ঢাকা | বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

প্রতিবন্ধী শিশু সমাজের বোঝা না সম্পদ?

Mahbubur Rohman Polash | প্রকাশিত: ২ নভেম্বর ২০১৭ ১০:০৭

Mahbubur Rohman Polash
প্রকাশিত: ২ নভেম্বর ২০১৭ ১০:০৭

অধিকারপত্র 

১৯৯২ সালে বাংলাদেশের দু’টি শহর ও তিনটি গ্রামের ২ থেকে ৯ বছর বয়সি ১০ হাজারের বেশি শিশুর উপর এক জরিপে শতকরা ১.৬ ভাগ শিশুর মারাত্মক প্রতিবন্ধিত্বের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। যেখানে বুদ্ধিবৃত্তিক এবং শ্রবণসমস্যাজনিত শিশুসহ সঞ্চালক পেশির প্রতিবন্ধিত্ব, দৃষ্টি প্রতিবন্ধিত্ব এবং মৃগীরোগাক্রান্ত শিশুহার ব্যাপকভাবে চিহ্নিত হয়। গ্রামের ছেলে শিশুদের চেয়ে শহরের মেয়েদের মধ্যে প্রতিবন্ধিত্বের মাত্রা অনেক বেশি। মৃদু মাঝারি ও মারাত্মক প্রতিবন্ধী শিশুর আনুপাতিক হার শতকরা ৬.৯ ভাগ। বর্তমানেও এই হার থেকে বাংলাদেশ বের হয়ে আসতে পারেনি।

১৯৯৬-৯৭ সালের মাল্টিপল ইন্ডিকেট কাস্টার সার্ভে (এমআইসিএস) থেকে শিশুর প্রতিবন্ধিত্বের ব্যাপ্তি সম্পর্কে সাম্প্রতিক তথ্য দেখা যায়, ৫ বছরের নিচে শতকরা ৩ ভাগ শিশু এবং ১০ বছরের নিচে শতকরা ৫ ভাগ শিশু প্রতিবন্ধিত্বের শিকার। উভয় শ্রেণীর মধ্যে অভিন্ন প্রতিবন্ধিত্ব দৃষ্টি এবং ও শ্রবণসংক্রান্ত। বর্তমানে আক্রান্তের সেই সংখ্যার খুব বেশি উন্নতি লক্ষণীয় নয়।

প্রতিবন্ধিত্বের মূল কারণ সংক্রমণ, অপুষ্টি ও গর্ভকালীন পরিচর্যার অভাব থেকে সৃষ্ট জটিলতা প্রতিরোধযোগ্য। শিশু প্রতিবন্ধিত্বের অন্যতম কারণ মাতৃত্ব সম্পর্কিত শিক্ষার স্বল্পতা ও দারিদ্র্য। শিশুর শ্রবণজনিত প্রতিবন্ধত্বের কারণ পরিবেশ দূষণ।

জন্ম-পরবর্তী রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থায় প্রধানত পোলিওর টিকাদান এবং ভিটামিন ‘এ’ ও আয়োডিন ঘাটতি পূরণের উপর জোর দেয়া হলেও অশিক্ষা এবং অসচেতনতার অভাবে তা পুরোপুরি কার্যকর হচ্ছে না। প্রতিবন্ধিত্বের কার্যকরী নিয়ন্ত্রণ ও নিয়ামক ব্যবস্থাপনায় প্রতিরোধ ও আগাম নিরূপণ জরুরি হলেও বাংলাদেশের স্বাস্থ্য পরিচর্যায় সম্পদ সীমিত হবার কারণে প্রতিবন্ধী শিশুর ক্ষেত্রে যথাযথ চিকিৎসা প্রদান সম্ভব হচ্ছে না।

বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী শিশুদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানভিত্তিক হলেও কোনো কোনো বেসরকারি সংস্থার সেবা প্রদানে সমাজভিত্তিক উদ্যোগ লক্ষ্যণীয়। ‘বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন’ ১৯৮৭ সালে বাড়িতেই শিশুর প্রতিবন্ধিত্ব নিরোধের ব্যবস্থাপনার উপায় সম্পর্কে মা-বাবাকে শিক্ষাদানের জন্য সচিত্র প্রশিক্ষণ সহায়িকা ব্যবহারের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ প্যাকেজে কর্মসূচি চালু করে। যেখানে সঞ্চালক পেশির বিকাশ, বাচনভঙ্গি, ভাষা উন্নয়ন, বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ও দৈনন্দিন জীবনযাপনের উন্নয়ন বিষয়ক সহায়িকা প্রদান করা হয়।

শিশু বিশেষজ্ঞ, মনস্তত্ত্ববিদ, সাইকোথেরাপিস্ট, স্পিচ থেরাপিস্ট ও বিশেষ শিক্ষাবিদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বিশেষজ্ঞ দল সারাদেশ থেকে ঢাকা বা ঢাকার কাছে গ্রামীণ কেন্দ্রে আগত মা-বাবা তাদের সন্তানদের চিকিৎসাসেবা নেবার সুবিধা প্রদান করা হয়। এই প্যাকেজে বাড়িতে শিশুদের প্রশিণদানের পদ্ধতি সন্নিবেষ্টিত হয়।

শিশু অধিকার সনদের ২৩ ধারা অনুযায়ী প্রতিবন্ধী শিশুদের পরিপূর্ণ জীবনযাপন এবং তাদের মর্যাদা রক্ষা আত্মনির্ভরশীলতা ও সমাজে সক্রিয় অংশগ্রহণে উৎসাহিত করার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। এই ধারায় প্রতিবন্ধী শিশুদের বিশেষ তত্ত্বাবধানের অধিকারের বিষয়টিও স্বীকার করা হয়েছে। অনুমোদনকারী রাষ্ট্রসমূহকে তাদের সম্পদ অনুযায়ী প্রতিবন্ধী শিশু ও তাদের মা-বাবাকে চিকিৎসা সেবা, পুনর্বাসন সেবা, বিশেষ শিক্ষা, চাকরির প্রশিক্ষণ, বিনোদন ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগসহ প্রয়োজনীয় সহায়তাদানের বিষয়টি অত্যাবশ্যক করা হয়েছে। যার মাধ্যমে সমাজের সঙ্গে প্রতিবন্ধী শিশুর যথাসম্ভব পরিপূর্ণভাবে অঙ্গীভূত হবার ও ব্যক্তিগত বিকাশের সুযোগ সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে।

১৯৯২ সাল থেকে ঢাকা শিশু হাসপাতালের শিশু বিকাশ কেন্দ্র আগারগাঁও বস্তিতে বসবাসরত সমাজভিত্তিক প্রতিবন্ধী শিশুদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। শুরুতে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বস্তির এক হাজার পরিবারের জরিপে প্রতিবন্ধী সেবার সম্ভাব্য প্রয়োজন সংবলিত প্রয়োজনীয় বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। সকল শিশুকে কেন্দ্র ও তাদের বাড়িভিত্তিক পরীক্ষা, চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য কেন্দ্রে আসার সুযোগ করে দেয়া হয়। পরিবার ও জনগোষ্ঠীর সামাজিক উন্নয়ন এবং পাশাপাশি মা ও তার অন্যান্য সন্তানের সাধারণ স্বাস্থ্যসেবা এই প্রকল্পে সমন্বিত করা হয়।

প্রতিবন্ধী সমস্যা শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপী এর বিস্তার উদ্বেগজনক। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার শতকরা ২৫ ভাগই প্রতিবন্ধিত্বের শিকার। উন্নয়নশীল দেশের শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ প্রতিবন্ধী গ্রামাঞ্চলে বসবাস করে। পরিবারের স্বাভাবিক সদস্য ও রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের মতো তাদের জীবনযাপনেও সমান অধিকারের বিষয়টি স্বীকৃত। সমাজের সকল অংশের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য প্রতিবন্ধীদের আর্থিক ও সামাজিকভাবে পুনর্বাসন প্রয়োজন। প্রয়োজন সমাজের মানুসিকার পরিবর্তন।

বিশেষভাবে শিশু প্রতিবন্ধীদের সঠিকভাবে গড়ে তোলার জন্য উপযুক্ত পরিচর্যা, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে তাদের সকল সুস্থ নাগরিকের সহনাভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি রাখা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

ভাবতে হবে, প্রতিবন্ধী শিশু সংসারের বোঝা নয়। বরং তারাও সুযোগ পেলে আর দশজন সুস্থ মানুষের মতো সমাজের সার্বিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে সফলতার পরিচয় দিতে সক্ষম



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: