলীর খিঁচ ধরা ব্যথা ও অগ্নিমান্দ্য সৃষ্টি করে।

যাদের রক্তে ক্যালসিয়ামের গড় উপস্থিতি কম তাদের ক্ষেত্রে কোল্ড ড্রিংকসের সোডিয়াম বাইকার্বোনেট মাংসপেশীর অস্বস্তিকর কাঁপুনি সৃষ্টি করতে পারে।

আগেই বলেছি, কোল্ড ড্রিংকসের সোডিয়াম বাই কার্বোনেট ও সাইট্রিক এসিড পরস্পর বিক্রিয়া করে। এর ফলে কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাস ছাড়াও তৈরি হয় সোডিয়াম সাইট্রেট। প্রশ্ন উঠতে পারে যে সোডিয়াম বাইকার্বোনেট যখন সোডিয়াম সাইট্রেটে রূপান্তরিত হচ্ছে তাহলে আর অসুবিধা কি? এর উত্তর হচ্ছে, শরীরে প্রবেশ ও পাকস্থলী পার হয়ে রক্তে পৌঁছার পর এই সোডিয়াম সাইট্রেটের আবার সোডিয়াম বাইকার্বোনেটে রূপান্তর ঘটে। ফলে সম্ভাব্য সকল ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া এ থেকে পাওয়ার আশংকা থেকেই যায়।

বিশ্বজুড়ে চিকিৎসক ও ওষুধবিজ্ঞানীদের মতে রক্তনালীতে জমাটবদ্ধতাজনিত হৃদরোগ বা কনজেসটিভ হার্ট ফেলিউর, মূত্রকৃচ্ছতা, লিভারের কার্যকারিতার গোলমাল, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদিতে আক্রান্ত রোগীদেরকে সোডিয়াম বাইকার্বোনেট না দেয়াই ভালো। নিতান্তই জরুরি প্রয়োজন হলে ‘উইথ এক্সট্রিম কশান্’ অর্থাৎ ‘চূড়ান্ত সতর্কতার সাথে তা দিতে হয়। কর্টিকোস্টেরয়েডজাতীয় ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা চলছে এরকম রোগীদের ক্ষেত্রেও এর ব্যবহারে সমান সাবধানতা প্রয়োজন। বাংলাদেশে যে হারে কোনো বিচার বিবেচনা না করে কোল্ড ড্রিংকস্ খাওয়া হচ্ছে তাতে আঁত্কে ওঠতে হয় বৈকি।

ভাতের বা খাবারের সাথে অতিরিক্ত লবণ খেতে যাদেরকে চিকিৎসকেরা বারণ করেছেন তাদেরও একই কারণে কোল্ড ড্রিংকস্ খাওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত।

ব্যথা কমানোর ওষুধ ডাইফ্লুনিসাল, জীবাণুপ্রতিরোধী সিপ্রোফ্লক্সাসিন পিভামপিসিলিন ও টেট্রাসাইক্লিন, যক্ষার ওষুধ রিফামপিসিন, ছত্রাকনাশক ইট্রাকোনাজোল ও কেটোকোনাজোল, ম্যালেরিয়ার ওষুধ ক্লোরকুইন ও হাইড্রক্সিক্লোরকুইন, মনোচিকিৎসায় ব্যবহৃত ফেনোথায়াজিন গ্রুপের সকল ওষুধ এবং রিউমাটয়েড আর্থাইটিসে ব্যবহৃত পেনিসিলামিনের বিশোষণ কমিয়ে দেয় এই কোল্ড ড্রিংকসের সোডিয়াম বাইকার্বোনেট। অর্থাৎ উপরিউক্ত ওষুধগুলোর যে কোনোটি সেবনরত রোগী কোল্ড ড্রিংকস্ খেলে ওষুধের অভীষ্ট কার্যকারিতা কমে যাবে।

হৃদপিনডের ছন্দোহীন স্পন্দন বা এরিদ্মিয়ার ওষুধ ফ্লিকেনাইড ও মেক্সিলেটিন, এবং হৃদপিনডের অতিস্পন্দন বা টেকিকার্ডিয়ার ওষুধ কুইনিডিন ইত্যাদি সেবনরত রোগীরা কোল্ড ড্রিংকস্ খেলে তাতে সোডিয়াম বাইকার্বোনেটের উপস্থিতির কারণে উপরিউক্ত ওষুধগুলো শরীর থেকে যথাসময়ে বের হয়ে যায় না। ফলে ওষুধগুলোর কার্যকারিতায় গোলযোগ দেখা দেয় এবং স্বাভাবিক মাত্রা বা ডোজ গ্রহণের পরেও রোগী মাত্রাধিক্যের লক্ষণাদিতে আক্রান্ত হতে পারেন, যা কোনভাবেই কাঙ্খিত নয়। এসব ক্ষেত্রে কোল্ড ড্রিংকস্ খাওয়ার লোভ একান্তই সংবরণ করা না গেলে রোগীর উচিত হবে চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে ওষুধগুলোর মাত্রা পুনর্নির্ধারণ করে নেওয়া।

সোডিয়াম বাইকার্বোনেটের উপস্থিতির কারণেই কোল্ড ড্রিংকসের দীর্ঘদিন বা অতিরিক্তি ব্যবহারে রক্তের প্লাজমাতে লিথিয়ামের পরিমাণ কমে যায়। মানসিক ভারসাম্য বা সুস্থিরতা রক্ষার জন্য লিথিয়াম প্রয়োজনীয়। রক্তরসে লিথিয়াম কমে গেলে তাই মানসিক অবসাদ বা ডিপ্রেশন কিংবা মনোবৈকল্য বা ম্যানিয়া দেখা দিতে পারে।

অনেকেরই বিশ্বাস যে ভুঁড়িভোজনের সাথে কোল্ড ড্রিংকসের সম্পর্ক রয়েছে। তাদের বক্তব্য এতে খাবারদাবার বিশেষ করে চর্বিযুক্ত খাবারগুলো সহজে হজম হতে বিশেষ সুবিধা হয়। কী সুবিধা হয় বা কিভাবে হয় তার কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তারা হাজির করতে পারেননি। আর পারেননি বলেই রক্ষা। নইলে প্রস্তুতকারকরা এটিকে পুঁজি করেই রেডিও-টিভিতে বিজ্ঞাপনের বন্যায় কান ঝালাপালা করে দিতো।

বরং এর উল্টোটাই সত্য। বিশ্বখ্যাত জার্নাল এনালস্ অব ইন্টারনাল মেডিসিন-এ ১৯৮৪ সালে একটি গবেষণা প্রকাশিত হয় (সংখ্যা ১০১, পৃষ্ঠা ৬৪৯), যার সারমর্ম হলো ৩১ বছর বয়সী এক যুবক ধুম্সে উপাদেয় খাবার খেয়ে সামান্য সোডিয়াম বাইকার্বোনেট খায় হজমের ‘সুবিধার’ জন্য। যুবকটির পাকস্থলী ছিঁড়ে যায়। দেখা যাচ্ছে কোল্ড ড্রিংকস্ শুধু বৃদ্ধদেরই নয়, যুব বয়সীদেরও ক্ষতি করতে পারে। এধরণের আরো অজস্র বৈজ্ঞানিক উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।

তবে কোল্ড ড্রিংকসের সবচেয়ে অসহায় শিকার হচ্ছে শিশুরা। প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোর চতুর বাজার-কৌশলের চটকদার বিজ্ঞাপনে তরুণ-তরুণী মডেলদের লাফঝাঁপ দেখে (বেচারা মডেল! কিছু টাকার জন্য তারা কত কিছুই না করে ও বলে!) এই বাচ্চারা কোল্ড ড্রিংকসের বিভিন্ন ব্রান্ডের প্রতি আকৃষ্ট হয়। সাধারণত বাচ্চারা যেসব ব্রান্ডের দিকে আকৃষ্ট হয় সেগুলোতে থাকে প্রচুর রং। এসব কৃত্রিম রং ক্যান্সার তৈরি করে কিনা তা এখনি নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়, আগামীদিনের গবেষণা হয়তো এর সঠিক উত্তর দেবে। কিন্তু ততদিন এসব প্রস্তুতকারকের কথায় বিশ্বাস করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তবে কৃত্রিম রং সম্পর্কে এখনই যে সন্দেহ ঘোরতরভাবে করা যায় তাহলো এগুলো বাচ্চাদের লিভার ও কিডনির ক্ষতি করতে পারে।

বাচ্চাদের দাঁতে শক্ত এনামেলের ভাগ কম এবং তুলনামূলকভাবে নরম ডেনটিনের ভাগ বেশি থাকে বলে কোল্ড ড্রিংকসে ব্যবহৃত সাইট্রিক এসিড বড়দের চাইতেও বাচ্চাদের দাঁতের ক্ষতি করতে পারে বেশি। আর আগেই বলেছি, যে কোল্ড ড্রিংকস্ যতো বেশি টক, সাইট্রিক ও টারটারিক এসিডের বেশি উপস্থিতির কারণে সেটায় ক্ষতির সম্ভাবনা তত বেশি।

এক থেকে ৫ বছর বয়সী বাচ্চাদের জন্য সোডিয়াম বাইকার্বোনেটের নিরাপদ মাত্রা ১০০ মিলিগ্রামের বেশি নয়। কিন্তু কোল্ড ড্রিংকসের একেকটি বোতলে এটি ব্যবহার করা হয় এর কমপক্ষে ২৫ গুণ। কোল্ড ড্রিংকস্ বাচ্চাদের কী পরিমাণে ক্ষতি করতে পারে তা এই হিসাব থেকে সহজেই অনুমান করা যায়।

কোল্ড ড্রিংকসের সোডিয়াম বাইকার্বোনেট বড়দের যেসব ক্ষতি করতে পারে, বাচ্চাদেরও সেই সবগুলো ক্ষতি করার সম্ভাবনা রয়েছে। বরং বলা চলে, বাচ্চাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোর অপরিপক্কতার কারণে বড়দের চাইতে ক্ষতির সম্ভাবনা বাচ্চাদের ক্ষেত্রে থাকে দ্বিগুণ থেকে চতুর্গুণ। তাছাড়া বড়দের জন্য যে পরিমাণটুকু অতিরিক্ত নয়, শারীরিক আকারের ক্ষুদ্রতার কারণে সেই ‘নিরাপদ’ পরিমাণটুকুও বাচ্চাদের জন্য অনেক বেশি অতিরিক্ত।

১৯৮৭ সালে ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল-এ সি জি উড্স ও তাঁর সহযোগীদের একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় (সংখ্যা ২৯৪, পৃষ্ঠা ৮৬৯)। তাতে দেখা যায়, সাইট্রিক এসিড ও সোডিয়াম বাইকার্বোনেট দিয়ে তৈরি একটি বুদ্বুদময় পানীয় ৭ জন বাচ্চাকে খাওয়ানোর পর বিষক্রিয়ায় একজনের তাৎক্ষণিকভাবেই বমি শুরু হয়।

বাচ্চাদের শরীরে সোডিয়াম বাইকার্বোনেটের বিষক্রিয়ার আরেকটি উদাহরণ দিয়েই এই লেখা শেষ করবো। ১৯৮৩ সালে কানাডিয়ান মেডিক্যাল এসোসিয়েশন জার্নাল-এ (সংখ্যা ১২৮, পৃষ্ঠা ৮২১) এম এস পুক্জিনস্কি ও তাঁর সহযোগীরা একটি ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলেছেন, ‘তিন বছরের একটি মেয়ের পেটে ব্যথা হয় বলে বাড়ির লোকজন তাকে সোডিয়াম বাইকার্বোনেট দিয়ে একটি ‘গার্হস্থ্য ওষুধ’ তৈরি করে ১০ দিন ধরে খাওয়ায়। মেয়েটি ভালো হওয়ার পরিবর্তে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। চিকিৎসকেরা সেখানে দেখেন যে তার রক্তে সোডিয়ামের মারাত্মক আধিক্য বা হাইপারনেট্রিমিয়া ঘটে গেছে। মেয়েটিকে বাঁচানোর জন্য তারা ফ্লুইড থেরাপী শুরু করেন এবং একসময় সে রক্ষা পায়।’

লাগামহীন বিজ্ঞাপনের কারণে আমাদের দেশে কোল্ড ড্রিংকসের ব্যবহার আজ আশংকাজনক পর্যায়ে চলে গেছে। তদুপরি বিভিন্ন স্পন্সর, লটারি ও পুরষ্কারের ঘোষণা এতে আরো ইন্ধন যুগিয়েছে। টাকার অপচয় ছাড়াও এর ফলে যে হারে স্বাস্থহানির সম্ভাবনা রয়েছে তাতে বিবেকবান কোনো মানুষই নিশ্চুপ থাকতে পারেন না। এর প্রতিরোধ এখনই দরকার।

সরকারের কাছে আবেদন, জনসাধারণের স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা বিবেচনা করে এবং আমাদের বাচ্চাদের স্বাস্থ্যরক্ষার স্বার্থে তারা যেন অন্তত রেডিও-টিভিতে কোল্ড ড্রিংকসের বিজ্ঞাপন প্রচার যত দ্রুত সম্ভব বন্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। জনগণের প্রতি আহবান, স্বাস্থ্যগত কারণে কোল্ড ড্রিংকস্ যথাসম্ভব পরিহার করুন এবং বিশেষ করে প্রবীণ ও বাচ্চাদের কোল্ড ড্রিংকস্ দেয়ার সময় সতর্ক হোন।

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: