
দক্ষিণ কোরিয়ায় এ বছর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাড স্থাপন করে যুক্তরাষ্ট্র। ফাইল ছবি: রয়টার্স
যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর কোরিয়ার টানাপোড়েনের সম্পর্কে এখন টান টান উত্তেজনা। দুই দেশই হুমকি-ধমকিতে এক অপরকে ধুয়ে ফেলছে। পিয়ংইয়ং বলেছে, এ মাসের মাঝামাঝি তারা প্রশান্ত মহাসাগরে মার্কিন গুয়াম ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতে প্রস্তুত। পাল্টা জবাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, তারা যদি সমঝে না চলে, তাহলে কিছু জাতি যে শিক্ষাটা পেয়েছে, তারাও একই সমস্যায় পড়বে।
এখন দেখার বিষয়, পিয়ংইয়ংকে মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের কী অস্ত্র আছে, সেগুলো কতটাইবা ক্ষমতাসম্পন্ন। ওই অঞ্চলে উত্তর কোরিয়াকে কুপোকাত করার মতো কী ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের।
প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিজেদের রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে তিন ধাপে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। এর মধ্যে রয়েছে কোরীয় উপদ্বীপে স্থলভিত্তিক ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন, প্রশান্ত মহাসাগরে ক্ষেপণাস্ত্রবিরোধী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত মার্কিন নৌজাহাজ মোতায়েন আর আলাস্কা ও ক্যালিফোর্নিয়াতে দুটি সামরিক ঘাঁটি তো আছেই। যেখানে শত্রুপক্ষের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রকে আকাশেই ধ্বংস করে দিতে ভূমি থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য ৩৬টি প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে।
ভূমি থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা
উত্তর কোরিয়ার ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রকে আকাশে থাকতেই ধ্বংস করে দিতে (ইন্টারসেপ্ট) রয়েছে ভূমি থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। এর মধ্যে রয়েছে উপমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (আইসিবিএম)। এটি ন্যূনতম ৩ হাজার ৪০০ মাইল পর্যন্ত যেতে পারে।
থাড ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা
ভূমি থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা থেকে কিছুটা আলাদা ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ‘টার্মিনাল হাই অলটিচুড এরিয়া ডিফেন্স বা থাড’-ব্যবস্থা। এই ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা স্বল্প, মাঝারি ও মধ্যবর্তী পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে সক্ষম। এর মাধ্যমে রাডারে বহুদূরের অঞ্চলেও নজরদারি করা যায়। দক্ষিণ কোরিয়ায় সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র টিএইচএএডি স্থাপন করেছে।
গুয়ামের অ্যান্ডারসন এয়ার ফোর্স ঘাঁটিতে মার্কিন সামরিক বিমান। ছবি: রয়টার্স
ইজেস ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা
ইজেস ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা হলো মিসাইল ডিফেন্স এজেন্সির প্রতিরক্ষাব্যবস্থার নৌবাহিনীর অংশ। এই প্রতিরক্ষা জাহাজগুলোয় উপমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পতন ঘটানোর প্রযুক্তি না থাকলেও এটি একে শনাক্ত করতে এবং আলাস্কা ও ক্যালিফোর্নিয়ায় দুটি সামরিক ঘাঁটিতে এ-সংক্রান্ত (ফায়ার নিয়ন্ত্রণ) তথ্য পাঠাতে সক্ষম।
উৎক্ষেপণের কিছু সময়ের মধ্যে আইসিবিএমকে শনাক্ত করতে সক্ষম নৌবাহিনীর দ্রুতগামী এই যুদ্ধজাহাজগুলো।
মার্কিন সৈন্যবাহিনী, বিমান ও রণতরি
দক্ষিণ কোরিয়ায় স্থায়ীভাবে ২৮ হাজার ৫০০ মার্কিন সেনা রয়েছে। জাপানে রয়েছে ৫৪ হাজার। এ ছাড়া উত্তর কোরিয়া থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রকে ধ্বংস করে দিতে জাপানে মার্কিন নৌবাহিনী দ্রুতগামী যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছে। আছে জাপানের ইয়োকোসুকা বন্দরে মার্কিন বিমানবাহী রণতরি ইউএসএস রোনাল্ড রিগান।
বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা
পুরোপুরি সফলতা পাওয়া যাবে—এমন নিশ্চয়তা কোনো বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থাই দেয় না। পেন্টাগন ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা নির্মাণকারীরা বারবারই আশ্বাস দিয়েছে, উত্তর কোরিয়ার যেকোনো হামলা ঠেকাতে বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা বেশি কার্যকর। কিন্তু গত কয়েক দশকে যখনই এই ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষার মহড়া চালানো হয়েছে, এর কার্যকারিতার তেমন প্রতিফলন দেখা যায়নি।
প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধে ইরাকের ছোড়া স্কাড ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে ইসরায়েল ও সৌদি আরবকে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা দিয়ে সহযোগিতা করে যুক্তরাষ্ট্র। প্রথমে বলা হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কাজে লাগিয়ে ইরাকের ৪১-৪২টি ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করা গেছে। পরে অবশ্য জানা যায়, মাত্র কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্রকেই কাবু করা গিয়েছিল।
সম্প্রতি এক হিসাবে দেখা গেছে, এ ক্ষেত্রে সফলতার হার গড়ে অর্ধেক।
যুক্তরাষ্ট্রের সক্ষমতা নিয়ে শঙ্কা
গুয়ামে উত্তর কোরিয়ার হামলার হুমকির পর সেখানকার হোমল্যান্ড সিকিউরিটির উপদেষ্টা জর্জ চারফোরাস সিএনএনকে বলেছিলেন, নিজেদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থার ওপর তাঁদের আস্থা আছে। বলেন, ‘উত্তর কোরিয়া ধীরে ধীরে তাদের সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। কিন্তু আমরা শুধু গুয়াম ও এর চারপাশ নয়, বরং পুরো মার্কিন সাম্রাজ্য রক্ষায় আমাদের সামর্থ্য নিয়ে আত্মবিশ্বাসী। আমাদের কয়েক ধাপে উপমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা রয়েছে।’
কিন্তু র্যান্ড করপোরেশনের একজন জ্যেষ্ঠ প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ব্রুস বেনেট সিএনএনকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাবে কি না, এটি শেষমেশ ট্রাম্পের মর্জির ওপর নির্ভর করবে। তিনি বলেন, ‘এটি একটি পরীক্ষামূলক ব্যবস্থা...আমরা সফলও হতে পারি কিংবা ব্যর্থও হতে পারি। আমরা নিশ্চিত নই। সেলফোন বানানোর সময় যতটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়, এই ক্ষেত্রে তার কিছুই হয়নি। তারপরও দেখা যায়, সেলফোনে আগুন ধরে যায়।’
ব্রুস বেনেট বলেন, গুয়ামের জন্য দুই ধাপে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা রাখতে দ্বীপটির খুব কাছাকাছি ইজেস পদ্ধতি রাখা উচিত। তবে তা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ওপর নির্ভরশীল।
হাওয়াই প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও ইউএস প্যাসেফিক কমান্ডের জয়েন্ট ইনটেলিজেন্স সেন্টারের সাবেক অপারেশন পরিচালক কার্ল সুস্টার বলেন, ইজেস ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থাসমৃদ্ধ একটি জাহাজ সম্ভবত দুটি ক্ষেপণাস্ত্রকে ধ্বংস করতে পারবে।
উত্তর কোরিয়ার কয়েক দফা ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার চালানোর পরিপ্রেক্ষিতে গত মে মাসে মার্কিন সেনারা ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা পরীক্ষা চালায়। এরপর জুলাইয়ে কয়েক দফা। পরে অবশ্য জানা যায়, একটি ব্যর্থ হয়েছিল।
সেন্টার ফর আমেরিকান প্রোগ্রেসের জ্যেষ্ঠ ফেলো অ্যাডাম মাউন্ট বলেন, ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা যদি কোনো উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়, তা হবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য লজ্জার। আর কিম জং-উন নিশ্চয়ই এমনটা চাইবেন।
জাপানের জলসীমায় যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস রোনাল্ড রিগান। ছবি: রয়টার্স
মাউন্ট বলেন, গুয়ামে পিয়ংইয়ংয়ের বারবার হামলার হুমকির বিষয়টি সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা যাচাই করে দেখার একটি কৌশল। সত্যি তাদের সেই ক্ষমতা আছে, নাকি ফাঁকা বুলি, তাই দেখতে চাইছে পিয়ংইয়ং। যদি উত্তর কোরিয়া একটি ক্ষেপণাস্ত্রও সফলভাবে মার্কিন ঘাঁটিতে আঘাত হানতে পারে, তবে তা দুর্বৃত্ত রাষ্ট্রটির জন্য বড় বিজয় হবে। আর যুক্তরাষ্ট্র যদি প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়, তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হবে লজ্জার। এমনকি এর মধ্য দিয়ে মার্কিনদের সক্ষমতার সীমাবদ্ধতার ও প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় যে ঘাটতি আছে, সেই বার্তাও দেবে।
বেনেট বলেন, পিয়ংইয়ং এমনটাই চাইবে। আর যদি যুক্তরাষ্ট্র ব্যর্থ হয়, তবে তা বড় বিপর্যয় ডেকে আনবে। তাই তিনি ক্ষেপণাস্ত্রবিধ্বংসী প্রয়োজনীয় প্রাযুক্তিক সক্ষমতার অভাব থাকলে যুদ্ধের চেয়ে বরং শান্তির পথ খুঁজে নেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উত্তম বলে মনে করেন।
গার্ডিয়ান, এবিসি নিউজ ও সিএনএন অবলম্বনে লিপি রানী সাহা
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: