ঢাকা | সোমবার, ২১ এপ্রিল ২০২৫, ৮ বৈশাখ ১৪৩২

চীনা গুপ্তচরের বয়ানে মুসলিম উইঘুর নির্যাতন

Mahbubur Rohman Polash | প্রকাশিত: ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১৫:১২

Mahbubur Rohman Polash
প্রকাশিত: ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১৫:১২

স্টিভ চাও

তুরস্কের কয়লাখনির শহর জঙ্গুলডাকে চীনা গুপ্তচরের দেখা পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু, ইউসুফ আমাত আমাদের সঙ্গে এখানেই দেখা করতে চেয়েছেন।

কৃষ্ণসাগরের পাশে হোটেলের লবিতে বসে তার জন্য অপেক্ষা করতে করতে ভাবছিলাম, কেমন ধরনের মানুষ তাদের প্রতিবেশী, বন্ধু এমনকি পরিবারের লোকজনের সম্পর্কে সরকারকে তথ্য দিতে রাজি হয়।

বিশেষ করে যখন মানবাধিকার সংগঠনগুলো ওই সরকারের বিরুদ্ধে নির্মমভাবে গণগ্রেফতার ও বন্দি করার অভিযোগ করে আসছেন।

আমাত কাঁচের দরজা ঠেলে ঢোকার সময় আমি তাকে প্রায় খেয়ালই করিনি। ধূসর অভারঅল, ধূসর সুতির হ্যাট, আর ভারী জ্যাকেট পরিহিত লোকটার কোনো কিছুই চোখে পড়ার মতো নয়।

‘নি হাও (হ্যালো)’, ম্যান্ডারিন ভাষায় নরম স্বরে স্বাগত জানিয়ে হাত মেলাতে মেলাতে আমাত বললেন, ‘দেরি করার জন্য দুঃখিত। গ্যাস স্টেশনে কাজ শেষ করতে করতে দেরি হয়ে গেছে। এরপর কয়েকবার বাস বদলে এখানে এসেছি।’

আমাত একজন উইঘুর। চীনের এই সংখ্যালঘু মুসলিমদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দমন অভিযান শুরু করেছে বেইজিং।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক একটি প্যানেল বলছে, এই অভিযানে প্রায় ১০ লাখ উইঘুরকে বন্দি করে রা হয়েছে। চীন এই বন্দিশালাগুলোকে ‘পুনঃশিক্ষা কেন্দ্র (reeducation centres)’ হিসেবে অভিহিত করে আসছে।

আমার কাজ ছিল কর্মকর্তাদের তথ্য দেয়া, ব্যাখ্যা করে আমাত বলেন, ‘লোকজন যা করত, আমি সেই সব কিছুর রিপোর্ট দিতাম। ওরা কী খায়, নিজের বাড়িতে কী করে, বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়-স্বজন সবার কথা বলে দিতাম।’

তিনি জানান, তার তথ্য কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হতো।

আমাতকে যেটা মর্মাহত করত, উনি জানান, সেটা হচ্ছে কর্মকর্তারা মানুষকে ‘নির্দোষ এবং তুচ্ছ’ সব কারণে গ্রেপ্তার করতেন।

‘আপনার হয়তো লম্বা দাড়ি আছে বা ফোনে ধর্মীয় লেখা রয়েছে, অথবা বিদেশে পড়ালেখা করেছেন, অথবা দেশের বাইরের কারও সঙ্গে দীর্ঘসময় ফোনে কথা বলেছেন। এই কারণেও আপনাকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে।’ যোগ করেন আমাত।

তিনি জানান, ২০১২ সালে গুপ্তচরবৃত্তি শুরু করেন। কারণ, কর্মকর্তারা তার মাকে গ্রেপ্তার করে নির্যাতন করছিল। আমাত ওদের হয়ে কাজ না করলে তাকে বন্দি করে রাখারও হুমকি দেয় কর্তৃপক্ষ।

‘আমি ছোটবেলা থেকেই ঠিক করেছিলাম মাকে সুরক্ষিত রাখব। কিন্তু, আমি সেটা করিনি। ওরা যখন আমাকে উনাকে দেখা করতে নিয়ে যায়, আমার এমন কষ্ট হয়েছিল!’ জানান আমাত।

আমাতের নিয়োগকর্তা ওকে গুপ্তচরবৃত্তির জন্য বিদেশেও পাঠিয়েছিলেন। বিশ্বজুড়ে গুপ্তচরবৃত্তির নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করতে আমাতকে ২০১২ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও তুরস্কের উইঘুরদের সঙ্গে মিশতে বলা হয়। বিশ্বজুড়ে বেইজিংয়ের ‘অসংখ্য’ ইনফর্মার রয়েছে বলে জানান তিনি।

‘আমি কারামায় নামের ছোট একটা টাউন থেকে আসছি। আমার মতো আরও বহুজনকে পরিচালনা করেন আমার নিয়োগকর্তা। জিঞ্জিয়াংজুড়ে কয়েক ডজন এ রকম ছোট শহর রয়েছে। আর বড় শহরতো আছেই। তার ওপর আছে আন্তর্জাতিক কার্যক্রম। আপনি ভাবতেই পারছেন কতগুলো চোখ নজরদারি করছে।’

চীন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আরও সাহসী হয়ে উঠছে দাবি করে আমাত বলেন, ‘সরকার বিদেশেও উইঘুরদের গ্রেপ্তার করেছে।’

চীনে ফিরে যাওয়ার পর অনেকেই পুনঃশিক্ষা কেন্দ্রে নিখোঁজ হয়ে যান, বলেন তিনি।

উইঘুরদের যথেচ্ছভাবে গ্রেপ্তার করে আটকে রাখার অভিযোগ অস্বীকার করেছে চীনের সরকার। তারা বলছে, এসব কেন্দ্রে মানুষ ‘স্বেচ্ছায়’ পেশাগত প্রশিক্ষণ নিতে যায় এবং ‘চরমপন্থী’ মনোভাব দূর করার জন্য কাজের প্রশিক্ষণ দিতে এসব জায়গার নকশা করা হয়েছে।

আমাত বলেন, সরকার ‘ডাহা মিথ্যা বলছে’ এবং তিনি নিজে এমন বন্দিশালায় দেড় বছর আটক ছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যে পালিয়ে গিয়ে মুসলিম যোদ্ধাদের সঙ্গ দিতে চাওয়ার অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।

সাজাভোগ করার সময় কর্তৃপক্ষ তাকে গুপ্তচর হিসেবে নিযুক্ত করে। ইনফর্মার হতে রাজি হওয়ার পর তাকে বন্দিশালা পরিষ্কার করার কাজ দেয়া হয়।

এই কাজ করার সময় এই কেন্দ্রগুলোর অনেক জায়গায় প্রবেশের সুযোগ পান তিনি।

‘ভেতরে জিজ্ঞাসাবাদের সময় অনেক মানুষকে মার খেতে দেখেছি। কোনো কোনো সময় খালি বৈদ্যুতিক তার (ইলেকট্রিক কর্ড) ব্যবহার করা হতো, যাতে কল্পনাতীত ব্যথা লাগে। যাদের মারা হয়, বিশেষ করে আমার মতো বয়সের নারীরা, তারা ভয়ানক চিৎকার করেন। আমি যেটা ভুলতে পারি না সেটা হচ্ছে রক্ত- মেঝেতে, দেয়ালে সব জায়গায় পড়ে থাকত মানুষের রক্ত,’ বলেন আমাত।

প্রায় এক ডজনেরও বেশি সাবেক বন্দির সঙ্গে কথা বলেছে কাতারের সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা। এদের অনেকেই এসব কেন্দ্রে নির্যাতন ও টর্চার দেখেছে বা ভোগ করেছেন।

আব্দুওয়েলি আইউপ নামের একজন লেখক ও শিক্ষক ২৫ মাস ছিলেন জিঞ্জিয়াংয়ের রাজধানী উরুমকির এমন তিনটি বন্দিশালায়। গ্রেপ্তারের দিন পুলিশ অফিসাররা তাকে একটি সেলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে বলে অভিযোগ করেছেন আইউপ।

‘প্রথম দিনটা খুব খারাপ কেটেছিল,’ বলেন আইউপ। ‘ওরা মার কাপড়-চোপড় খুলে নিয়ে আমার পাছায় চাপড় দেয় এবং নির্যাতন করে... প্রায় ২০ জনেরও বেশি চীনা লোক। পরের দিন পুলিশ আমাকে জিজ্ঞেস করে কোনো একদিন যদি তোমরা ক্ষমতা পাও, তাহলে কী করবে আমাদের জন্য?’ আমি বললাম, ‘আমি একটা মানুষ, আমি তোমাদের মতো জন্তু নই।’

এরপরের মাসগুলোতে তাকে অন্য বন্দিরা নিয়মিত পেটাত বলে জানান আইউপ। কারারক্ষীদের ডাকলেও ওরা শুনত না।

‘ওরা চাইতই আপনাকে এভাবে নির্যাতিত করতে। এভাবে টর্চার করা হলে জিজ্ঞাসাবাদের সময় ওদের সাহায্য করা আপনার জন্য সহজ হয়।’

আইউপ বলেন, ধর্ষণ ও মারধর করানো হতো যেন তিনি স্বীকার করেন, তিনি একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী বা সন্ত্রাসী।

‘আমি একজন শিক্ষক, আমি একজন পণ্ডিত লোক। আমি জীবনে এসব নিয়ে ভাবিনি। আমি কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী নই। আমি কী স্বীকার করব?’ জানতে চান তিনি।

চীন কর্তৃপক্ষ শিশুদের জন্য উইঘুর ভাষা শেখা নিষিদ্ধ করে দেয়ার পর আইউপ উইঘুরের স্কুলগুলোর জন্য টাকা তোলায় তাকে বন্দি করা হয়েছিল।

‘ওরা উইঘুর মুছে ফেলতে চায়। ওরা চায় উইঘুররা চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টিকেই ঈশ্বর মনে করুক,’ বলেন আইউপ।

মুক্তি পাওয়ার পর আইউপ আবারও গ্রেপ্তার হওয়ার ভয়ে ছিলেন। এ কারণে তিনি পালিয়ে তুরস্কে চলে আসেন। এখানে উইঘুরদের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে এবং গত কয়েক দশকে হাজার হাজার উইঘুর এখানে বসবাস শুরু করেছে।

ইস্তাম্বুলে আইউপ উইঘুর বন্দিদের গল্প লিপিবদ্ধ করছেন।

এদেরই একজন হচ্ছেন গুল্বাখার জালিলুয়া।

আইউপ আমাদের শহরের একটি সেফ হাউজে নিয়ে যায় তার সঙ্গে দেখা করতে। নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন গুল্বাখার জালিলুয়া।

‘আমি বন্দি ছিলাম এক বছর তিন মাস ১০ দিন। আমি প্রতিটি ঘণ্টা, প্রতিটি মুহূর্ত গুণেছিলাম। এক ঘণ্টা মনে হতো এক বছরের সমান,’ বলেন তিনি।

জালিলুয়া বলেন, তার কাপড়ের ব্যবসার জন্য একটি চালান নেয়ার সময় জিঞ্জিয়াংয়ে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি যে কারণে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিলেন তা হলো- তিনি চীনের নাগরিকই নন। উনি যখন কর্তৃপক্ষকে জানান, তিনি কাজাখস্তানের নাগরিক, তখন ওরা স্রেফ তার পরিচয় চেপে গিয়েছিল।

ওরা আমকে একটা চাইনিজ নাম আর আইডি নাম্বার দিয়েছিল যেন কাজাখস্তানের দূতাবাস আমাকে খুঁজে না পায়, বলেন এই নারী।

জালিলুয়াকে কীভাবে ছোট একটা সেলে ৩৫ জন নারীর সঙ্গে গাদাগাদি করে রাখা হয়েছিল এবং ও ভয়াবহ জিজ্ঞাসাবাদ করা হতো তার বর্ণনা দেন। কখনো কখনো ২৪ ঘণ্টা চলত জিজ্ঞাসাবাদ।

‘ওরা আমার মাথায় কালো হুড পরিয়ে দিত, হাতকড়া লাগাত, শিকল দিত... পায়ে কড়ার কারণে আমি হাঁটতে পারতাম না, তখন ওরা আমাকে ধাক্কাত। পড়ে গেলে ওরা টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যেত ইন্টারোগেশন রুমে।’

জালিলুয়া বলেন, সে ও অন্যান্য মুসলিম বন্দিদের জন্য নামাজ পড়া নিষিদ্ধ ছিল। ওরা সবসময় ভয়ে থাকত, ওরা গোপনে এটা করছে জানতে পেরে ওদের শাস্তি দেয়া হবে।

বন্দিশালায় ওর ওজন ৩০ কেজি কমে গিয়েছিল। কিন্তু, তার সঙ্গে যে আচরণ করা হতো সেটা চীনের উইঘুরদের অবস্থার তুলনায় ভালো।

‘ওখানে পাতিগুল নামের একটা মেয়ে ছিল। একদিন দেখি চুল আউলাঝাউলা করে ফিরে আসছে...। ও আমাকে ওর মাথার ডান পাশটা দেখালো। বেদম মার খেয়ে ওই জায়গা ফুলে ফেটে রক্ত পড়ছিল।’

চীনা কর্তৃপক্ষ নির্যাতনের সব অভিযোগ ঢালাওভাবে অস্বীকার করে আসছে এবং এই ‘পুনঃশিক্ষা’ কেন্দ্রগুলো বন্ধ করতে আন্তর্জাতিক মহলের আহ্বান উপেক্ষা করছে।

সরকার বলছে, তারা জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের এসব কেন্দ্র ঘুরে দেখতে দেবে, যদি তারা ‘চীনের আইন মেনে চলে, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করে এবং এর বদলে নিরপেক্ষ বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে।’

আমাত বলেন, তার পক্ষে আর তার জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতনের বিষয়ে চুপ করে থাকা সম্ভব নয়।

‘চীন মনে করছে ওরা যেটা করছে, সেটা সঠিক। কিন্তু, ওরা ভুল করছে,’ বলেন তিনি। ‘হ্যাঁ, প্রত্যেক দেশের নিজস্ব আইন রয়েছে। কিন্তু, সর্বব্যাপী একটা আন্তর্জাতিক আদর্শও রয়েছে।’

আমার মতে, ‘ওরা এই আদর্শ চরমভাবে লঙ্ঘন করছে। নিজেদের মতো স্বাধীনভাবে জীবন যাপনের অধিকার উইঘুরদের নেই।’

সগোত্রীয় উইঘুরদের ওপর গুপ্তচরবৃত্তি করায় আমাত অনুশোচনায় ভুগছেন বলেও জানান।

এখন তিনি এসব তথ্য কেন প্রকাশ করছেন, জানতে চাইলে আমাকে তিনি বলেন, ‘তার এখন হারাবার বিশেষ কিছু নেই। ওর গুপ্তচরবৃত্তির কারণে তার পরিবারের বেশিরভাগ লোককেই বিভিন্ন বন্দিশালায় রাখা হয়েছে।’

‘আমার বোন, আমার মা, আমার দুলাভাই, ওর ভাই, ওদের বাবা-মা, আমার মামা... এরা সবাই কারাগারে। সবাই ওখানে রয়েছে।’

আমাত বলেন, তিনি জঙ্গুলডাকে চলে এসেছেন। কারণ, এখানে অল্প কিছু উইঘুর বাস করে। এখানে চীনা কর্মকর্তারা তাকে বেশি গুপ্তচরবৃত্তি করতে বলতে পারবেন না।

কিন্তু, এখন সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলায় তাকে কর্তৃপক্ষের রোষের মুখে পড়তে হতে পারে বলেও মনে করেন আমাত।

তবে, তিনি এজন্য প্রস্তুত আছেন বলে জানান, এটা শুধু আমার নিজের পরিবারের জন্য করিনি, প্রতিটি উইঘুরের হয়ে কথা বলার জন্য আমি এটা করেছি। ওরা সবাই আমার পরিবার। আমার নিজের জীবন কোনো ব্যাপার না। যা হবে, হবে। আমি যথেষ্ট বেঁচে থেকেছি।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: