
বাংলাদেশে অবকাঠামো নির্মাণের ব্যয় এত বেশি কেন—এই প্রশ্ন উঠেছে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে। এতে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের উপস্থিতিতে আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের (অ্যামচেম) সাবেক সভাপতি আফতাব-উল ইসলাম বলেন, এক কিলোমিটার উড়ালসড়ক বা ফ্লাইওভার নির্মাণে বাংলাদেশে যে ব্যয় হয়, তা সম্ভবত বিশ্বের সর্বোচ্চ খরচের মধ্যে একটি হবে।
আফতাব-উল ইসলাম আরও বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যয় ৫০০ থেকে ৬০০ কোটি ডলার হওয়ার কথা শোনা যাচ্ছিল। পরে দেখা গেল, তা ১ হাজার ২০০ কোটি ডলারের কাছাকাছি হয়েছে। মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন, ‘এত ব্যয়ের পেছনে নিশ্চয়ই কারণ আছে। তা পরিকল্পনামন্ত্রী আমাদের বলবেন।’
অবশ্য পরিকল্পনামন্ত্রীর দীর্ঘ সময়ের বক্তব্যে এ বিষয়ে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। যদিও মুস্তফা কামাল মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে বিতর্কের একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধির হারের ক্ষেত্রে কোনো কারসাজি করা হয়নি।
‘বাংলাদেশের অবকাঠামো’ শীর্ষক ঢাকা চেম্বারের এই গোলটেবিল বৈঠকটি গতকাল বুধবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে অনুষ্ঠিত হয়। তিনটি অধিবেশনের এই আলোচনা সভায় সরকারি সংস্থার প্রধান, কূটনীতিক, বেসরকারি সংস্থা, ব্যবসায়ী সংগঠন ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
স্বাগত বক্তব্যে ডিসিসিআইয়ের সভাপতি আবুল কাসেম খান দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার একটি নির্দিষ্ট অঙ্কে আটকে থাকার কারণ হিসেবে অবকাঠামোর ঘাটতিকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনামের মতো দেশগুলো আজকের অবস্থানে পৌঁছেছে অবকাঠামোতে উচ্চহারে বিনিয়োগ করে। বাংলাদেশের উচ্চহারে প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য ২০৩০ সাল পর্যন্ত ৩০ হাজার কোটি ডলারের বিনিয়োগ লাগবে।
ডিসিসিআইয়ের সভাপতি রেল ও নৌপথের অবকাঠামো উন্নয়নের তাগিদ দিয়ে বলেন, ৮৮ শতাংশ যাত্রী ও পণ্য পরিবহন হয় সড়কপথে। দেশের পরিবহন খাতের এই একপেশে উন্নয়ন বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী এম আমিনুল ইসলাম বলেন, বর্তমান অবকাঠামো দিয়ে বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের সর্বোচ্চ সীমায় চলে এসেছে। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হতে হলে অবকাঠামোর ধাঁচ পাল্টে ফেলতে হবে। তিনি বলেন, ‘হাতে মাত্র ২৪ বছর সময় আছে। আমাদের বহুদূর যেতে হবে, দ্রুত যেতে হবে।’
অনুষ্ঠানের প্রথম অধিবেশনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) বাংলাদেশ, ভুটান ও নেপালের দেশীয় পরিচালক ওয়েন্ডি জো ওয়ার্নার। তিনি বলেন, চীন ১৯৮০ সালে শেনজেন অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলেছিল। সেটি এখন তাদের অর্থনীতিতে ২৭ হাজার কোটি ডলারের অবদান রাখছে।
নির্ধারিত আলোচক হিসেবে অ্যালায়েন্স পোর্টের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ ইয়াসির হায়দার রিজভী বলেন, ‘অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারি খাতের উচিত না বেসরকারি খাতকে প্রতিযোগী হিসেবে দেখা। আমরা কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, আমাদের প্রতিযোগী মনে করা হয়। আমরা প্রতিযোগিতা নই, অবকাঠামো খাতে অবদান রাখছি।’
অবকাঠামোর ব্যয় নিয়ে দুটি অধিবেশনে কথা বলেন আফতাব-উল ইসলাম। তিনি বলেন, প্রতিটি প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় বেশি লাগছে। এ কারণে ব্যয় তিন-চার গুণ বেড়ে যাচ্ছে। তিনি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আর দেরি না করার পরামর্শ দেন।
পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, সরকার চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের সক্ষমতা অনেক বাড়াবে। পাশাপাশি দুটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা হবে। এর একটি চট্টগ্রামে, অন্যটি পটুয়াখালীর পায়রায় হবে। তিনি মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হারের ক্ষেত্রে কোনো কারসাজি করা হয়নি দাবি করে বলেন, প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স কমে গেছে বলে প্রবৃদ্ধি কম হবে, এটা ঠিক না। ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে বিদেশ থেকে প্রবাসী আয় আসছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, টাকার রং সাদা, কালো, হলুদ যা-ই হোক, তা বাংলাদেশে আসছে এবং অবদান রাখছে।
দিনের দ্বিতীয় ভাগে ‘অবকাঠামো উন্নয়নে অন্যকে অনুকরণ?’ শীর্ষক এক অধিবেশনে বেসরকারি সংস্থা পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ যে আর গরিব দেশ নেই, সেটা প্রমাণিত। নতুন করে প্রমাণ করার কিছু নেই। বরং ভবিষ্যতে সামনে এগোতে কী কী সমস্যা আছে তা সমাধানে নজর দিতে হবে।
অনুষ্ঠানে বিডার সচিব অজিত কুমার পাল, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম খালেদ ইকবাল, ডিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আসিফ ইব্রাহিম, পিপিপি কর্তৃপক্ষের প্রধান নির্বাহী সৈয়দ আফসর এইচ উদ্দিন, আবদুল মোনেমের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এস এম মইনুদ্দিন মোনেম প্রমুখ বক্তব্য দেন।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: