
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মাছিও করোনাভাইরাস ছড়াতে পারে না। বলা যায়, এর ফলেও আমাদের আরেকটি বিপদ কমলো। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মাছি ৬৫টি বিভিন্ন রোগ ছড়াতে সাহায্য করে যাদের মধ্যে রয়েছে কলেরা, চোখ ওঠা, ডায়রিয়া, আমাশয়, যক্ষ্মা, টাইফয়েড, স্লিপিং সিকনেস ইত্যাদি। তাই করোনা মহামারির সময়ে মাছি করোনা ছড়ায় না বলে একে অবহেলা করা ঠিক হবে না।
মশা শুধু আমাদের দেশেই নয়, বরং পৃথিবীর বহু দেশে এক জনস্বাস্থ্যগত সমস্যার নাম। সবচেয়ে উন্নত দেশ আমেরিকাও এই সমস্যা থেকে মুক্ত নয়। উত্তর গোলার্ধের উন্নত দেশগুলোতে মশার উপদ্রব শুরু হয় মূলত বসন্তকালের পর। তবে আমাদের দেশে প্রায় সারা বছরই এই উপদ্রব থাকে। বিভিন্ন প্রজাতির মশার প্রজনন বৈশিষ্ট্যও আবার বিভিন্ন রকম। এই ক্ষুদ্র উড়ন্ত প্রাণীটি আমাদেরকে কামড়ে রক্ত শুষে নেয়, ফলে আমাদের কাজের মনোযোগ কমে এবং ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। কিন্তু তার চাইতেও বড় সমস্যা হলো মশা বেশ কিছু প্রাণঘাতী অসুখ ছড়ায়।
মশার মাধ্যমে যেসব ভাইরাস ছড়ায় তাদের মধ্যে বেশি কুখ্যাতগুলো হলো ওয়েস্ট নাইল, ডেঙ্গু, জিকা ও চিকুনগুনিয়া ভাইরাস। ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস আমাদের দেশে অপরিচিত, কিন্তু মারাত্মক রকম প্রাণঘাতী। অনেক ঐতিহাসিকদের মতে, প্রায় অর্ধেক পৃথিবী জয় করা সম্রাট আলেকজান্ডার নাকি মিসর অভিযানের সময় এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন রোগভোগের পর মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
অবশ্য অন্যদের মতে, তার মৃত্যুর কারণ ছিল অতিরিক্ত মদ্যপান ও অগ্ন্যাশয়ের ক্যানসার। যাহোক, নীল নদের পশ্চিম তীরের এলাকায় দাপট দেখানো এই ভাইরাসটি আমাদের দেশে না থাকলেও ডেঙ্গু জ্বর ও চিকুনগুনিয়ার ভাইরাসগুলো বিদেশ থেকেই এখানে এসেছে। এসব ভাইরাসে আক্রান্ত কোনো মানুষকে মশা কামড়ালে মনুষ্যরক্তের মাধ্যমে ভাইরাস মশার পাকস্থলীতে পৌঁছে, সেখানে সংখ্যাবৃদ্ধির পর ভাইরাস মশার লালাগ্রন্থিতে গিয়ে বাসা তৈরি করে বাস করে। এই মশা যখন আবার কাউকে কামড়ায় তখন লালার মাধ্যমে ভাইরাসটি সেই মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। এভাবেই ভাইরাসগুলো মশার মাধ্যমে ছড়িয়ে থাকে।
এডিস, কিউলেক্স ও এনোফিলিস- মূলত এই তিন প্রজাতির মশাই আমাদের জন্য ক্ষতিকর। এদের একেক প্রজাতি একেক রোগ ছড়ানোর জন্য দায়ী। উপরিউক্ত অসুখগুলো ছাড়াও এই তিন প্রজাতির মশা আরও যেসব রোগ ছড়ায় সেটির তালিকা বেশ দীর্ঘ।
এদের মধ্যে রয়েছে ম্যালেরিয়া, ইয়েলো ফিভার, এলিফ্যানটিয়াসিস বা লিম্ফ্যাটিক ফাইলেরিয়াসিস এবং বিভিন্ন রকম এনসেফালাইটিস, যার মধ্যে রয়েছে ক্যালিফোর্নিয়া এনসেফালাইটিস, জাপানিজ এনসেফালাইটিস, ভেনিজুয়েলা এনসেফালাইটিস, সেন্ট লুই এনসেফালাইটিস, ওয়েস্টার্ন একুইন এনসেফালাইটিস, ইস্টার্ন একুইন এনসেফালাইটিস ইত্যাদি। এর সবগুলোই মারাত্মক ও প্রাণঘাতী। তার মানে প্রাণী হিসেবে মশা ক্ষুদ্র হলেও মন্দকর্মে তার ক্ষমতার বলয়টা বিশাল। তবে সুখের বিষয়, সব দেশে এ সবগুলো অসুখ হয় না।
ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার তাণ্ডব আমাদের দেশে কিছুকাল আগেও দেখেছি। এরা অনেক মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছে। এখন করোনা মহামারির এই সময়টাতে আমাদের দেশে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার আক্রমণ বেশ কম। অন্যান্য বছরের মতো এবারও যদি ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব থাকতো এবং সঙ্গে করোনার প্রকোপও অব্যাহত থাকতো, তাহলে আমাদের অবস্থা অনেক শোচনীয় হতো।
প্রকৃতির অনেক রহস্য বিজ্ঞান এখনও জানে না। তাই করোনার প্রাদুর্ভাবকালে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার ভাইরাস অবদমিত থাকে কি না তার কোনো ব্যাখ্যা আমরা এখনও জানি না। তবে ডেঙ্গু আক্রান্ত এলাকায় করোনাভাইরাস যে সুবিধা করতে পারে না, এর প্রমাণ দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে দেখা গেছে। সেখানে যেসব অঞ্চলে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব রয়েছে সেসব জায়গায় করোনাভাইরাসে আক্রান্তের হার খুবই কম। এ সম্পর্কে পরবর্তী কোনো এক সময়ে লেখা যাবে।
এডিস ধরনের মশা ডেঙ্গুসহ অন্যান্য অসুখ ছড়ালেও কভিড-১৯ ছড়াতে পারে না বলে মনে হচ্ছে। এ বিষয়ে সর্বপ্রথম গত বছরের মার্চে ফ্রান্সের মশা-নিয়ন্ত্রক সংস্থা এতেঁত ইন্তারডিপার্তমেন্তেল দ্য দিমউসতিকেশন (ইআইডি) জানিয়েছে যে তাদের কীটতত্ত্ববিদরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, মশা ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার মতো বিভিন্ন প্যাথোজেন ছড়াতে পারলেও করোনাভাইরাস ছড়াতে পারে না। যদি এই ভাইরাস মশার পাকস্থলীতে গিয়ে হজম না হয়ে এই প্রক্রিয়াকে বাধা দিতে পারতো, যদি এটি মশার পাকস্থলীর কোষগুলোকে সংক্রমিত করতে পারতো, কিংবা যদি এটি মশার লালাগ্রন্থিতে বাসা বানাতে পারতো- তাহলে আশঙ্কা ছিল যে, মশার কামড়ে লালার মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়াতে পারতো। তা এখনও হচ্ছে না। যদি ছড়াতে হয় তাহলে মশাকে হাজার বছর ধরে বিবর্তনের ধারায় ধীরে ধীরে নিজেকে রূপান্তরিত করতে হবে। ততদিন মোটামুটি নিশ্চিন্ত যে মশা করোনাভাইরাস ছড়াতে পারবে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গত ৫ এপ্রিল ২০২০ এ বিষয়ে তাদের বিবৃতিতে বলেছে, এখন পর্যন্ত এমন কোনো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি যাতে মনে হতে পারে যে, করোনাভাইরাস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। এই নতুন ভাইরাসটি একটি শ্বাসতন্ত্রের ভাইরাস এবং এই ভাইরাসটি মূলত সংক্রমিত ব্যক্তির হাঁচি বা কাশি দেয়া কিংবা কথা বলার সময় নিঃসৃত অতি ক্ষুদ্র জলীয় কণা বা লালা কিংবা নাকের শ্লেষায় থাকা করোনাভাইরাসের কারণে ছড়ায়।
তাই নিজেকে সংক্রমণমুক্ত রাখতে অ্যালকোহলসমৃদ্ধ হ্যান্ড রাব দিয়ে হাত পরিষ্কার করুন কিংবা সাবান ও পানি দিয়ে ঘনঘন ভালো করে হাত ধোবেন। সেই সঙ্গে হাঁচি ও কাশি দেয়া কারো কাছ থেকে দূরে থাকুন।
এই বক্তব্যের সপক্ষে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ভাইরাস গবেষণার বিখ্যাত পাব-মেড জার্নাল ভাইরোলজিকা সিনিকা এটি প্রকাশ করেছে তাদের জুন ২০২০ সংখ্যায় (ভলিউম ৩৫, নম্বর ৩)। সেখানে গবেষকরা ল্যাবরেটরিতে এডিস মশার দেহকোষে সার্স-কভ-২ প্রবেশ করান। সব ধরনের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা সত্ত্বেও সেই দেহকোষগুলোতে এই করোনাভাইরাসটির সংখ্যা বাড়তে দেখা যায়নি। এরপর তারা করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়া চীনের উহান শহরের আশপাশে থেকে এডিস, কিউলেক্স ও এনোফিলিস জাতের ১ হাজার ১শ’ ৬৫টি মশা ধরে তাদের শরীরে এই ভাইরাস আছে কি না পরীক্ষা করেন। তাদের একটিতেও এই ভাইরাস পাওয়া যায়নি। ফলে তারা এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, মশারা সার্স-কভ-২ ভাইরাস ছড়াতে পারে না।
একইভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মাছিও করোনাভাইরাস ছড়াতে পারে না। বলা যায়, এর ফলেও আমাদের আরেকটি বিপদ কমলো। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মাছি ৬৫টি বিভিন্ন রোগ ছড়াতে সাহায্য করে যাদের মধ্যে রয়েছে কলেরা, চোখ ওঠা, ডায়রিয়া, আমাশয়, যক্ষ্মা, টাইফয়েড, স্লিপিং সিকনেস ইত্যাদি। তাই করোনা মহামারির সময়ে মাছি করোনা ছড়ায় না বলে একে অবহেলা করা ঠিক হবে না।
মনে রাখতে হবে যে, করোনাকালে সুস্থ থাকাটা অত্যন্ত জরুরি বিষয়। তাই যেকোনো রোগ থেকে মুক্ত থেকে ইমিউনিটি বজায় রাখাটা খুব প্রয়োজন। এ সময়ে মাছিকে দূরে রাখার জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবকালে মশা-মাছি জনস্বাস্থ্যের জন্য কোনো হুমকি নয়। তবে মশা-মাছি করোনাভাইরাস ছড়াতে না পারলেও তারা অন্য অসুখগুলো ছড়াতে পারে এবং সেগুলো সবই কমবেশি প্রাণঘাতী। সে কারণে মশা যাতে কামড়াতে না পারে তার জন্য সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের বাড়িঘরের চারপাশে যেন আবর্জনা না জমে, নর্দমায় ময়লা পানি স্থির না থেকে যেন প্রবহমান থাকে, কোনো গর্তে কিংবা পরিত্যক্ত ডাবের খোসা, নারকেলের মালা, ডিব্বা, ফুলের টব, গাড়ির পরিত্যক্ত টায়ার বা অন্য কোনো পাত্রে যেন পানি জমে না থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে।
মাছি নিয়ন্ত্রণের জন্য কীটনাশক, বিভিন্ন রকমের ফাঁদ, আঠালো ট্যাপ, বৈদ্যুতিক নেট ইত্যাদি ব্যবহার করে আমরা ঘরবাড়ির মাছি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। তবে মাছি মারার চাইতে মাছি যাতে না জন্মায় তার ব্যবস্থা করাই জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞান মতে মূল কাজ হওয়া উচিত। ঘরবাড়ি ও অঙিনাসহ চারপাশের পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যসম্মত রাখা এর অন্যতম শর্ত। এর জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কম খরচের চারটি কৌশল গ্রহণ করা যেতে পারে।
১. মাছির প্রজননস্থলকে ধ্বংস করা। এজন্য নোংরা আবর্জনাময় স্থানগুলো পরিষ্কার রাখতে হবে। ২. অন্য এলাকা থেকে মাছি আসা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা। এজন্য ময়লা ও দুর্গন্ধযুক্ত আবর্জনা সরিয়ে ফেলা প্রয়োজন। ৩. রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু ও মাছির সংস্পর্শকে বাধা দেয়া। এজন্য সংক্রামক রোগীদেরকে আলাদা ও পরিচ্ছন্ন জায়গায় রাখা প্রয়োজন। এবং ৪. খাবার, থালা-বাসন, খাবারের সরঞ্জাম ও মানুষের সংস্পর্শে মাছিকে আসতে না দেয়া। এজন্য খাবার ও থালাবাসনকে ঢেকে রাখা, সরঞ্জামাদি ব্যবহারের আগে ধুয়ে নেয়া এবং মানুষের শরীরে যাতে মাছি বসতে না পারে তার ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।
আমরা সাবধান হই। কারণ করোনা নিয়েই আমরা এত বেশি ব্যতিব্যস্ত আছি যে, মশাবাহিত অসুখগুলো ছড়াতে শুরু করলে তা আমাদের জন্য বিপদের কারণ হবে।
লেখক: পরিচালক, বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার।
সাবেক চেয়ারম্যান, ফার্মেসি বিভাগ; সাবেক ডিন, ফার্মেসি অনুষদ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সাবেক আহ্বায়ক, জাতীয় ওষুধনীতি ২০১৬ প্রণয়ন উপকমিটি।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: