
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সংরক্ষিত ১% কোটা বাস্তবায়ন একটি সাংবিধানিক ও নৈতিক বাধ্যবাধকতা।
জুলাই সনদ’-এর আলোকে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠনের অঙ্গীকারের অংশ হিসেবে সরকারি চাকরিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সংরক্ষিত কোটার বাস্তবায়নকে কার্যকরভাবে অন্তর্ভুক্ত করা অত্যন্ত জরুরি।
প্রায় এক দশক আগে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ১% কোটা সংরক্ষিত হলেও বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বিসিএস ও বিচার বিভাগীয় নিয়োগে এই কোটার কার্যকর বাস্তবায়ন দেখা যায়নি।
২০২৪ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট সরকারি চাকরিতে কোটার বৈধতা পুনর্বিবেচনা করে একটি ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন, যেখানে প্রতিবন্ধী নাগরিকদের জন্য ১% সংরক্ষিত কোটা বজায় রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। এই রায়ের পরও যদি এই কোটায় প্রার্থীদের নিয়োগ না দেওয়া হয়, তা হবে আদালত অবমাননার শামিল। কাই এ বিষয়ে আশু ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন । বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (PSC) অতীতে বিশেষ কোটার প্রার্থীদের জন্য আলাদা বিসিএস পরীক্ষার (যেমন: ২৩তম বিসিএস) আয়োজন করেছে—সেই নজির অনুসরণ করে প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের জন্যও একটি “বিশেষ বিসিএস” আয়োজন সময়ের দাবি। সাম্প্রতিক বিসিএস নিয়োগগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে—১% কোটা অনুসারে যে সংখ্যক পদ বরাদ্দ হওয়ার কথা, তা পূরণ হয়নি। তাই আমরা দাবি করছি, শুধু প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের জন্য একটি পৃথক বিসিএস পরীক্ষার আয়োজন করে রাষ্ট্র তার সাংবিধানিক ও মানবাধিকার ভিত্তিক দায়বদ্ধতা প্রমাণ করুক।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শিক্ষায় সুযোগ সীমিত হলেও বাস্তবতা হলো, শত প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে প্রতিবছর অনেক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাস করছে। কিন্তু চাকরির অসম প্রতিযোগিতা, বৈষম্যমূলক মনোভাব ও সুযোগের অভাবে তারা পেশাগত জীবনে প্রবেশ করতে পারছে না। এটি শুধু ব্যক্তির নয়, রাষ্ট্রের সম্ভাবনাকেও ব্যাহত করছে।
সংবিধানের ২৮, ২৯ ও ৪০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য রাষ্ট্র কিছু অতিরিক্ত সুযোগ দিতে পারে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত করা এসব মৌলিক অধিকারের সরাসরি লঙ্ঘন। পাশাপাশি, বাংলাদেশ-জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার রক্ষা করার আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতিও রাষ্ট্র ভঙ্গ করছে। একইসাথে বাংলাদেশ কর্তৃক ২০০৭ সালে স্বাক্ষর করা এবং ২০০৯ সালে অনুসর্থন করা ‘জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সনগ (UNCRPD)’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের বিধানও লংঘিত হচ্ছে।
সাম্প্রতিক একাধিক সরকারি নিয়োগে এই বৈষম্যের নজির স্পষ্ট। যেমন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সর্বশেষ নিয়োগ পরীক্ষায় শতাধিক প্রতিবন্ধী
লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও নিয়োগ পাননি, যদিও তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী ছিলেন। নির্ধারিত কোটার অনুপাতে এক শতাংশও পূরণ হয়নি।
আমরা প্রত্যাশা করি, এ ধরনের বৈষম্যের পুনরাবৃত্তি রোধে রাজনৈতিক দল, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দৃশ্যমান ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। রাষ্ট্র যেন এ বিষয়ে স্পষ্ট অবস্থান নিয়ে, বিশেষ বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার নিশ্চিত করে, তা সময়োপযোগী এবং ন্যায্যতার পক্ষে একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ হবে। আগামীর বাংলাদেশ হোক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সুন্দর বৈষম্যহীন এবং সমমর্যাদার ॥
অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান, বিশেষ শিক্ষা বিভাগ, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: