ঢাকা | শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সার্বিক সুরক্ষায় সংবেদনশীল বাজেট প্রণয়নের সুপারিশ

amaderodhikarpatra@gmail.com | প্রকাশিত: ৭ ডিসেম্বর ২০২১ ০৫:২৫

amaderodhikarpatra@gmail.com
প্রকাশিত: ৭ ডিসেম্বর ২০২১ ০৫:২৫

 
sharethis sharing button


ঢাকা, ৬ ডিসেম্বর, ২০২১ : প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সার্বিক সুরক্ষা ও উন্নয়নের মূল ধারায় সম্পৃক্ত করতে প্রতিবন্ধীতা সংবেদনশীল সহায়ক জাতীয় বাজেট প্রণয়নের আহ্বান জানিয়েছেন উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ও প্রতিবন্ধী বান্ধব সংগঠনের প্রতিনিধিরা। তারা বলেছেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সার্বিক উন্নয়ন ছাড়া সহ¯শব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। আর এজন্য উন্নয়নের মূল স্রোত ¯্ধারায় তাদের সম্পৃক্ত করতে হবে। 
প্রতিবন্ধী নাগরিক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সালমা মাহবুব বাসস’র সাথে আলাপকালে বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ আছে। আর এই বরাদ্দ আসে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। কিন্তু তাদের চাকুরি, স্বাস্থ্য, প্রশিক্ষণ কিংবা কর্মসংস্থানের জন্য কোন বাজেট নেই। তাদের উন্নয়নের মূল ধারায় সম্পৃক্ত করতে হলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য মন্ত্রণালয়ভিত্তিক বাজেট বরাদ্দ দিতে হবে। উল্লেখ্য, প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য কেবল সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ রয়েছে। এতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অন্যান্য প্রয়োজন ও চাহিদা পূরণে যথাযথ উদ্যোগ ও সহযোগিতা পাওয়ার ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দেয়।     
দেশের প্রায় ৫০ শতাংশ নারী জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূল ¯্রােতধারায় যুক্ত করতে বর্তমান সরকার ২০০৯-২০১০ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো জেন্ডার বাজেট প্রণয়ন করে। প্রাথমিকভাবে চারটি মন্ত্রণালয়কে জেন্ডার বাজেটের অন্তর্ভুক্ত করে পর্যায়ক্রমে তার আওতা বৃদ্ধি করা হয়। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ৪৩ টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে  জেন্ডার ভিত্তিক বাজেটের অন্তর্ভূক্ত করা হয়। ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো শিশুদের জন্য শিশুমুখী বাজেট প্রণয়ন করে সরকার। পর্যায়ক্রমে সরকার শিশুমুখী বাজেটের পরিধিও বৃদ্ধি করে। 
এবছর আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস উপলক্ষ্যে প্রেরিত লিখিত বাণীতে রাষ্ট্রপতি মোঃ আব্দুল হামিদ বলেছেন, “সকল প্রকার শারীরিক, মানসিক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা মানব  বৈচিত্রেরই অংশ। তাই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে তাঁদের উন্নয়নের মূল ¯্রােতধারায় সম্পৃক্ত করা খুবই জরুরি। সমাজের অবিচ্ছেদ্য এ অংশকে সকল নাগরিক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে যথাযথ প্রশিক্ষণ ও তথ্যপ্রযুক্তি জ্ঞানের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। তবেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখতে সক্ষম হবেন।” রাষ্ট্রপতির এই বাণীর মধ্যে দিয়ে প্রতিবন্ধী মানুষের প্রাণের দাবিরই প্রতিফলন ঘটেছে বলে মনে করেন উন্নয়ন বিশেষজ্ঞগণ। 
প্রতিবন্ধী নাগরিক পরিষদের সালমা মাহবুব বলেন, সরকার কোভিডকালিন প্রতিকুলতা পর্যালোচনা করে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে ১৮ লক্ষ থেকে ২২ লক্ষ টাকা করেছে। এতে কেবল তাদের ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় কম। অন্যদিকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শিক্ষা ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু বলা হয়েছে যে, যারা প্রতিবন্ধী ভাতা পান তারা শিক্ষা ভাতা পাবেন না। যেখানে সুরক্ষা ভাতা দিয়ে একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির তিন বেলা খাবার জোটানোই কঠিন সেখানে শিক্ষার খরচ বহন করা অসম্ভব। 
উইমেন উইথ ডিজ্যাবিলিটি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (ডব্লিউডিডিএফ) এর নির্বাহি পরিচালক আশরাফুন নাহার মিষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সার্বিক উন্নয়নের জন্য প্রতিবন্ধীদের জন্য মন্ত্রণালয় ভিত্তিক বরাদ্দ দেয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, “প্রতিরক্ষা ছাড়া জাতীয় বাজেটের প্রতিটি খাতেই প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ থাকা দরকার। স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হলেও প্রতিবন্ধী মানুষ এখনও গণপরিবহনে চলাফেরা করতে পারেন না। উন্নয়নের মহাসড়কে চলতে থাকা বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন দৃশ্যমান হলেও সেখানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রবেশগম্যতার ব্যাপারে যতœশীল উদ্যোগ দেখা যায় না। সুতরাং আইসিটি, যুব উন্নয়ন, সড়ক ও যোগাযোগ, রেল, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, সামাজিক সুরক্ষা, বিমান ও পর্যটন, গণপূর্ত ও আয়কর বিভাগসহ ৪৬টি মন্ত্রণালয়ের প্রত্যেকটিতে প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা বরাদ্দ থাকতে হবে। 
সামাজিক সুরক্ষা কৌশলপত্র ২০২১ অনুযায়ী সাল নাগাদ প্রতিবন্ধী ভাতা ১৫০০ টাকায় উন্নীত করার কথা। কিন্তু এবছরও প্রতিবন্ধীদের জন্য ভাতার পরিমাণ মাসিক ৭৫০ টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে প্রতিবন্ধীদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা খাতে যে ভাতা বেড়েছে তাতে ভাতাপ্রাপ্ত প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু প্রতিবন্ধীাবান্ধব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা মনে করেন, সব ধরনের প্রতিবন্ধী মানুষের ভাতার প্রয়োজন নেই। তাদের প্রয়োজন সমাজে মর্যাদার স্থান। তারা চান আরো দশ জনের মতো নি:সংকোচে সমাজের সুযোগগুলো ভোগ করার অধিকার। আশরাফুন নাহার মিষ্টি বলেন, বাজেটে প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য রেশন, স্বাস্থ্য বীমা, বিনা ভাড়ায় যাতায়াতের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।     
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানের জন্য সরকারি চাকুরিতে ১০ শতাংশ কোটা থাকলেও শিক্ষিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা একটি চাকুরির জন্য বছরের পর বছর লড়ছেন। যশোর জেলার মনিরামপুর উপজেলার জালঝাড়া গ্রামের বাসিন্দা 
শাহ মাখদুম সরকারি এম এম কলেজ থেকে দর্শন শাস্ত্রে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে ¯œাতোকত্তর ডিগ্রী অর্জন করেছেন। শারীরিক প্রতিবন্ধীতার কারণে পরিবারের সবাই তাকে বোঝা মনে করবে বলে শারীরিক প্রতিবন্ধীতা নিয়েও নিজের খরচ নিজেই চালিয়েছেন। তারপর হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় ডিপ্লোমা করেছেন। কিন্তু একটি চাকুরি তার মেলেনি।  কেউ কথা দিয়ে কথা রাখেন নি। কেউবা অপমান করেছেন। এসব অপমান সহ্য করে এখন নিজ এলাকাতেই একটি হোমিওপ্যাথির চেম্বার খুলেছেন। চেম্বারের আয় দিয়েই কোনোমতে সংসার চলে তার। প্রতিবেদকের সাথে টেলিফোন আলাপে স্ত্রী ও এক সন্তান নিয়ে জীবন সংগ্রামে ক্লান্ত শাহ মাখদুমের অভিমান কান্নায় পরিণত হয়। শাহ মাখদুম কান্নাভেজা গলায় বলেন, আমি তো কারো দয়া চাইনি। ছোটবেলা থেকে পরিবারের কাছেও বিশেষ কিছু চাইনি। লেখাপড়া করার জন্য নিজেই নিজের খরচ যুগিয়েছি। জীবনে  কোনো পরীক্ষায় দ্বিতীয় হইনি। কেবলমাত্র একটি ভালো চাকুরি পাবো বলে অনেক কষ্ট করে পড়ালেখা করে গেছি। কিন্তু না, চাকুরি আমার জোটেনি। এই সমাজে যারা প্রতিষ্ঠিত, চাকুরি দিতে পারেন, তাঁরা অনেকেই কথা দিয়েছেন। কিন্তু পরে তারাই উপেক্ষা করেছেন। 
কবি ও গবেষক আঁখি সিদ্দিকা বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অন্তর্ভূক্তির জন্য সবার আগে দরকার তার শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করা। এ ক্ষেত্রে আইন ও অর্গানাইজেশনের নীতিমালা প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের যথাযথ সক্ষম করে গড়ে তুলতে হবে। 
এড়–লিয়া তৃণমূল প্রতিবন্ধী উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি মোছাঃ সালমা খাতুন বলেন, “প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শারিরীক সামর্থ্য অনুযায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। তাদের উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। 
আমি মনে করি, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের যার যার শারীরিক সামর্থ্য অনুযায়ী কর্মমুখী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের পাশাপাশি তাদের নিজ এলাকায় কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা উচিত। যাতে তারা পরিবারের সাথে থেকেই উপার্জন করতে পারেন।” তিনি বলেন, যেসব প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কাজ করার সামর্থ্য আছে তাদের ভাতা দিয়ে কোন সমস্যার সমাধান হবে না। তাদের জন্য দরকার কর্মসংস্থান। আর যারা চরম প্রতিবন্ধীতার শিকার তাদের জন্য ভাতার পরিমাণ বাড়াতে হবে। তবেই সমাজে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অবস্থার স্থায়ী পরিবর্তন হবে।” তিনি প্রতিবন্ধীতার ধরন অনুযায়ী কাজ দেয়ার পাশাপাশি প্রতিটি অফিস, পাবলিক টয়লেট, চলাচলের উপযোগী রাস্তাঘাট বানানোর জন্য সুপারিশ করেন। 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: