
দেশের সব রোগীর জন্য ‘ডিজিটাল হেলথ কার্ড’-এর কথা ভাবতে পারি। এখন যেহেতু প্রাপ্তবয়স্ক সবার ন্যাশনাল আইডি কার্ড হয়ে গেছে, তাই একে ব্যবহার করে সবার জন্য আলাদা হেলথ কার্ড তৈরি করা খুব কঠিন নয়।
একটি দেশের স্বাস্থ্যসেবা মানে শুধু চিকিৎসাসেবা নয়। তার সঙ্গে রোগ প্রতিরোধ, ওষুধের সহজপ্রাপ্যতা, মানসম্পন্ন খাদ্য-ওষুধ-প্রসাধনীর ব্যবহার, স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধি ইত্যাদি সবই সুস্বাস্থ্যের নিয়ামক। বর্তমান সরকার যে স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন করেছে, তারও মূল সুর এটিই।
বিগত দশকে সরকার স্বাস্থ্য খাতে একের পর এক যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, তা সুচিন্তিত। ২০১৬ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গড়া ১০ হাজার ৭২৩টি কমিউনিটি ক্লিনিক, যেগুলো বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ২০০১ সালে বন্ধ করে দিয়েছিল, সেগুলোসহ নতুন আরো বেশ কয়েক হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক এই সরকার আবার চালু করেছে। এখন এসব ক্লিনিক থেকে গ্রামের মানুষ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে। তাদের আর দূরের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতালে কষ্ট করে যেতে হচ্ছে না। তারা নিজেদের বাড়ির কাছেই চিকিৎসা পরামর্শ ও ওষুধ পাচ্ছে। ৩০টি ওষুধ তারা এখান থেকে বিনা মূল্যে পাচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায়ে স্বাস্থ্য পরিচর্যার জন্য এই ৩০টি ওষুধই যথেষ্ট। পরিবার পরিকল্পনা সেবা ও জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীও জনগণ এখান থেকেই পাচ্ছে। এর ফলে ইতিমধ্যেই গ্রামাঞ্চলের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় ইতিবাচক পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে। সারা দেশে সরকারের এ রকম মোট ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক সঠিকভাবে কাজ করতে পারলে আমাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার ক্ষেত্রে বিরাট ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে, তা সহজেই ধারণা করা যায়। এ খাতে যে বিপুল জনবল দরকার, তাও সরকার নিয়োগ দিয়েছে। এই ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রতিটিতে ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্য সহকারী নিয়োগ এবং তাদের গ্রামে রাখার চিন্তাটাই তো একটা বিপ্লবী চিন্তা।
হাসপাতালে জরুরি চিকিৎসাসেবা দেয়ার পদ্ধতিকে আরো কার্যকর করার লক্ষ্যে সরকার সব হাসপাতালের জরুরি বিভাগগুলো সংস্কার করেছে। জেলা পর্যায় পর্যন্ত সব হাসপাতালে ‘ইমার্জেন্সি কেয়ার ইউনিট’এবং অনেক হাসপাতালে ‘ট্রমা সেন্টার ও ‘বার্ন ইউনিট’ চালু করা হয়েছে।
দেশে চিকিৎসকসংকটের চেয়েও নার্সসংকট প্রকট। সরকার তাই সরকারি-বেসরকারি উভয় পর্যায়ে নার্সিং কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে। তারই অংশ হিসেবে ঢাকায় নতুন আন্তর্জাতিক মানের নার্সিং ইনস্টিটিউট ও দেশের বিভিন্ন জায়গায় আরো ১৩টি নার্সিং স্কুল স্থাপন এই সংকট মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। চিকিৎসকসংকট মোকাবিলায় আরো সরকারি মেডিকেল কলেজ ও মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে আরো মেডিকেল কলেজ এবং ডেন্টাল কলেজ চালু করার অনুমতি দিচ্ছে সরকার। এসবই স্বাস্থ্য খাতে দক্ষ জনবলসংকট নিরসনে নেয়া ভালো উদ্যোগ।
Sarakhon
সরকার স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ডিজিটাল প্রযুক্তিকেও ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। এরই অংশ হিসেবে সরকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং সব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার অফিস, জেলার সিভিল সার্জন অফিস, সব মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ, সব হাসপাতাল, সব বিশেষায়িত চিকিৎসা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ইন্টারনেট সংযোগ দিয়েছে। ওয়েব ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে দেশের ৬টি বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ও ৬৪টি জেলার সব সিভিল সার্জন অফিসে। বিনা মূল্যে মোবাইল ফোনে সব জেলা ও উপজেলা হাসপাতাল থেকে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অর্থাৎ এখন জেলা ও উপজেলা হাসপাতালগুলো থেকে মানুষ বিনা মূল্যে মোবাইল ফোনের মাধ্যমেও স্বাস্থ্যসেবা পাবে। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের এই উদ্যোগ দেশের স্বাস্থ্যক্ষেত্রের চেহারাই পাল্টে দেবে বলে আশা করা যায়।
তবে এখানেই সীমাবদ্ধ না থেকে ডিজিটাল প্রযুক্তিকে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে আরো অনেকভাবেই ব্যবহার করা যেতে পারে। একজন ডাক্তার যদি রোগীর আগেকার অসুখ ও চিকিৎসাগুলো সম্পর্কে জানেন, তা হলে তার কার্যকর চিকিৎসা দেয়া অনেক সহজ হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে দেশের সব রোগীর জন্য ‘ডিজিটাল হেলথ কার্ড’-এর কথা ভাবতে পারি। এখন যেহেতু প্রাপ্তবয়স্ক সবার ন্যাশনাল আইডি কার্ড হয়ে গেছে, তাই একে ব্যবহার করে সবার জন্য আলাদা হেলথ কার্ড তৈরি করা খুব কঠিন নয়। সেখানে তার আর্থিক সংগতি, রক্তের গ্রুপ, কোনো ওষুধে বা খাদ্যে তার অ্যালার্জি আছে কি না, তার অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স, রক্তচাপ, ডায়াবেটিস বা হৃদ্যন্ত্রের অসুখ আছে কি না ইত্যাদি সব তথ্যই রাখা যেতে পারে। কার্যকর চিকিৎসার জন্য এসব তথ্যই অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এর ফলে রোগীকে অযথা ভুগতে হবে না এবং চিকিৎসককেও একটার পর একটা ওষুধ দিয়ে রোগ নিরাময়ের চেষ্টা করতে হবে না। মাথাপিছু ওষুধের ব্যয় কমে যাবে বলে সরকারেরও আর্থিক সাশ্রয় হবে। সরকার সারা দেশের হাসপাতালগুলোকে কম্পিউটার নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসার ফলে অপ্রাপ্তবয়স্ক যাদের ন্যাশনাল আইডি কার্ড নেই, তাদেরও ক্রমান্বয়ে এই নেটওয়ার্কের আওতায় আনা যাবে। এর আরো সুফল হলো যে, মানুষ ধীরে ধীরে বেসরকারি ডাক্তারদের কাছে যাওয়ার বদলে সরকারি হাসপাতালমুখী হবে। চিকিৎসা নিয়ে মানুষের হয়রানি ও খরচ উভয়ই কমবে।
পুরোনো প্রেসক্রিপশন, ল্যাবরেটরি পরীক্ষার ফলাফল, এক্স-রে, আলট্রাসনোগ্রাম, সিটি স্ক্যান, এমআরআই ইত্যাদি সব রিপোর্ট একজন রোগীর পক্ষে সব সময় বহন করা কষ্টসাধ্য। কিন্তু ডিজিটাল হেলথ কার্ডের এ পদ্ধতিতে এগুলো সবই তার কার্ডের মাধ্যমে ইন্টারনেট বা জাতীয় সার্ভারে থাকবে। এখানে নতুন রিপোর্ট ঢোকানো, পুরোনো রিপোর্ট ফেলে দেয়া কিংবা যখন তখন পিসি, ল্যাপটপ বা স্মার্টফোনে ডাউনলোড করে প্রয়োজনমতো দেখে নেয়া সম্ভব। এমনকি রোগী যদি নিজ বাড়ি থেকে অনেক দূরে আরেক শহরে বা গ্রামে বা রাস্তায় বা বিদেশের কোথাও অবস্থানের সময় অসুস্থ হয়ে পড়ে, তখনো তার চিকিৎসক অনায়াসেই ডিজিটাল হেলথ কার্ড দেখে ইন্টারনেটের মাধ্যমে তার যাবতীয় প্রেসক্রিপশন বা দরকারি রিপোর্ট ইত্যাদি দেখে তাকে দ্রুত সঠিক চিকিৎসা দিতে পারবেন। উন্নততর চিকিৎসা দেয়ার ক্ষেত্রেও ডিজিটাল হেলথ কার্ড থেকে আরো সুবিধা পেতে পারি, হোক তা দেশে কিংবা বিদেশে। ডিজিটাল হেলথ কার্ড বা ই-হেলথ কার্ড যে নামেই ডাকি না কেন, এটা সারা দেশে প্রচলনের জন্য সরকার যদি উদ্যোগ গ্রহণ করে, তাহলে অবশ্যই চিকিৎসাক্ষেত্রে তথ্যহীনতা, তথ্য বিভ্রাট, ভুল বা অনুমাননির্ভর চিকিৎসা ইত্যাদি কমবে। একই ডায়াগনস্টিক টেস্ট তাকে বারবার করতে হবে না। ফলে রোগীর অর্থেরও অনেক সাশ্রয় হবে। রোগীকে অযথা রিপোর্টের বোঝা বয়ে বেড়াতে হবে না। অর্থাৎ প্রস্তাবিত এই ডিজিটাল হেলথ কার্ড চালু হলে তা হবে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের অতি যুগান্তকারী আরেকটি পদক্ষেপ এবং ইতিহাসের অংশ।
দেশের হাসপাতালগুলোর জরুরি চিকিৎসাসেবাকে উন্নত করার জন্য সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে, রোগীদের জন্য তা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কারণ জরুরি চিকিৎসাসেবা সাধারণ চিকিৎসার চেয়ে কঠিন। এসব ক্ষেত্রে রোগীকে বাঁচানোর স্বার্থেই ডাক্তার সময়ক্ষেপণ করতে পারেন না, তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় অতি দ্রুত। এখানে ডাক্তারকে হতে হয় অত্যন্ত দক্ষ ও অভিজ্ঞ। প্রচলিত ব্যবস্থায় জটিল কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে স্পেশালিস্টের সঙ্গে কথা বলার তার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু জরুরি বিভাগগুলোতে ডিজিটাল প্রযুক্তি চালু করা গেলে রোগীর হেলথ কার্ড যেমন চট করে দেখে নেয়া যায়, তেমনি ওয়েব ক্যামেরার সাহায্যে ডাক্তার অতি দ্রুত তার সিনিয়র বা স্পেশালিস্টের কাছ থেকে দিকনির্দেশনা নিতে পারেন। এমনকি উপস্থিত না থেকেও স্পেশালিস্ট রোগীকে সরাসরি চিকিৎসা করতে পারেন। ফলে জরুরি বিভাগে চিকিৎসাসেবার মান অনেক উন্নত হবে এবং মৃত্যুহারও অনেক কমে যাবে।
প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা তাঁর ‘রূপকল্প ২০২১’ পরিকল্পনায় বলেছেন। সেই পরিকল্পনাকে বিরোধীরা যতই বিকৃত করে প্রচার করুক, স্বাস্থ্য সেক্টরে এসব ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে সরকার দেখিয়ে দিতে পারে যে অদূর ভবিষ্যতের ডিজিটাল বাংলাদেশ কোনো কল্পনা নয়। এভাবে স্বাস্থ্য খাতের মতো অন্যান্য সেক্টরেও ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাংলাদেশ অবশ্যই এগিয়ে যেতে পারে।
স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে, শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর হার আরো কমাতে, প্রবৃদ্ধির হার ২ অঙ্কের ঘরে উন্নীত করতে এবং ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে প্রধানমন্ত্রী যে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন, তা বাস্তবায়ন করতে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ডিজিটাল প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তখন সুস্বাস্থ্য আর কোনো নাগরিকের ব্যক্তিগত বিষয় হয়ে থাকবে না, তা হয়ে উঠবে জাতীয় উন্নয়নের অন্যতম হাতিয়ার। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ডিজিটাল হেলথ কার্ডের মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ সুযোগ পুরোপুরি নেয়ার জন্য সরকারের কাছে বিনীত প্রস্তাব রাখছি।
লেখক: সাবেক চেয়ারম্যান, ফার্মেসি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: