
ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের নজিরবিহীন হামলায় দেশটির পরমাণু কর্মসূচি ‘ধ্বংসপ্রাপ্ত’ হয়েছে বলে জানিয়েছেন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ। তিনি জানান, ওয়াশিংটনের লক্ষ্য ইরানে সরকার পরিবর্তন নয়।
ওয়াশিংটন থেকে এএফপি জানায়, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ফর্দো, ইসফাহান ও নাতানজের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার কথা ঘোষণার পর পেন্টাগনে এক সংবাদ সম্মেলনে হেগসেথ বলেন, ‘আমরা ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে ধ্বংস করেছি।’
তিনি আরও জানান, ‘এই অভিযানে ইরানি সেনা বা সাধারণ নাগরিকদের লক্ষ্য করা হয়নি।’
হেগসেথ বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শান্তি চান এবং ইরানকে সে পথই বেছে নিতে হবে। এই মিশনের উদ্দেশ্য কখনোই সরকার পতন ছিল না।’
তবে আগে ‘চিরস্থায়ী যুদ্ধ’ এড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ এখন ইরান-ইসরাইল সংঘাতকে আরও বিস্তৃত করার হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরই মধ্যে ইরান যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের প্রতিশোধ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
ট্রাম্প আগেই হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, ইরান যদি আত্মসমর্পণ না করে, তবে আরও লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানো হবে। এর কয়েক ঘণ্টা পর ইরান দুটি দফায় ইসরাইলে হামলা চালায়।
ট্রাম্প বলেন, “মধ্যপ্রাচ্যের দাপটশালী ইরান এখন শান্তির পথে না এলে ভবিষ্যতের হামলাগুলো আরও ভয়াবহ হবে। মনে রাখুন, এখনও অনেক লক্ষ্য বাকি।”
ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি অভিযোগ করেন, ইউরোপীয় শক্তির সঙ্গে চলমান আলোচনার মাঝেই যুক্তরাষ্ট্র কূটনীতিকে ধ্বংস করেছে।
তিনি বলেন, “আমরা যখন কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় ছিলাম, তখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে একটি বড় লাল সীমারেখা অতিক্রম করেছে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা প্রয়োজনে সব ধরনের উপায়ে নিজেদের রক্ষা করব।”
ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ান যুক্তরাষ্ট্রের হামলাকে ইসরাইলি আগ্রাসনের মূল উৎস বলেও মন্তব্য করেন।
ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু মার্কিন হামলার প্রশংসা করে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ন্যায়সঙ্গত শক্তি ইতিহাস বদলে দেবে।’
ইসরাইলি সামরিক বাহিনী জানায়, তারা ফর্দোর গভীর ভূগর্ভস্থ স্থাপনায় হামলার ফলাফল মূল্যায়ন করছে। ইরান সেখান থেকে সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম সরিয়ে ফেলেছে কি না তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স বলেন, ‘আমরা ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ করছি না, আমরা যুদ্ধ করছি তাদের পারমাণবিক কর্মসূচির বিরুদ্ধে।’
তিনি জানান, ‘এই হামলা ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে বিলম্বিত করেছে।’
যুক্তরাষ্ট্রের জয়েন্ট চিফস চেয়ারম্যান ড্যান কেইন জানান, ‘৭টি বি-২ স্টেলথ বোমারু বিমান মূল অভিযানে অংশ নেয়, যারা ১৮ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে বহুবার জ্বালানি নিয়ে মূল ভূখণ্ড থেকে ইরানে উড়ে যায়।’
ইরানি রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের তথ্যমতে, ইরানের রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির প্রধান জানান, পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলায় কোনো প্রাণহানি হয়নি।
জবাবে ইরানি সশস্ত্র বাহিনী ইসরাইলের বেন গুরিয়ন বিমানবন্দরসহ একাধিক স্থানে হামলা চালিয়েছে। এতে অন্তত ২৩ জন আহত হয়।
ইসরাইল জানিয়েছে, তারা ইরানের পশ্চিমাঞ্চল ও কোম শহরে পাল্টা হামলা চালিয়েছে। কোমে রেভল্যুশনারি গার্ডের ৪ সদস্য নিহত হয়েছে বলে ইরানের সংবাদ সংস্থা আইআরএনএ জানিয়েছে।
ইরানের শার্ক পত্রিকা জানায়, বুশেহর প্রদেশে একটি বিশাল বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে, যেখানে দেশটির একমাত্র পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অবস্থিত।
ইরানের ইয়াজ্দ প্রদেশেও হামলার খবর পাওয়া গেছে। তেহরানে এএফপি সাংবাদিকেরা জানিয়েছেন, শহরের ওপর দিয়ে যুদ্ধবিমানের গর্জন শোনা গেছে, যা ১৩ জুনের পর এই প্রথম।
জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) জানায়, হামলার পর পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোর আশেপাশে বিকিরণের কোনো মাত্রা বেড়ে যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
সৌদি আরব জানিয়েছে, উপসাগরীয় অঞ্চলে কোনো তেজস্ক্রিয় প্রভাব পাওয়া যায়নি এবং তারা এই হামলায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার ও ওমান, যারা ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু আলোচনা মধ্যস্থতা করছিল, তারা যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের সমালোচনা করে উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন সব পক্ষকে ‘পিছিয়ে আসার’ আহ্বান জানিয়ে বলেছে, ‘ইরানকে কোনোভাবেই পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের সুযোগ দেওয়া যাবে না।’
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমার ইরানকে আলোচনার টেবিলে ফেরার আহ্বান জানান।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, তিনি সোমবার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ‘গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা’ করতে মস্কো যাচ্ছেন।
এর আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানকে ‘যেকোনো ধরনের প্রতিশোধ’ নেওয়ার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
ইরানের হুতি মিত্ররা আবারও হুমকি দিয়েছে, যদি যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে সম্পৃক্ত হয়, তবে তারা লোহিত সাগরে মার্কিন জাহাজে হামলা চালাবে।
ট্রাম্প বারবার বলেছেন, ইরান কোনোভাবেই পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করতে পারবে না।
তেহরান বলেছে, তারা পরমাণু অস্ত্র চায় না। প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ান বলেন, ‘নাগরিক পারমাণবিক কর্মসূচির অধিকার হুমকি বা যুদ্ধ দিয়ে কেড়ে নেওয়া যাবে না।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: