-2018-08-27-05-50-38.jpeg)
নজরুলের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য ছিল নিজের মুসলমান সম্প্রদায়ের উন্নতি ও মুক্তি, এবং অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠা, আর মুখ্য ছিল বাঙালির জাতীয় চেতনা। তাঁর ভাষায় : বাঙালিকে, বাঙালির ছেলেমেয়েকে ছেলেবেলা থেকে শুধু এই এক মন্ত্র শেখাও: এই পবিত্র বাংলাদেশ/বাঙালি,—আমাদের/...বাঙলা বাঙালির হোক/বাঙলার জয় হোক/বাঙালির জয় হোক।
তাঁর ‘পূর্ণ অভিনন্দন’ কবিতায়ও আমরা পাই ‘জয়বাংলা’ শব্দটি। বর্তমান বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন, ষাটের দশকের জাতীয় চেতনার সংগ্রাম, সাংস্কৃতিক লড়াই এবং মুক্তিযুদ্ধ—আমাদের সকল আন্দোলনে-যুদ্ধে নজরুল এক অবিনশ্বর উত্স হয়েছিলেন। তাঁর অগ্নিদৃপ্ত ভাষা, সৈনিকের মার্চের ছন্দতাল (‘কামাল পাশা’ কবিতা) জাগরণমূলক কবিতা ও গদ্য রচনার উচ্ছ্বাস আমাদের জাতীয় চেতনাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছে, সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে নজরুলের কবিতা সমবেত জমায়েতে আবৃত্তিযোগ্য ও উদ্দীপনা-সঞ্চারক। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর লিখিত রণসংগীত ছিল প্রেরণা। স্বাধীন বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সংগীত হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে তাঁর ‘চল চল চল/ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল/ নিম্নে উতলা ধরণি তল/ চল রে চল চল।’ এই সুর ও ভাষা মানুষকে শুধু উদ্দীপ্তই করে না, সব বাধা কাটিয়ে সামনের দিকে চলার শক্তি সঞ্চার করে।
বাঙালির জাতিতত্ত্ব যদি নিবিড়ভাবে লক্ষ করা যায় তবে দেখব এই জাতি মিশ্র, নানা রক্ত ও নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের যোগফল। একটি রূপে তারা সমীকৃত—সেটা হলো বাঙালি জাতীয় চেতনা। আজকের বিশ্বায়ন যুগে, পণ্যভোগী সমাজের কবলে পতিত যে মানুষ তাদের জাতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি চেতনাই শুধু সংঘবদ্ধ করে রাখতে পারে। তাদের মুক্তি ও অগ্রগতির পথও জাতীয় জাগরণের মধ্য দিয়েই এগিয়ে যেতে পারে। স্বাধীন, মুক্ত বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যত্ প্রগতির পথে নজরুলের রচনাবলি আমাদের প্রেরণা দেয়। আর নিরন্ন, দরিদ্র মানুষ ও তরুণ সমাজ—এদের প্রতি নজরুলের যে মমতা ও সমর্থন ছিল তা আজো তাদের দিক নির্দেশক। নজরুল তো সমাজের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকেই তাঁর লেখালেখির মধ্যে জড়ো করেছিলেন যা আমরা অন্য কোনো একক কবির মধ্যে লক্ষ করি না। আর জাতিতত্ত্বের এটাই তো মূল কথা যে, একই পতাকাতলে, একই জাতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে সকলকে স্বাধীনতার সুফল এনে দেয়া। তাই আমাদের স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে হলে চাই চেতনার জাগরণ, মানুষের আত্মচেতনা, স্বাধীনচেতনা ও আত্মমর্যাদা দিয়ে বেঁচে থাকা। এই চেতনার জাগরণের ক্ষেত্রে নজরুলের উদ্দীপনামূলক গান-কবিতাগুলি সবচেয়ে বেশি ফলদায়ক, তাই যত বেশি নজরুলচর্চা প্রসারিত হবে, তৃণমূল পর্যন্ত একে ছড়িয়ে দেয়া যাবে তত বেশিভাবে বাঙালি জাতিকে সুগঠিত করতে পারব। (অংশ)
সূত্র: জাতীয় পর্যায়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৯তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন স্মরণিকা, ২০১৮
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: