ঢাকা | শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২

দলগুলোর ভেতরে অর্থ ও পেশিশক্তি প্রবেশ করছে-রেহমান সোবহান

Mahbubur Rohman Polash | প্রকাশিত: ২০ ডিসেম্বর ২০১৭ ১৪:৫১

Mahbubur Rohman Polash
প্রকাশিত: ২০ ডিসেম্বর ২০১৭ ১৪:৫১

 

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের  উপদেষ্টা অধ্যাপক ​রেহমান সোবহান বলেছেন, রাজনীতি এখন ব্যবসার সম্প্রসারিত অংশ হয়ে গেছে। আর টাকা হলো নির্বাচনে জেতার পথ। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা রাজনৈতিক দলগুলোর সাংগঠনিক শৃঙ্খলাকে ক্ষয় করছে। নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব দেখা যাচ্ছে না। দলগুলোর ভেতরে অর্থ ও পেশিশক্তি প্রবেশ করছে। এর ফলে রাজনীতি ধনীদের খেলায় পরিণত হয়েছে।

গতকাল মঙ্গলবার এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ আয়োজিত নূরজাহান মুরশিদ ও অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ ট্রাস্ট ফান্ড বক্তৃতা দেন বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান। রাজধানীর এশিয়াটিক সোসাইটি মিলনায়তনে এই অনুষ্ঠান হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন ফান্ডের চেয়ারপারসন হারুন উর রশিদ।

রেহমান সোবহান বলেন, অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন ও দুর্বল শাসনব্যবস্থা ব্যক্তি পর্যায়ে অপরাধ সংঘটনের প্রবণতা তৈরি করছে। মতিঝিলের খেলাপিরা (ঋণখেলাপি) রাজনৈতিক নেতার সহযোগিতা পান, যা তাঁদের মাস্তান পুষতে সহায়তা করে। এই মাস্তানেরা তাঁদের নির্বাচনে অংশ নিতে, এমনকি রাষ্ট্রীয় সম্পদ দখলে সহায়তা করে।

 তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরও আমরা এখনো একটা নির্বাচনী ব্যবস্থা খুঁজছি, যা সারা বিশ্বের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। যে নির্বাচন থেকে বিশ্বাসযোগ্য অর্জন হবে। গত চারটি জাতীয় সংসদ থেকে আমাদের দুঃখজনক অভিজ্ঞতা হয়েছে। যেমন সুষ্ঠু, অবাধ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন দরকার, কিন্তু গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা থেকে এখনো অনেক দূরে আছি।’

রেহমান সোবহান আরও বলেন, ১৯৯০ সালে গণ-অভ্যুত্থানে এরশাদের স্বৈরতন্ত্রের পতনের পর মানুষ মনে করেছিল, গণতন্ত্রের পুনর্জন্ম হয়েছে।
সেই পুনঃ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এখন বিতর্কিত হয়ে পড়েছে। ১৯৯১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তুলনামূলক সুষ্ঠু ও অবাধ চারটি নির্বাচনে জনগণের রাজনৈতিক নেতৃত্ব পছন্দ করার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। পরাজিত দলগুলো প্রতিবারই নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। প্রতিটি নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা হয়তো নির্ধারিত হয়েছিল এই কারণে যে প্রতি নির্বাচনেই ক্ষমতাসীনের পরাজিত হয়েছে। এসব নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়েছিল। তিনি আরও বলেন, সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে ক্ষমতাসীনদের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়। প্রতিবাদে ২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কট করে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট রাজপথে সহিংসতা ছড়ায়, যা গ্রহণযোগ্য নয়। অর্ধেকের বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন সাংসদেরা। এতে ভোটাররা তাঁদের পছন্দের প্রার্থী নির্বাচনের সুযোগ হারান।

রেহমান সোবহানের মতে, তিন দশক ধরেই এ ধরনের দুর্বল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিকশিত হচ্ছে, যা প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসনের ন্যূনতম জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার প্রকাশ। তিনি বলেন, রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত সমাজে নির্বাচন কমিশন গঠনও বড় সমস্যা। এই কমিশনের গঠনপ্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

অর্থনীতি সম্পর্কে সোবহান বলেন, একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। বাংলাদেশ এখন হেনরি কিসিঞ্জারের বাস্কেট কেস থেকে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তারপরও উচ্চ বৈষম্য আছে, সমাজে ন্যায্যতা কম। এ ধরনের অন্যায্যতা অর্থনীতিতে বৈষম্য বাড়িয়ে দেয়। তাঁর মতে, সমাজের যেকোনো রূপান্তরমূলক উদ্যোগ নেওয়ার জন্য দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো। তিন দশক ধরে বিশেষ করে একবিংশ শতাব্দীতে এসে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) উচ্চ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। এতে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা দারিদ্র্য কমাচ্ছে। অন্যদিকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে রাজস্ব আদায় বাড়ছে। এতে বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প নেওয়া সম্ভব হচ্ছে। এ ছাড়া মানব উন্নয়নে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতেও বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা সম্ভব হচ্ছে। রেহমান সোবহানের মতে, বাংলাদেশের উন্নয়নের অঙ্গীকার ও সম্ভাবনাকে বাস্তবে পরিণত করতে হলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সমাজকে আরও বেশি অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে হবে।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গণমাধ্যমের মুক্তভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর জোর দেন এই বরেণ্য অর্থনীতিবিদ। তাঁর মতে, দেশে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের বিকাশ হচ্ছে। কিন্তু খুব কম প্রতিষ্ঠানই স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করছে। বেশির ভাগ গণমাধ্যমই ক্ষমতাসীনদের গুণগান করতে পছন্দ করে কিংবা মালিকদের রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়। কিছু ক্ষেত্রে বিরোধীদের কুৎসা রটানোতেও রাষ্ট্রযন্ত্র হিসেবে গণমাধ্যমকে ব্যবহার করা হয়। তিনি আরও বলেন, কয়েক বছর ধরে সামাজিক গণমাধ্যমগুলোর বিকাশ হওয়ায় তা মতপ্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

রেহমান সোবহান তাঁর বক্তৃতায় রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক, শিক্ষাবিদ নূরজাহান বেগম ও অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ আদর্শকে বাস্তবায়নের ওপর জোর দেন।

রেহমান সোবহানের বক্তব্যের ওপর কয়েকজন বিশিষ্টজন বক্তব্য দেন। প্রবীণ আইনবিদ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন বলেন, অর্থ ও ক্ষমতা সমাজে ন্যায়বিচার এনে দিতে পারবে না। কিন্তু এখন এই দুটিই সবকিছু হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘গত ৪৬ বছরে উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে কেউ নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেননি কিংবা হতাশ হননি। এটাই আমাদের বড় অনুপ্রেরণা।’

সিপিডির সাবেক বিশেষ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ রওনক জাহান বলেন, রেহমান সোবহান যে বক্তৃতা দিলেন, তা তরুণ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। এই বক্তৃতা তরুণ প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে।

অনুষ্ঠানের শুরুতে নূরজাহান মুরশিদ ও খান সারওয়ার মুরশিদের কন্যা তাজিন মুরশিদ বক্তব্য দেন। এ ছাড়া উপস্থিত ছিলেন নূরজাহান মুরশিদ ও অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ ট্রাস্ট ফান্ডের আহ্বায়ক সাব্বির আহমেদ।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: