ঢাকা | বৃহঃস্পতিবার, ১০ এপ্রিল ২০২৫, ২৭ চৈত্র ১৪৩১

মেক্সিকো সীমান্তে নাগরিকদের করের অর্থেই দেয়াল: ট্রাম্প

Admin 1 | প্রকাশিত: ২৯ মার্চ ২০১৭ ১০:২৫

Admin 1
প্রকাশিত: ২৯ মার্চ ২০১৭ ১০:২৫

দেয়ালের রাজনীতি নিয়ে শুধু দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তই নয়, বিতর্ক আর সন্দেহ তাড়া করছে পুরো আমেরিকা। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় বলেছিলেন, মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল হবে। দেয়াল নির্মাণের অর্থও দেবে মেক্সিকো। মেক্সিকো বলে দিয়েছে, তারা কোনো অর্থ দেবে না।

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, আপাতত নাগরিকদের করের অর্থেই তিনি নির্মাণকাজ শুরু করবেন। এ নিয়ে হোয়াইট হাউস থেকে বিস্তারিত পরিকল্পনা প্রকাশ করা হয়েছে। আমেরিকার দিক থেকে দৃষ্টিনন্দন দেখায়, এমন দেয়াল নির্মাণ করা হবে। দেয়ালের উচ্চতা ১৮ থেকে ৩০ ফুট হতে পারে। মে মাসের শেষ দিকে দেয়ালের নকশা জানা যাবে। এর মধ্যে আইনপ্রণেতারা সিদ্ধান্ত নেবেন, সীমান্তে আদৌ দেয়াল নির্মাণ করা হবে কি না। তবে নাগরিকদের মধ্যে এ নিয়ে চলছে বিতর্ক। প্রতিক্রিয়াও মিশ্র সীমান্ত দেয়ালের আলোচনায়।

প্রস্তাবিত দেয়াল সীমান্তবর্তী আমেরিকানদের বিপাকে ফেলতে পারে। অনেক পরিবার আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। এদেরই একজন জন ল্যাড। মেক্সিকো সীমান্তে ১২০ বছর তাদের পরিবার ১৬ হাজার একর জমির মালিক। এবিসি নিউজকে ল্যাড জানান, ১৯২৭ সালের আগে মেক্সিকো থেকে তাদের সম্পত্তি বিচ্ছিন্ন করার মতো কিছুই ছিল না। গবাদিপশুর মধ্যে রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে—এ আশঙ্কায় কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হয়।

ল্যাড জানান, গবাদিপশুর দেহে রোগ ছড়ানোর আশঙ্কায় সাম্প্রতিক দশকে সীমান্তে নিরাপত্তা বিষয়ে রূপান্তরিত হয়। ১৩ ফুট উঁচু দেয়াল ওঠে। কিন্তু দেয়াল ডিঙিয়ে কিংবা কেটে সহজেই পার হওয়া যায়। এখন অধিকাংশ বেড়াই লোহার পাত দিয়ে তৈরি, যা প্রায় ২০ ফুট উঁচু।

কোচিজ কাউন্টির বাসিন্দা জন ল্যাড ও অন্যরা মেক্সিকো থেকে আগত অবৈধ অভিবাসীবিরোধী বক্তব্যে মুগ্ধ হয়ে ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছিলেন। ট্রাম্প অবৈধভাবে আমেরিকায় অনুপ্রবেশকারী মেক্সিকানদের অপরাধী ও ধর্ষক হিসেবে অভিহিত করেন। ল্যাডরা ট্রাম্পের সাহসিকতার অনুরাগী। ল্যাডের মতে ট্রাম্প যা বলেছেন, সবই সঠিক। নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটা ব্যাপক সমস্যা বলে মনে করেন অনেকেই।

ল্যাড বলেন, অবৈধ ব্যক্তিরা তাঁর জমিতেই ঢুকে পড়ে। তাঁর মতে, সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো ৩০ বছর ধরে তাঁর জমিতেই অধিকাংশ মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এ ধরনের ১৪টি মৃতদেহ তিনি তাঁর গবাদিপশু প্রজনন কেন্দ্রে পড়েছিল। তাঁর জমি মরুময় হওয়ায় পানিস্বল্পতার কারণে এ ধরনের মৃত্যু ঘটে। তিনি বলেন, প্রথম দিকে এঁদের জন্য মনঃকষ্ট হতো, কিন্তু সে অনুভূতি উবে গেছে। অবৈধ অভিবাসীদের অনুপ্রবেশ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর টহলে তাঁর সম্পত্তি ও পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পানির লাইন বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। বেড়া ভেঙে ফেলে। এগুলো তাঁকেই আবার নিয়মিত মেরামত করতে হয়।

আর্থিক ছাড়াও ল্যাডদের মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতিও ভয়াবহ। রাতে তাঁরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত বা উদ্বিগ্ন থাকেন। তাঁরা ঘুমে থাকাকালে অবৈধ ব্যক্তিরা দেয়াল ভেঙে তাঁর ঘরে ঢুকে পড়ে কি না। ল্যাড হতাশ ও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও তিনি ট্রাম্পের দেয়াল নির্মাণের পরিকল্পনার সঙ্গে একমত নন। তবে তিনি ট্রাম্পের সীমান্ত নিরাপত্তার সমস্যা মিটিয়ে ফেলার ভাবনা সমর্থন করেন।

ল্যাডের সম্পত্তি থেকে ২৫ মাইল পুবে ১৬ হাজার ৫০০ বাসিন্দার নীরব শহর ডগলাস। এ শহরের নিকটবর্তী মেক্সিকোর সীমান্তবর্তী আগুয়া প্রিইটা। মেক্সিকো থেকে পথচারীরা ও দলে দলে ছেলেমেয়েরা হেঁটে দৈনিক স্কুলে আসা-যাওয়া করে। ২০১৬ আর্থিক বর্ষে ৩ দশমিক ৮ মিলিয়ন মানুষ মেক্সিকো থেকে গাড়ি কিংবা হেঁটে ডগলাস সিটিতে প্রবেশ করে। ২০১৬ সালের মার্চে ৩ লাখ ১৭ হাজার ২৪৯ জন ডগলাসে আসে। দৈনিক প্রায় ১০ হাজার ২৩৪ জন, যা এ শহরের মোট বাসিন্দাদের অর্ধেকের বেশি।

ডগলাস সিটির বাসিন্দা ৬৬ বছর বয়সী জি টি ব্রহমফ্লাক স্থানীয় একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক। তাঁর মতে, বৈধ বনাম অবৈধ অভিবাসীদের মধ্যকার পার্থক্য রয়েছে। প্রতিদিন বৈধভাবে বহু লোক সীমান্ত অতিক্রম করেন। তাঁদের ভিসা কিংবা শপিং কার্ড রয়েছে। তাঁরা বৈধ প্রবেশপথেই আমেরিকায় প্রবেশ করেন। আমাদের শহরের অর্থনীতি যতটা এ শহরের ওপর নির্ভরশীল, তার চেয়ে মেক্সিকোর নাগরিকদের ওপর বেশি নির্ভরশীল। তাঁর মতে, রাজনৈতিক কিংবা অন্য উপায়ে মেক্সিকানদের আগমন বন্ধ বা ব্যাহত হলে এ শহর এবং এর অর্থনীতির ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ব্রহমফ্লাকের বিশ্বাস, ট্রাম্প ডগলাসের ভুলে যাওয়া বাসিন্দাদের মনে রাখবেন।

বৃহত্তর ডগলাস চেম্বার অব কমার্স নির্বাহী পরিচালক ন্যুবিয়া রোমো (৩৬) বলেন, ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে এ সিটির চারটি দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। বহু বছর থেকে চালু এসব দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়া হৃৎকম্প বন্ধ হওয়ার মতো। তিনি বলেন, অনেক বছর ধরে আমরা সীমান্তকেন্দ্রিক ব্যবসার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু তা ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছে মেক্সিকো পেসো ধসের কারণে।

৪৩ বছর বয়সী জাতীয় সীমান্তপ্রহরী কাউন্সিলের সহসভাপতি এবং সীমান্তপ্রহরী ইউনিয়নের সভাপতি আর্ট ডেল কিউটো সীমান্ত প্রশ্নে ট্রাম্পের নীতিকে সমর্থন করেন। তিনিও ডগলাস সিটির বাসিন্দা। তিনি সীমান্তরক্ষী হিসেবে নিবেদিত ও গর্বিত। তিনি জানান, সীমান্তে নজরদারি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব। সর্বশেষ হিসেবে, ২০১৬ সালে ৫৮৫টি হামলার ঘটনা ঘটেছে।

তুকসন সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত ডগলাস অধিকসংখ্যক সীমান্তরক্ষী অধ্যুষিত। চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি ৩ হাজার ৭৯৫ জন রক্ষী সীমান্তে নিয়োজিত ছিলেন। তুকসন সীমান্তে প্রতি মাইলে ১৪ জন রক্ষী রয়েছেন। ২০১৬ সালে এ সীমান্তে সর্বাধিক পরিমাণ ৭ লাখ ২৮ হাজার ৩৬৭ পাউন্ড মারিজুয়ানা আটক করা হয়। একই সময়ে এ সীমান্তে মৃত্যু ঘটে ৮৫ জনের।

কিউটো মনে করেন, সীমান্তে বর্তমানে বিদ্যমান বেড়া অপর্যাপ্ত। টেকসই দেয়াল দুর্দান্ত লোকদের সীমান্ত অতিক্রমকে দুরূহ করবে। তাঁদের বিশ্বাস ট্রাম্প দেয়াল তৈরিতে অবিচল থাকবেন।

স্থানীয় হাইস্কুলে সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক শানি জেপেডা (৩১) ডগলাসেই বড় হয়েছেন, যে ধরনের দেয়ালই নির্মাণ করা হোক না কেন, তা অতিক্রমযোগ্য। তিনি দেয়ালকে জাতিগত বিদ্বেষ হিসেবে বিবেচনা করেন না। ব্রহমফ্লাকও মনে করেন, এটা জাতিগত বিদ্বেষের বিষয় নয়, এর সঙ্গে নিরাপত্তা জড়িত।

অ্যালেক্স এসপোনাসা (৫৫) ডগলাস সিটিতেই বড় হয়েছেন। তাঁর পিতামাতা মেক্সিকো থেকে আগত অভিবাসী। ট্রাম্পকে সমর্থন দেওয়ার জন্য তাঁকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। তবে এতে তিনি ভীত নন। সীমান্ত অদূরে তাঁর একটি দোকান রয়েছে। তাঁর মতে, ডগলাসের বহু পরিবার অগুয়া প্রেইটার। কাজ করার জন্য তাঁরা এখানে থাকেন। মেক্সিকো থেকে এসেছেন এমন বহু পরিবার সীমান্তেই অবস্থান করে। অবৈধ অভিবাসীদের আগমন রোধে কারও আপত্তি নেই। তবে যেন বৈধ ব্যক্তিরা ক্ষতিগ্রস্ত না হন।

সীমান্ত দেয়ালের রাজনীতি নিয়ে আমেরিকার রাজনীতিবিদদের মতো জনগণও বিভক্ত। অনেকেই বলছেন, সীমান্তের দেয়াল টপকানো যাবে, অভিবাসীরাও আসবে। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প মনের যে অদৃশ্য দেয়াল আমেরিকার সমাজে তুলেছেন, তা কোথায় গিয়ে ঠেকবে—এ নিয়ে ভাবিত আমেরিকার অনেকেই।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: