ঢাকা | রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

হজ মানবাধিকারের স্মারক

MASUM | প্রকাশিত: ১২ আগস্ট ২০১৭ ২০:৫৯

MASUM
প্রকাশিত: ১২ আগস্ট ২০১৭ ২০:৫৯

হজ এক প্রেমময় ইবাদতের নাম। বিশ্ব মুসলিমের এক মহাসমাবেশ, যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের, বিভিন্ন বর্ণের, ভাষা ও আকার-আকৃতির মানুষ একই ধরনের পোশাকে সজ্জিত হয়ে একই কেন্দ্রবিন্দুতে সমবেত হন।

মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশে বায়তুল্লাহকে পুনর্নির্মাণ করেন। তিনি তাঁর শ্রম সার্থক করার জন্য যখন মহান আল্লাহ তাআলার দরবারে দোয়া করেন, আল্লাহ তাআলা ইবরাহিম (আ.)-এর দোয়া কবুল করেন। দোয়া কবুলের পর তিনি এ মর্মে নির্দেশ দেন—‘হে (ইবরাহিম! তুমি) মানুষের মাঝে হজের ঘোষণা দাও। তারা দূর-দূরান্তের আনাচকানাচ থেকে তোমার কাছে আসবে হেঁটে। আসবে সর্বপ্রকার ক্ষীণকায় উষ্ট্রগুলোর পিঠে সওয়ার হয়ে। ’ (সুরা : হজ, আয়াত : ২৭) সেই থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের লাখো মানুষ একত্র হয় বায়তুল্লাহর পানে। ইতিহাসে হজই পৃথিবীর একমাত্র বড় মানব সমাবেশ। মানবেতিহাসে হজের মতো এত বড় জনসমাগমের নজির নেই কোথাও। যুক্তরাষ্ট্রের প্রগ্রেসিভ পলিসি ইনস্টিটিউটের ‘ট্রেড ফ্যাক্ট অব দ্য উইক’ প্রকাশনায় ২০০৯ সালেই বিশ্বের সবচেয়ে বড় একক অনুষ্ঠানের স্বীকৃতি দেওয়া হয় হজকে।
৩০ লক্ষাধিক মানুষের ‘লাব্বাইকের’ এই মিছিলে বাংলাদেশিদের অংশগ্রহণও কম নয়। সরকারি ও বেসরকরি ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ থেকে এ বছর হজ করবেন এক লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন হাজি। (দৈনিক কালের কণ্ঠ : ০৬-০৬-২০১৭)

হজেই চিরন্তন মানবাধিকারের ঘোষণা করেছিলেন বিশ্বমানবতার পরম বন্ধু মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। দেড় হাজার বছর আগে মরুভূমির প্রান্তে দাঁড়িয়ে কোরআন হাতে নিয়ে তিনিই ঘোষণা করেছিলেন সর্বজনীন মানবাধিকারের। নারী নির্যাতনের অপ্রতিরোধ্য সাইক্লোন থামানোর পাশাপাশি শিশু ও শ্রমিকের অধিকারের ব্যাপারেও তিনি ছিলেন আপসহীন। উঁচু-নিচু, ধনী-গরিব, আমির-ফকির—সবার সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে তার বাস্তব চর্চা শিক্ষা দিয়েছেন।

বড়লোক হলেই নামাজের সামনের কাতারে দাঁড়ানোর সুযোগ নেই। আবার গরিব হওয়ার কারণে নামাজে পেছনের কাতারে দাঁড়াতে হবে—এমন নিয়মও নেই। একজন ফকির আর আমির উভয়ই নামাজের কাতারে দাঁড়ানোর ব্যাপারে সমান অধিকার ভোগ করেন। ফকিরও যদি আগে আসেন, তাহলে তিনিই সামনের কাতারে দাঁড়াবেন। পক্ষান্তরে শাসকও দেরিতে এলে শাসক বলেই সামনের কাতারে দাঁড়ানোর বিধান নেই ইসলামে। তাঁকে পেছনের কাতারেই দাঁড়াতে হবে।

ইসলামের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ ও মানবেতিহাসের সবচেয়ে বড় সমাবেশ হজেও মানবাধিকারের চর্চা হয় বাস্তবভাবে। আদিকাল থেকেই শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গের দ্বন্দ্ব চলে এসেছে। শুধু কালো হওয়াকেই অপরাধ হিসেবে দেখার নজির পৃথিবীতে নতুন নয়। যাঁরা মানবাধিকারের জন্য চিৎকার করে পৃথিবী কাঁপিয়ে দিচ্ছেন, তাঁদের দেশেও শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গের দ্বন্দ্ব মেটেনি আজও। খোদ মার্কিন মুলুকে বারাক ওবামার ২০০৮ সালের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পাঁচ বছর আগেও শুধু কালো হওয়ার অপরাধে কৃষ্ণাঙ্গদের হত্যা করা হতো। মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গদের ভালো স্কুলে ভর্তি হওয়া, পাবলিক গাড়িতে ওঠা, এমনকি ভালো রেস্টুরেন্টে প্রবেশেরও সামাজিক অধিকার ছিল না। আমেরিকার ইতিহাসে ১৯৬৩ সালের ১৮ আগস্ট মার্টিন লুথার কিং ওয়াশিংটন ডিসিতে এক সমাবেশে প্রথমবারের মতো ঘোষণা করেন যে কৃষ্ণাঙ্গরাও মানুষ, তাদেরও সব সামাজিক অধিকার আছে। কিন্তু মার্টিন লুথার কিংবা নেলসন ম্যান্ডেলারও প্রায় দেড় হাজার বছর আগেই প্রিয় নবী (সা.) ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে বর্ণবাদী বৈষম্য সমূলে উৎপাটন করে দিয়েছিলেন। এক লাখ ২৪ হাজার সাহাবির সামনে সেদিন তিনি ঘোষণা করেছিলেন সর্বজনীন মানবাধিকারের সনদ। হজরত আবদুর রহমান (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, মানবাধিকারের শাশ্বত ঘোষণা হিসেবে ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত ঐতিহাসিক সে ভাষণের চুম্বক অংশ ছিল, ‘আজ থেকে বংশগত কৌলীন্য বিলুপ্ত হলো। কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। যে ব্যক্তি স্বীয় কাজের দ্বারা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করবে, তারাই আল্লাহর কাছে বেশি মর্যাদাবান। (মুসলিম : ১/৩৯৪) তাঁর দুনিয়া কাঁপানো ঘোষণার ফলে সেই বর্বর যুগেও আরবের তপ্ত বালুকারাশিতে প্রস্ফুটিত প্রকৃত মানবাধিকারের স্বর্গোদ্যান।

যেখানে ইসলাম অনুপস্থিত, সেখানে আজও বর্ণবৈষম্য তীব্র। সভ্যতার দাবিদার ব্রিটেনে কৃষ্ণাঙ্গরা এখনো তীব্র বর্ণবাদী বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। দেশটির ‘সমতা ও মানবাধিকার কমিশনের’ তথ্যমতে চাকরি, আবাসন, মজুরি ও অপরাধের বিচারের মতো কয়েকটি খাতে কৃষ্ণাঙ্গরা তীব্রভাবে বঞ্চিত। শ্বেতাঙ্গের চেয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের খুন হওয়ার ঝুঁকি তিন গুণ বেশি। সমান প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনের পরও কর্মক্ষেত্রে একজন কৃষ্ণাঙ্গের আয় শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তির চেয়ে ২৩.১ শতাংশ কম। (দৈনিক কালের কণ্ঠ : ১৯-০৮-২০১৬) অথচ সেই দেড় হাজার বছর ধরে মুসলমানরা শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গের মধ্যে সমতার বাস্তব দৃশ্য ফুটিয়ে তুলছে হজের মাধ্যমে। হজের ড্রেসকোড প্রতিবছর আমাদের বিশ্বনবীর সেই ঘোষণার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। হজ ও উমরাহ্ শাসক-শাসিত আর শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ—সবাই আভিজাত্যকে ভুলে গিয়ে নিজেদের ইহরামের অভিন্ন সাদা পোশাকে জড়িয়ে একাকার হয়ে যায়। প্রেসিডেন্টের পোশাকেরও আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। যে দেশের নাগরিকই হোক না কেন, একই বাক্য উচ্চরণ করতে হয়। এমনটি নয় যে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ব্রিটেনের নাগরিকরা তালবিয়া পড়বে একভাবে, আর অন্য দেশিদের জন্য ভিন্ন বাক্যের তালবিয়া। সাদা-কালোর পোশাক আর মুখের ভাষার অভিন্নতা—এভাবেই হজ আজও মানবাধিকারের স্মারক হয়ে আছে।

লেখক : খতিব, বাইতুশ শফিক মসজিদ

বোর্ড বাজার (আ. গনি রোড), গাজীপুর।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: