ঢাকা | শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা

odhikarpatra | প্রকাশিত: ২০ মে ২০২২ ১৪:০১

odhikarpatra
প্রকাশিত: ২০ মে ২০২২ ১৪:০১

বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা বিরাজমান। কিন্তু এ বিশাল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে আমরা পর্যটন শিল্পে পিছিয়ে আছি। এ শিল্পের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা। পর্যটন শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবপক্ষকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করে যেতে হবে। দেশীয় পর্যটন বিকাশের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে প্রচার-প্রচারণার ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। পাশাপাশি এ শিল্পের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। সঠিক কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে পর্যটন শিল্প অন্যতম ভূমিকা পালন করতে পারবে

 

পর্যটন শিল্প পৃথিবীর একক বৃহত্তম শিল্প হিসেবে স্বীকৃত। পর্যটনের গুরুত্ব সর্বজনীন। পৃথিবীর প্রায় সব দেশে পর্যটন এখন অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার খাত। ১৯৫০ সালে পৃথিবীতে পর্যটকের সংখ্যা ছিল মাত্র ২৫ মিলিয়ন; যা ২০১৬ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১২৩৫ মিলিয়নে। ধারণা করা হচ্ছে, এ বছর প্রায় ১৩৯ কোটি ৫৬ লাখ ৬০ হাজার পর্যটক সারা পৃথিবী ভ্রমণ করবেন। অর্থাৎ বিগত ৬৭ বছরে পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ৫০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। পর্যটকের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিধি ব্যাপকতা লাভ করেছে। পর্যটনের মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধিত হয়ে থাকে। ২০১৭ সালে বিশ্বের জিডিপিতে ট্যুরিজমের অবদান ছিল ১০.৪ শতাংশ, যা ২০২৭ সালে ১১.৭ শতাংশে গিয়ে পৌঁছাবে। এছাড়া ২০১৭ সালে পর্যটকদের ভ্রমণখাতে ব্যয় হয়েছে ১৮৯৪.২ বিলিয়ন ডলার। আর একই বছর পর্যটনে বিনিয়োগ হয়েছে ৮৮২.৪ বিলিয়ন ডলার। পর্যটনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি খণ্ডচিত্র আমরা এর থেকে পেতে পারি।সারা বিশ্বের তুলনায় বাংলাদেশ এ শিল্পে কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের জিডিপি খাতে পর্যটন শিল্পের অবদান ছিল ৮৫০.৭ বিলিয়ন টাকা। এ খাতে কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে ২৪ লাখ ৩২ হাজার। একই বছর পর্যটন খাতে বিনিয়োগ এসেছে ৪৩ বিলিয়ন টাকা। তাছাড়া সঠিক তথ্য-উপাত্ত না পাওয়া গেলেও ধারণা করা হয়, গত বছর বাংলাদেশে প্রায় ৫ লাখ বিদেশি পর্যটক ভ্রমণ করেন। একই বছর প্রায় ৪ কোটি দেশীয় পর্যটক সারা বাংলাদেশ ঘুরে বেড়ান।

 

 

সারা বিশ্বে পর্যটন শিল্প একটি অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবে সুপরিচিত। পর্যটন শিল্প বর্তমান বিশ্বের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। পর্যটন শিল্পে বিশ্বের বুকে এক অপার সম্ভাবনার নাম বাংলাদেশ। এ দেশের প্রাকৃতিক রূপবৈচিত্র্য পৃথিবীর অন্য দেশ থেকে অনন্য ও একক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। পর্যটন বিকাশে বাংলাদেশের রয়েছে অপার সম্ভাবনা।

অপূর্ব সৌন্দর্যের আধার বাংলাদেশ যার প্রাকৃতিক রূপবৈচিত্র্যের কোনো অভাব নেই। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন, পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার, পার্বত্য চট্টগ্রামের অকৃত্রিম সৌন্দর্য, সিলেটের সবুজ অরণ্যসহ আরও অনেক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি আমাদের বাংলাদেশ।

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত পৃথিবীর একমাত্র দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন সমুদ্র সৈকত, যা আর পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই। ১২০ কিমি. দীর্ঘ সৈকতটিতে কাদার অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। তাই তো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সমুদ্র সৈকতের চেয়ে কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এবং এর রয়েছে অপার সম্ভাবনা। বর্তমানে কক্সবাজারকে কেন্দ্র করে নেয়া হচ্ছে নানা পরিকল্পনা। সম্প্রতি কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সাগরের পাড়ে ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে পর্যটন নগরী কক্সবাজারের আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে দেবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটক আকর্ষণে কক্সবাজারে তিনটি পর্যটন পার্ক তৈরির পরিকল্পনা করেছে বর্তমান সরকার। প্রতি বছর এতে বাড়তি ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এ তিনটি ট্যুরিজম পার্ক হল সাবরাং

ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক এবং সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক।

সুন্দরবন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনভূমি। এর মোট বনভূমির ৬০ শতাংশ অর্থাৎ ৬০১৭ বর্গকিলোমিটার রয়েছে বাংলাদেশে এবং বাকি অংশ রয়েছে ভারতের মধ্যে। সুন্দরবন ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কোর ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সম্পদের সঙ্গে সঙ্গে এ বনের জীববৈচিত্র্য এটিকে পৃথিবীর অন্য যে কোনো পর্যটন কেন্দ্র থেকে স্বতন্ত্ররূপে উপস্থাপন করেছে। সুন্দরবনকে জালের মতো জড়িয়ে রেখেছে সামুদ্রিক স্রোতধারা, খাল, শত শাখা নদী, কাদা চর এবং ম্যানগ্রোভ বনভূমির লবণাক্ততাসহ ক্ষুদ্রায়তন দ্বীপমালা। সুন্দরবনের নামের সঙ্গে যেই বিষয়টি নিবিড়ভাবে জড়িত, তা হল বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার। বনভূমিটি রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়াও নানা ধরনের পাখি, চিত্রা হরিণ, কুমির, ডলফিন ও সাপসহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত।

পর্যটনের অপার সম্ভাবনার নাম বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল যা পার্বত্য চট্টগ্রাম নামে অধিক পরিচিত। পার্বত্য চট্টগ্রাম মূলত তিনটি জেলা নিয়ে গঠিত। এটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের একটি এলাকা, যা তিনটি জেলা, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান নিয়ে গঠিত। পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটনের মূল উপকরণ হল পাহাড়ে ঘেরা সবুজ প্রকৃতি যা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রূপে পর্যটকদের কাছে ধরা দেয়। এটি যেন ক্ষণে ক্ষণে প্রকৃতির রূপ বদলানোর খেলা। এখানে শীতে যেমন এক রূপ ধরা দেয় ভ্রমণপিপাসুদের কাছে, ঠিক তেমনি বর্ষা অন্য এক রূপে হাজির হয়। শীতে পাহাড় কুয়াশা আর মেঘের চাদরে যেমন ঢাকা থাকে, তার সঙ্গে থাকে সোনালি রোদের মিষ্টি আভা। আবার বর্ষায় চারদিক জেগে ওঠে সবুজের সমারোহ। এ সময় প্রকৃতি ফিরে পায় আরেক নতুন যৌবন। বর্ষায় মূলত অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিস্টদের পদচারণা সবচেয়ে বেশি থাকে এ পার্বত্য অঞ্চলে। তখন এখানে ঝরনা, হ্রদ কিংবা

নদীপথগুলো নতুন রূপে সেজে ওঠে যা দেখার জন্য অসংখ্য পর্যটক এখানে ভিড় করেন। এর সঙ্গে আছে পাহাড়ের মানুষের ভিন্নধর্মী জীবনাচরণ যা আমাদের চেয়ে অনেকটা আলাদা।

নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরপুর বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল। এ শহরে রয়েছে উপমহাদেশের সর্বপ্রথম ও সর্ববৃহৎ চা বাগান মালনীছড়া চা বাগান। এ অঞ্চলে আসা পর্যটকদের মন জুড়ায় সৌন্দর্যের রানীখ্যাত জাফলং, নীলনদ খ্যাত স্বচ্ছ জলরাশির লালাখাল, পাথর জলের মিতালিতে বয়ে যাওয়া বিছনাকান্দির নয়নাভিরাম সৌন্দর্য, পাহাড় ভেদ করে নেমে আসা পাংথুমাই ঝরনা, সোয়াম্প ফরেস্ট রাতারগুল, ‘মিনি কক্সবাজার’ হাকালুকি এবং কানাইঘাটের লোভাছড়ার সৌন্দর্য।

বাংলাদেশের হাওর অঞ্চল পর্যটনের আরেক সম্ভাবনার নাম। বাংলাদেশের জেলাগুলোর মধ্যে সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া- এ সাতটি জেলার ৭ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর জলাভূমিতে ৪২৩টি হাওর নিয়ে হাওরাঞ্চল গঠিত। হাওর অঞ্চলের সাগরসদৃশ বিস্তীর্ণ জলরাশির এক অপরূপ মহিমায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হাওরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পর্যটকরা নৌকায় বসে বিস্তীর্ণ নীল জলরাশির মায়ায় ভেসে বেড়াতে পারেন। হাওরের কোলঘেঁষে থাকা সীমান্ত নদী, পাহাড়, পাহাড়ি ঝরনা, হাওর-বাঁওড়ের হিজল, করচ, নল, খাগড়া বনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নানা প্রজাতির বনজ, জলজপ্রাণী আর হাওর পারের বসবাসকারী মানুষের জীবন-জীবিকার নৈসর্গিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়ার মতো খোরাক মিলবে পর্যটক ও দর্শনার্থীদের।

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: