ঢাকা | মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫, ৮ বৈশাখ ১৪৩২
শিশু থেকে বৃদ্ধা পর্যন্ত যে কোনো বয়সের নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছে

নির্ভয়া

MASUM | প্রকাশিত: ১৬ আগস্ট ২০১৭ ২১:০০

MASUM
প্রকাশিত: ১৬ আগস্ট ২০১৭ ২১:০০

নির্ভয়া


নারীর ওপর আধিপত্য বিস্তারের সবচেয়ে কুৎসিত রূপ হচ্ছে ধর্ষণ। ধর্ষণের ক্ষেত্রে যতটুকু না যৌন লালসা কাজ করে, তার চেয়ে বেশি কাজ করে পুরুষের আধিপত্য বিস্তারের বাসনা। একজন নারী যে কোন অবস্থানেই থাকুক না কেন, ধর্ষণের শিকার হবার ভয় তাকে সবসময়ই তাড়া করে বেড়ায়। নির্ভয়ে একজন নারী জীবন পার করতে পারে না। গণমাধ্যমের মাধ্যমে আমরা প্রতিনিয়ত জানতে পারি দেশে ঘটে যাওয়া এই অপরাধের কথা।  

আমরা জানতে পারি যে একজন মেয়ে শিশু থেকে বৃদ্ধা পর্যন্ত যে কোনো বয়সের নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। অর্থাৎ নারী জীবনের এমন কোন সময় নেই যে সময়টাতে কোন নারী নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারে। এই সমাজের প্রতিটি স্তরে, সেটা ডিস্কো ক্লাব কিংবা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হোক, নিম্ন বিত্ত থেকে উচ্চ বিত্ত, সমস্ত পর্যায়ে ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন নারীরা। মেয়ে হয়ে জন্ম নেয়াটাই যেন একটি অপরাধ।  এই যে মাত্র লাইনটি লিখলাম, 'মেয়ে হয়ে জন্ম নেয়াটাই যেন অপরাধ' না জানি কত শত বছর ধরে নারীদের মুখে মুখে এই লাইনটি চলে আসছে। প্রতিটি নির্যাতিত নারীর হাহাকারে, অশ্রু বাষ্পে শুধু একটাই কথা, 'নারী জন্ম অপরাধ', 'নারী জন্ম পাপ'!  

ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিচার পাচ্ছে না এর শিকার নারী ও শিশু।

এমনকি ধর্ষণের ঘটনায় মামলা করে নিরাপত্তাহীনতায় থাকতে হয় ঘটনার শিকার নারী ও তার পরিবারকে। অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকারকর্মীদের মতে, এই অপরাধ বেড়েই চলেছে কারণ সমাজ এক ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।  ফলে একরকম অস্থিরতা বিরাজ করছে। যার দরুণ অপরাধের মাত্রা বাড়ছে। স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার মাধ্যমে তা কমিয়ে আনা সম্ভব বলেও মনে করেন তারা।

 

তাদের মতে, বিচারবহির্ভূত আইন ব্যবস্থা, পুরুষদের মানসিকতার পরিবর্তন না হওয়া, পশ্চিমা সংস্কৃতি ও বিশ্বায়নের ক্ষতিকর প্রভাবের ফলে দিন দিন ধর্ষণের মতো অপরাধের প্রবণতা বাড়ছেই।

ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনুকে। এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল দেশজুড়ে। সে সময় সাইবার জগত তোলপাড় হলেও আজও বিচার হয়নি তনু হত্যার। মেয়ের সাথে ঘটে যাওয়া ধর্ষণের বিচার না পেয়ে অপমানে জীবনের কাছে হেরে গিয়ে মেয়েকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়েছিল শ্রীপুরের হজরত। আদিবাসী নারীদের ওপর, সংখ্যালঘু নারীদের ওপর ব্যাপক হারে এই সহিংসতা ঘটে চলেছে। আর আমরা শুধু পরিসংখ্যান দেখে যাচ্ছি। সেই পরিসংখ্যানে যোগ হয়েছে শিশু তানহার লাশ। গত রবিবার নির্মমভাবে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় রাজধানীর বাড্ডার আদর্শনগরী এলাকার সাড়ে ৩ বছর বয়সী শিশু তানহাকে! হিংস্রতার মাত্রা এমন ভাবে বেড়ে গেছে যে, শিশু সে যে বয়সেরই হোক ছাড় পাচ্ছে না। মানে জীবিত থাকতে পারাটা এখন অধিকার না, সেটা হয়ে গেছে একটি সুযোগ।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৫ সালে সারা দেশে ৮৪৬ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণ-পরবর্তীসময়ে ৬০ জন কে হত্যা করা হয়। আত্মহত্যা করেন ২ জন। এর ঠিক আগের বছর ২০১৪ সালে ৭০৭ জন ধর্ষণের শিকার হন। ২০১৬ সালে ধর্ষণের শিকার হন ৭২৪ জন, ধর্ষণের পরবর্তী মৃত্যু ৩৭ জন, ধর্ষণের চেষ্টা করা হয় ৬৫ জনকে, এবং ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর আত্মহত্যা করেন ১৬ জন। ২০১৭ সালে জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হন ২১৮ জন, ধর্ষণের চেষ্টার শিকার হন ৩৬ জন, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ১০ জন কে, আর ৪ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেন।

আরেকটি মানবাধিকার সংগঠন 'বি এন ডাব্লিউ এল এ' এর পরিসংখ্যানে জানা যায় ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হন ৩,৩৫৮ জন।

যে হিংস্রতার সাথে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে নারী ও শিশুরা, তা সত্যিই ভয়াবহ। ধর্ষণের পর নৃশংস ভাবে তাদের হত্যা করা হচ্ছে। কেউ কেউ অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে।

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিগত বছরগুলোর মধ্যে ২০১৬ সালে সবচেয়ে বেশি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ২০১২ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৩০১ জন শিশু, যার মধ্যে ২০১৬ সালে এসে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫২১ জনে! বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএএফ) পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৬৯ জন শিশু গণধর্ষণের শিকার হয়েছে।  ৯৩ জন কে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। ৩২ জন ধর্ষণের শিকার হয়ে পরবর্তীতে আত্মহত্যা করে এবং ১৬৫ শিশু কে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়। নানা রকম মিথ্যে প্রলোভন দেখিয়ে শিশুদের নির্জন স্থানে নিয়ে এই অপরাধ সংঘটন করা হয়েছে।

ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে দিনের পর দিন, এবং তা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। লজ্জা অপমানে কিংবা নানান হুমকিতে ভীত হয়ে ভিকটিম এবং ভিকটিমের পরিবার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই থানায় মামলা করতে চায় না। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে আইনের ফাঁক গলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অপরাধী পার পেয়ে যাচ্ছে। ভিকটিমকেই প্রমাণ করতে হয় যে তার সাথে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। সেই সাথে আছে আমাদের নারীবিদ্বেষী সমাজ ব্যাবস্থা।  যার জন্য থানায়, হাসপাতালে, আদালতে ঘুরতে ঘুরতে ধর্ষণের দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত ভিকটিম আরো ভেঙ্গে পড়ে।

এতো কিছুর পর দেখা যায় যে বিচার পাওয়া যাচ্ছে না, অপরাধী অপরাধ করেও মুক্ত হয়ে ঘুরছে। আইনের যথাযত প্রয়োগ না হওয়া, বিচারহীনতা, নিরাপত্তার অভাব থাকার দরুণ এই অপরাধ কমছে না। তার ওপর পুরুষশাসিত সমাজ ব্যাবস্থায় পুরুষের এই অপরাধ কে নানান ভাবে 'জায়েজ' করার চেষ্টা চলে সবসময়। প্রশ্নবিদ্ধ করা হয় নারীর চরিত্র, চাল-চলন, পোশাককে। যেখানে সবার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়ার কথা সেখানে সেই ভিকটিমকে গণ্য করা হয় অচ্ছুৎ হিসেবে। ধর্ষণের শিকার নারীকে কেউ জীবন সঙ্গী করবে তার তো প্রশ্নই আসে না! তার মধ্যে আরেকটি চরম অপমানের ঘটনা হলো ধর্ষকের সাথে নির্যাতনের শিকার মেয়েটির বিয়ে দেওয়া। ধর্ষণের শিকার নারীর জীবনে নেমে আসে আমৃত্যু গঞ্জনা আর বঞ্চনা।  

নিজেদের বিবেক কে জাগ্রত করতে হবে আমাদের। এই জঘন্য অপরাধটির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর দায়িত্ব আমাদেরই। সেই সাথে আমাদের প্রয়োজন একটি, নারী বান্ধব সমাজ। হাসপাতাল,থানা, আদালতের মত গুরুত্বপূর্ণ জায়গা গুলো হতে হবে নারী বান্ধব। মানুষ শেষ পর্যন্ত আদালতে যায়, আইনের আশ্রয় নিতে, বিচার চাইতে। এখনো মানুষ আইনের ওপরই নির্ভর করে। রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে নিজের সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের বিচার চাওয়া এবং বিচার পাওয়া একজন নাগরিকের মৌলিক অধিকার। প্রশাসনকে নিতে হবে কঠোর পদক্ষেপ।  

সমাজের মূল ভিত্তি পরিবার। প্রতিটি পরিবারের শিক্ষা যদি এমন হয় যে নারী পুরুষ পরস্পরকে সম্মান করার একটি সংস্কৃতি নিয়ে চলছে, সন্তানদের সেভাবে গড়ে তুলছে তাহলে নতুন করে আর ধর্ষক তৈরি হবে না। নির্ভয়ে চলুক নারী ও শিশু, জয় হোক মানবতার।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: