ঢাকা | সোমবার, ৭ জুলাই ২০২৫, ২২ আষাঢ় ১৪৩২

সংস্কারে প্রস্তাবে একমত ও দ্বিমত কোথায় তা জানিয়েছে বিএনপি

odhikarpatra | প্রকাশিত: ৬ জুলাই ২০২৫ ২৩:৪৬

odhikarpatra
প্রকাশিত: ৬ জুলাই ২০২৫ ২৩:৪৬

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে প্রস্তাবিত সংস্কার আলোচনায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি  কতগুলো প্রস্তাবে একমত ও কোথায় দ্বিমত প্রকাশ করেছে, তা জানিয়েছে দলটি।

রাজধানীর গুলশানের চেয়ারপার্সনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের অবস্থান তুলে ধরেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। 

এ সময় সংলাপে দলের প্রতিনিধি সালাহউদ্দিন আহমেদ তার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন। 

সংলাপে আরও উপস্থিত ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান।

বিএনপি’র পক্ষ থেকে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সংস্কার নিয়ে কিছু দল কথা বলছে। সংস্কার বিষয়ে বিএনপি’র আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। তবে রাষ্ট্র পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে সংস্কারের নামে দুর্বল করার প্রস্তাবকে বিএনপি সমর্থন করে না।

সংলাপ নিয়ে প্রত্যাশা ও উৎকণ্ঠা দুটোই বিএনপি’র এমনটা জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রম নিয়ে যেমন অনেক আগ্রহ ও প্রত্যাশা আছে, তেমনি হতাশা ও উৎকণ্ঠাও রয়েছে জনমনে। বিএনপি’র পক্ষ থেকে আমরা যেমন ছয়টি সংস্কার কমিশনের কার্যক্রম সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছি, তেমনি ঐকমত্য কমিশনের প্রতিদিনের আলোচনায় আমাদের প্রতিনিধিরা কার্যকরভাবে অংশ গ্রহণ করে চলেছেন।’

তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছার জন্য আমাদের প্রতিনিধিরা সভায় অংশ গ্রহণকারী অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা এবং অনেক বিষয়ে ছাড় দিয়ে হলেও একমত হয়ে কমিশনের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াসকে সহযোগিতা করেছেন।

কিন্তু দীর্ঘ আলোচনার পর সংস্কার কমিশনগুলো যে সব প্রস্তাব পেশ করেছেন, তার বিপরীত কিংবা নতুন নতুন প্রস্তাব উত্থাপন এবং তা নিয়ে অনেক সময় অচলাবস্থা সৃষ্টির কারণে কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে। ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার আগ্রহী বলেই আমাদের প্রতিনিধিরা ধৈর্য ধরে আলোচনা শুনছেন এবং তথ্য-প্রমাণ ও যুক্তি দিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে কমিশনকে সহযোগিতা করছেন।’

বিএনপি মহাসচিব উল্লেখ করেন, ‘রাষ্ট্র পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করার নামে জনগণের নির্বাচিত সংসদ, নির্বাচিত সরকার তথা রাষ্ট্র কাঠামোকে দুর্বল ও অকার্যকর করার কোনও প্রস্তাবের যুক্তিসঙ্গত বিরোধিতা সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলে আমরা মনে করি।

তিনি বলেন, জনগণের দ্বারা নির্বাচিত জনগণের কাছে দায়বদ্ধ এবং জনগণকে জবাবদিহি করতে বাধ্য কোনও সরকারকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় দুর্বল ও অকার্যকর করা অবশ্যই সংস্কারের মূল আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ‘ফলে এমন কোনও প্রয়াসে সমর্থন জানানো, সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যের পরিপন্থি বলে তা থেকে বিরত থাকার অর্থ সংস্কার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্থ করা নয়; বরং এই প্রক্রিয়াকে সহযোগিতা করা।’

কতগুলো প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছে বিএনপি:

বিএনপি মহাসচিব উল্লেখ করেন, ছয়টি সংস্কার কমিশনের মধ্যে পুলিশ সংস্কার কমিশনের বিষয় এখনও আলোচনায় আসেনি। তবে ওই কমিশনে আমাদের দলের প্রতিনিধিদের কাছে আমরা যতটুকু জেনেছি, তাতে র‌্যাব বিলুপ্তিসহ প্রায় সব বিষয়েই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে।

‘দুদক সংস্কার কমিশনে কতিপয় ছাড় দিয়ে ৪৭টি সুপারিশের ৪৬টিতেই আমরা সম্মতি জানিয়েছি। শুধু ২৯ নম্বর সুপারিশে আইনের মাধ্যমে করার পরিবর্তে আমরা আদালতের অনুমতি নেওয়ার বিদ্যমান বিধান অব্যাহত রাখার কথা বলেছি। আমরা মনে করি, এটা না হলে দুদক-এর কার্যক্রমকে অহেতুক বিলম্বিত করার সুযোগ সৃষ্টি হবে।’

‘জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের ২০৮টি সুপারিশর মধ্যে ১৮৭টি প্রস্তাবে আমরা একমত হয়েছি এবং পাঁচটিতে আংশিক একমত হয়েছি। পাঁচটি সুপারিশে আমরা ভিন্নমত প্রদান করেছি। ১১টি প্রস্তাবে আমরা একমত হতে পারিনি; যেগুলো দেশে প্রদেশ সৃষ্টি, পদোন্নতি ও অন্যান্য প্রশাসনিক অসঙ্গতির বিষয়ে। উল্লেখযোগ্য যে, পদোন্নতির বিষয়ে আপিল বিভাগের রায় কার্যকর রয়েছে।’

মির্জা ফখরুল জানান, বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ৮৯টি সুপারিশের মধ্যে ৬২টি সুপারিশে একমত হয়েছে বিএনপি। ৯টিতে আংশিকভাবে একমত ও ১৮টিতে ভিন্নমত পোষণ করে যুক্তিসহ পরামর্শ দিয়েছে বিএনপি।

তিনি বলেন, ‘উল্লেখযোগ্য যে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিষয়ক সব প্রস্তাবে আমরা একমত হয়েছি। তবে এর কিছু বিষয়ে নির্বাচিত সংসদে আইন প্রণয়ন কিংবা ইতোমধ্যে কোনও অধ্যাদেশ হলে, তা সংসদে রিটিফাই ও সাংবিধানিক সংশোধনীর প্রয়োজন হবে।’

নির্বাচনী সংস্কারের ১৪১টি একমত বিএনপি:

বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘নির্বাচনী ব্যবস্থা বিষয়ক সংস্কার কমিশনের ২৪৩টি সুপারিশের মধ্যে ১৪১টিতে আমরা একমত হয়েছি এবং ১৪টিতে আংশিকভাবে একমত হয়েছি। ৬৪টিতে আমরা ভিন্নমতসহ একমত হয়েছি। অর্থাৎ এসব বিষয়ে পরিবর্তনে একমত হয়ে বিভিন্ন আইনে ও বিধিতে সংশোধনী অধিকতর কার্যকর হবে, তা প্রস্তাব করেছি। ২৪টি বিষয়ে আমরা একমত হতে পারিনি।’

‘উল্লেখযোগ্য যে, নির্বাচনি ব্যবস্থা সংক্রান্ত ১২টি আইন ও ছয়টি নীতিমালা আছে। এ বিষয়ে রাষ্ট্রীয় সংবিধানেও নির্দিষ্ট বিধান আছে। এসব প্রস্তাবের বেশ কয়েকটি বাস্তাবায়নযোগ্য নয় এবং কয়েকটি নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনে স্পষ্টতই বাধা সৃষ্টি করে তাদের সাংবিধানিক স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করবে। আমরা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আনীত সব প্রস্তাবে একমত হয়েছি। আইনি সংস্কারের বিষয়ে আলোচনা অব্যহত আছে।’

সংবিধান সংস্কার কমিশনের ১৩১টি সুপারিশে আমরা দফা ওয়ারি মতামত দিয়েছি। অধিকাংশ সুপারিশে একমত হয়েছি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘৭০’ অনুচ্ছেদ ও প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ। দুই বিষয়েই আমরাই ছাড় দিয়েছি। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নির্দিষ্ট করে দেওয়ার বিধান বিশ্বের কোথাও না থাকার পরেও ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থে আমরা সম্মত হয়েছি। প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়েও আমরা আমাদের প্রস্তাব থেকে সরে এসে একমত হয়েছি।

তিনি বলেন, জাতীয় সংসদে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির পদ বিরোধী দলকে দেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ৪টিসহ আসন সংখ্যার অনুপাতে সভাপতির পদ দিতেও আমরা সম্মত হয়েছি। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সংক্রান্ত আর্টিকেল ৪৯ পরিবর্তনে আমরা সম্মত হওয়ায় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে।

‘এছাড়া তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন, ন্যায়পাল আইন যুগোপযোগী করা, জাতীয় সংসদের নির্বাচনী এলাকার সীমানা বিন্যাসে সংস্কার আনার জন্য সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ সংশোধন  ও আইনের মাধ্যমে বিশেষায়িত কমিটি গঠনেও আমরা একমত হয়েছি। বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সম্মত হয়ে আমরা তা বিচার বিভাগের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বাস্তবায়নে পরামর্শ দিয়েছি। কারণ ইতোপূর্বে ১৯৮৮ সালে এমন উদ্যোগকে উচ্চ আদালত বাতিল করে দিয়েছিল।’

বিএনপি’র মহাসচিব আরো বলেন, ‘এমন বহু সংস্কার প্রস্তাবে শুধুই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থে আমরা একমত হয়েছি, যেগুলি বাস্তবায়ন অত্যন্ত দূরুহ এবং যে উদ্দেশ্যে এসব প্রস্তাব তা অর্জনের সাফল্য প্রশ্ন সাপেক্ষ। রাষ্ট্র পরিচালনার এবং সংসদীয় কার্যক্রম দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা যুক্তিগ্রাহ্য মতামত দিয়ে আমাদের দায়িত্ব পালন করেছি’।

বড় পরিবর্তনের অধিকার ব্যক্তি বা কমিশনের আছে কি-না, এমন প্রশ্ন রেখে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা অব্যাহত আছে। সংস্কার কমিশনগুলোর প্রস্তাবের ওপর আলোচনা করে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার কথা থাকলেও নিত্য নতুন এমন সব প্রস্তাব আসছে, যেগুলো রাজনীতি, রাষ্ট্র ও সংসদ পরিচালনায় বিপুল প্রভাব ফেলবে। এসব প্রভাব ইতিবাচক হলে অবশ্যই তা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। কিন্তু রাষ্ট্রের মালিক জনগণকে সম্পৃক্ত না করে তাদের প্রতিনিধিত্ব কিংবা প্রত্যাশার ক্ষেত্রে বড় কোনও পরিবর্তন করার অধিকার কোনও ব্যক্তি দল কিংবা কমিশনের আছে কিনা, তা বিবেচনায় নিতে হবে।’

তিনি উল্লেখ করেন, ‘এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনও প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা শুরু হয়নি বলে আমরা মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকছি।’

সরকার দুর্বল হলে রাষ্ট্রও অকার্যকর হবে উল্লেখ করে বিএনপি’র মহাসচিব বলেন, ‘দীর্ঘ প্রায় দেড় যুগ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করে বিএনপি শুধু টিকেই থাকেনি, বরং অধিকতর শক্তিশালী ও জনপ্রিয় হয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘শত শহীদের রক্তে, গুম ও খুনের শিকার সহকর্মীদের আত্মত্যাগে আর লাখো নেতা-কর্মীর অবর্ণনীয় দুঃখ-শোকে বিএনপি’র ঐক্য আরও দৃঢ় হয়েছে।’

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এই ঐক্যবদ্ধ শক্তি ও সমর্থ নিয়ে এবং দীর্ঘ দিন রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা নিয়ে বিএনপি দেশে আবারও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় ইতিহাস অর্পিত দায়িত্ব পালনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।’

তিনি বলেন, ‘স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থান রোধে আমরাই সবচেয়ে সক্রিয়। ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানকে অধিক ক্ষমতা দিলে যেমন ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়, ঠিক তেমনি নির্বাচিত সরকার এবং সংসদকে ক্ষমতাহীন করলে রাষ্ট্র দুর্বল, ভঙ্গুর ও অকার্যকর হয়।’

বিএনপি মহাসচিব আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমরা যেন দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে হাজারো শহীদের রক্তে অর্জিত পরিবর্তনের এই সুযোগকে গঠনমূলকভাবে কাজে লাগাই এবং মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ, ৯০’এর ছাত্র গণঅভ্যুত্থান এবং ২০২৪ এর জুলাই-আগস্টের ছাত্র-শ্রমিক-জনতার গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে একটি বৈষম্যহীন, মানবিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ না হই।’

সংবাদ সম্মেলনে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নিয়ে ঐকমত্য কমিশন বিএনপি’কে নিয়ে যে বক্তব্য দিচ্ছে, তা অস্পষ্ট। জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের ধারণার সঙ্গে বিএনপি একমত নয়।

অপর সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, পিআর (প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন) একটি অস্পষ্ট ধারণা। এটি বাস্তবসম্মত নয়, এটি শুধুই আলোচনার খোরাক।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: