ঢাকা | মঙ্গলবার, ৫ নভেম্বর ২০২৪, ২০ কার্তিক ১৪৩১

ভালোবাসা আল্লাহর জন্য

Admin 1 | প্রকাশিত: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০২:২৬

Admin 1
প্রকাশিত: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০২:২৬

 ভালোবাসা মৌলিক মানবীয় গুণাবলির একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ গুণ। মানবীয় গুণাবলি বিকাশে ও উত্তম মনুষ্য চরিত্রের উৎকর্ষ সাধন বা সুকুমারবৃত্তি অর্জনের মূলেও রয়েছে বিশ্বাস, আশা ও ভালোবাসা। সৃষ্টিকুল কায়েনাত ভালোবাসার ফল। হাদিসে কুদসিতে রয়েছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি ছিলাম গোপন ভান্ডার; ভালোবাসলাম প্রকাশ হতে, তাই সৃজন করলাম সমুদয় সৃষ্টি। আল্লাহর কুদরতের জগতে ভালোবাসাই হলো প্রথম সম্পাদিত ক্রিয়া বা কর্ম। এই ভালোবাসা পবিত্র কোরআনে ৭টি পর্বে ৬৩ বার উল্লেখ হয়েছে। বিশ্বাসী বা মোমিনদের ভালোবাসা সম্পর্কে ১৪টি আয়াত রয়েছে; কাফেরদের ভালোবাসা সম্পর্কে রয়েছে ১২টি আয়াত; আল্লাহ ভালোবাসেন না প্রসঙ্গে আছে ১৫টি আয়াত; আল্লাহ ভালোবাসেন প্রসঙ্গে আছে ৯টি আয়াত; ভুল করে ভালোবাসা সম্পর্কে বিবৃত আছে ৩টি আয়াত, ভালোবাসার অসার দাবি সম্পর্কে রয়েছে ১টি আয়াত; ভালোবাসার অন্যান্য প্রসঙ্গে উল্লেখ রয়েছে ৬টি আয়াত।
বিশ্বাসী বা মোমিনদের ভালোবাসা
আল্লাহকে ভালোবাসার জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অনুসরণ করতে হবে। ‘যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তবে আমার নবী (সা.)-এর অনুসরণ করো; তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ মার্জনা করবেন।’ (আলে ইমরান: ৩১)। ইমানকে ভালোবাসা ও কুফরকে ঘৃণা করতে হবে। (হুজুরাত: ৭)। প্রভুর জিকরের ভালোবাসা মোমিনের হৃদয়ে থাকবে। (ছদ: ৩২)। ধ্বংসশীলদের ভালো না বাসাই যৌক্তিক (আনআম: ৭৬)। ভালোবাসার জিনিস ব্যয় (দান) করা প্রকৃত কল্যাণ লাভের উপায় (আলে ইমরান: ৯২)। আল্লাহর ভালোবাসায় দান করা মোমিনের পরিচয় (বাকারা: ১৭৭)। আল্লাহর ক্ষমাকে ভালোবাসা বিশ্বাসীদের কাজ (নূর: ২২)। বিজয়কে ভালোবাসা মানব স্বভাব (ছফ: ১৩)। তোমরা তাদের (অবিশ্বাসী ও অকৃতজ্ঞ ব্যক্তিদের) ভালোবাসো কিন্তু তারা তোমাদের ভালোবাসে না। আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন, যারা (মোমিনরা) আল্লাহকে ভালোবাসে (মায়িদা: ৫৪)। মোমিনগণ আল্লাহকে কঠিন ভালোবাসেন। (বাকারা: ১৬৫)। তাঁরা (মোমিনরা) মুহাজিরদের ভালোবাসেন। (হাসর: ৯)। হাজতবাসকে আমি (হজরত ইউসুফ আ.) মন্দ কাজ অপেক্ষা ভালোবাসি (ইউসুফ: ৩৩)। ভালোবাসলেই হিদায়াত দেওয়া যায় না (কছছ: ৫৬)।

 

 

অবিশ্বাসী ও অকৃতজ্ঞদের ভালোবাসা

অকৃতজ্ঞ ও অবিশ্বাসীরা ইমানের চেয়ে কুফরকে বেশি ভালোবাসে (তাওবা: ২৩)। অবিশ্বাসীরা দুনিয়াকে ভালোবাসে (আলে ইমরান: ১৫২)। অকৃতজ্ঞরা দুনিয়ার জীবনকে ভালোবাসে (নাহল: ১০৭)। অবিশ্বাসীরা নগদকে ভালোবাসে (কিয়ামাত: ২০-২১; দাহর: ২৭)। আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর ভালোবাসার চেয়ে অন্য কিছুকে ভালোবাসা মুনাফিকদের স্বভাব (তাওবা: ২৪)। হিদায়াতের চেয়ে অন্ধত্বকে ভালোবাসে সংশয়বাদীরা (হামিম সাজদা: ১৭)। সম্পদকে ভালোবাসে বোকারা (ফাজর: ২০)। সম্পদের কঠিন ভালোবাসা নির্বোধদের কাজ (আদিয়াত: ৮)। তোমরা (অশান্তিকারীরা) কল্যাণকামীদের ভালোবাসো না। (আরাফ: ৭৯)। তারা (অহংকারীরা) কাজ না করেই প্রশংসা পেতে ভালোবাসে (আলে ইমরান: ১৮৮)। যারা অশ্লীলতা প্রকাশে ভালোবাসে, তারা বিপথগামী (নূর: ১৯)। কামনার ভালোবাসা পাপের কারণ (আলে ইমরান: ১৪)।

আল্লাহ তাআলা যা ভালোবাসেন না

আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদের ভালোবাসেন না (বাকারা: ১৯০)। আল্লাহ অবিশ্বাসী পাপীদের ভালোবাসেন না (বাকারা: ২৭৬)। আল্লাহ অকৃতজ্ঞ ব্যক্তিদের ভালোবাসেন না (আলে ইমরান: ৩২)। আল্লাহ জালিমদের ভালোবাসেন না (আলে ইমরান: ৫৭ ও ১৪০; শুরা: ৪০)। আল্লাহ গর্বিত উত্ফুল্লকারীদের ভালোবাসেন না (কছছ: ৭৬)। আল্লাহ গর্বকারীদের ভালোবাসেন না (নিসা: ৩৬; লুকমান: ১৮; হাদীদ: ২৩)। আল্লাহ অহংকারীদের ভালোবাসেন না (নাহল: ২৩)। আল্লাহ অপব্যয়কারীদের ভালোবাসেন না (আনআম: ১৪১; আরাফ: ৩১)। আল্লাহ আমানতের খেয়ানতকারীদের ভালোবাসেন না (আনফাল: ৫৮)। আল্লাহ খেয়ানতকারী পাপীদের ভালোবাসেন না (নিসা: ১০৭)। আল্লাহ খেয়ানতকারী কাফেরদের ভালোবাসেন না (হাজ: ৩৮)। আল্লাহ কথায় (ভাষায়) মন্দ প্রকাশ করা ভালোবাসেন না (নিসা: ১৪৮)। আল্লাহ ফ্যাসাদ বিপর্যয় ভালোবাসেন না (বাকারা: ২০৫)। আল্লাহ ফ্যাসাদকারীদের (বিশৃঙ্খলাকারীদের) ভালোবাসেন না (মায়িদা: ৬৪; কছছ: ১২)। (কারও অগোচরে তার দোষ চর্চা কোরো না; পশ্চাতে নিন্দা করা আপন ভাইয়ের লাশের মাংস ভক্ষণ করার সমতুল্য। গিবতকারীরা বা পরনিন্দাকারীরা মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া ভালোবাসো কি? (হুজুরাত: ১২)

আল্লাহ যা ভালোবাসেন

আল্লাহ সৎ কর্মশীলদের ভালোবাসেন (বাকারা: ১৯৫; আলে ইমরান: ১৩৪ ও ১৪৮; মায়িদা: ১৩ ও ৯৩)। আল্লাহ পবিত্রদের ভালোবাসেন (তাওবা: ১০৮)। আল্লাহ তওবাকারী ও পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালোবাসেন (বাকারা: ২২২)। আল্লাহ মুত্তাকিদের ভালোবাসেন (আলে ইমরান: ৭৬; তাওবা: ৪ ও ৭)। আল্লাহ ধৈর্যশীল ব্যক্তিদের ভালোবাসেন (আলে ইমরান: ১৪৬)। আল্লাহ (তাঁর ওপর) নির্ভরকারীদের ভালোবাসেন (আলে ইমরান: ১৫৯)। আল্লাহ ন্যায়নিষ্ঠদের ভালোবাসেন (মায়িদা: ৪২; হুজুরাত: ৯; মুমতাহিনা: ৮)। আল্লাহ মুজাহিদদের ভালোবাসেন (ছফ: ৪)। আমি (আল্লাহ) তার মাঝে ভালোবাসা দিয়েছি (তহা: ৩৯)।

ভালোবাসার ভুলভ্রান্তি

কল্যাণকর বস্তু নয়, বরং অকল্যাণকর বস্তুকে ভালোবাসো (ভ্রান্তি) (বাকারা: ২১৬)। অন্যায় ভালোবাসায় প্ররোচনা (বিভ্রান্তি উদ্রেককারী) (ইউসুফ: ৩০)। ভালোবাসার কারণে প্রতিহিংসা করা ও প্রতিশোধ গ্রহণ করা অন্যায় (ইউসুফ: ৮)।

ভালোবাসার অসার দাবি

অকৃতজ্ঞ অবিশ্বাসী কাফিররা বলে, ‘আমরা আল্লাহর ভালোবাসার পাত্র (মায়িদা: ১৮)। প্রকৃত ভালোবাসার দাবি হলো বিশ্বাস
ও কৃতজ্ঞতা। সবর ও শোকর তথা ধৈর্য ও কৃতার্থতা।

ভালোবাসার নানা প্রসঙ্গ

ইমান বা বিশ্বাস ভালোবাসার বীজ (ইয়াসিন: ৩৩)। ইমান, বিশ্বাস ও ভালোবাসার বীজ রয়েছে সুউজ্জ্বল গ্রন্থে (কোরআন করিমে) (আনআম: ৫৯)। ভালোবাসার (বিন্দু) সরিষা দানাসম তা অঙ্কুরিত ও বিকশিত হয় (আম্বিয়া: ৪৭)। তিনি (আল্লাহ) বিশ্বাস ও ভালোবাসার অঙ্কুরোদ্গম ঘটান (আনআম: ৯৫; নাবা: ১৪ ও ১৬; কাফ: ৯; আবাছা: ২৫-২৭)। তিনি (আল্লাহ) ভালোবাসার বীজকে (বিশ্বাস ও ভালোবাসায় সিক্ত আমলকে) সপ্ত শতক প্রবৃদ্ধি ঘটান (বাকারা: ২৬১)। খোসাযুক্ত (অন্তরে) ভালোবাসা ও উন্মুক্ত (প্রকাশ্যে) ভালোবাসা (সৃষ্টির ভেদ রহস্য) (আর রহমান: ১২; আনআম: ৯৯)।

হাদিস শরিফে ভালোবাসা

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: ‘তোমাদের কেহ ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ মোমিন হবে না, যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার সন্তান অপেক্ষা, তার পিতা অপেক্ষা এবং সব মানুষ অপেক্ষা বেশি প্রিয় (ভালোবাসার বস্তু) না হই।’ (বুখারি শরিফ)। রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন: ‘যে যাকে ভালোবাসে সে (পরকালে) তার সঙ্গে থাকবে (মুসলিম শরিফ)।’ হাদিসে আরও রয়েছে: ‘যে আমার সুন্নতকে ভালোবাসে সে অবশ্যই আমাকে ভালোবাসে, আর যে আমাকে ভালোবাসে সে জান্নাতে আমার সঙ্গেই থাকবে (নাসায়ি শরিফ)।’ নবীজি (সা.) বলেন: ‘সর্বোত্তম আমল হলো আল্লাহর জন্য ভালোবাসা।’ (আবু দাউদ শরিফ)

ভালোবাসার আমল

নবী করিম (সা.) বলেন: ‘তোমাদের কেউ জান্নাতে যাবে না, যদি না সে ইমান আনয়ন করে; আর ততক্ষণ পর্যন্ত তারা ইমানদার হবে না, যদি না তারা একে অন্যকে ভালোবাসে। আমি কি তোমাদের এমন একটি আমল শিখিয়ে দেব? যা করলে তোমাদের মাঝে প্রীতি ও ভালোবাসা জন্মাবে! (সে আমলটি হলো) তোমরা নিজেদের মাঝে সালামের প্রসার ঘটাও।’ (তিরমিজি শরিফ)

ভালোবাসার দোয়া

রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রায়ই এই দোয়া করতেন: ‘হে আল্লাহ! আপনার ভালোবাসা চাই, আপনার ভালোবাসার জনের ভালোবাসা চাই; আর সে আমল করার তৌফিক চাই, যে আমল করলে আপনার ভালোবাসা লাভ করা যায়।’ (মুআত্তা ইমাম মালিক)

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্‌ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: