
বিশেষ প্রতিবেদন
বাংলাদেশের উন্নয়নের গল্পে উজ্জ্বল সাফল্যের সাথে এক অদৃশ্য অন্ধকারও লুকিয়ে আছে—সেটি হলো আমজনতার অধিকার বঞ্চনা। গতকাল এক বৃদ্ধ রিক্সাওয়ালা আমার পরিচয় পেয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, “স্যার! আমরা কি মানুষ হিসেবে অধিকার কখনো পাব না?”।আমি অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, “কেন? দেশে-তো উন্নয়ন চলছেই।” এবার যেন রিক্সাওয়ালা চাচা অনেকটা চোখ বড় করে বলেন, “কার জন্য উন্নয়ন? আমাদের অধিকার বঞ্চিত রেখে কি হবে এই ক্ষমতা দিয়ে!আমাদের যাদের দরকার, তাদের জন্য কি করছে? আমাদের অবস্থার পরিবর্তন না হলে, এই উন্নয়ন দিয়ে কি হবে?”।
বিষয়টি নতুন করে আমাকে ভাবিয়ে তুলে। আসলেইতো, গ্রাম থেকে শহর, কারখানা থেকে কৃষিক্ষেত্র—শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ পানি ও বিচার পাওয়ার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অসংখ্য মানুষ। আইন আছে, প্রতিশ্রুতি আছে, কিন্তু বাস্তবায়ন কোথায়? সংবিধানের প্রতিশ্রুতি ও নীতি-নির্দেশমূলক আদর্শ সত্ত্বেও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ পানি ও বিচার পাওয়ার অধিকার—এসব ক্ষেত্রেই বৈষম্য ও বঞ্চনার জাল আজও বিস্তৃত। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৫(ক) অনুচ্ছেদে জীবনযাপন ও মৌলিক চাহিদা পূরণের অধিকার এবং ৩২ অনুচ্ছেদে জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হলেও, বাস্তবতা ভিন্ন গল্প বলে। আইনে প্রতিশ্রুতি থাকলেও বাস্তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এর সঠিক বাস্তবায়ন হয় না। স্থানীয় প্রশাসন ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সীমাবদ্ধতা, দুর্নীতি এবং দায়সারা মনোভাব আমজনতার অধিকারকে প্রতিদিন খর্ব করছে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদনে (২০২৪) উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২৩ সালে মোট প্রাপ্ত ১৮,০০০ অভিযোগের মধ্যে ৪২% ছিল স্বাস্থ্য, ভূমি বিরোধ ও পুলিশি হয়রানি সংক্রান্ত—যা সরাসরি মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী।
সেবা বঞ্চনা ও বৈষম্য যেন গ্রামীণ দরিদ্র জনগণের একটি প্রাত্যহিক বিষয়।শহরে যেখানে তুলনামূলক বেশি সেবা পাওয়া যায়, গ্রামে সেই সুবিধা অপ্রতুল বা অনুপস্থিত। দরিদ্র জনগোষ্ঠী প্রায়ই চিকিৎসা, শিক্ষা বা আইনগত সহায়তা থেকে বঞ্চিত হন কেবল অর্থনৈতিক সামর্থ্যের অভাবেই নয়, বরং প্রশাসনিক জটিলতা ও বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। স্বাস্থ্যসেবায় শহরে একদিকে তুলনামূলক আধুনিক সুযোগ-সুবিধা থাকলেও গ্রামীণ অঞ্চলে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রয়োজনীয় ডাক্তার, ওষুধ বা সরঞ্জামের অভাব এখনো নিত্যদিনের ঘটনা। যেমন, কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি উপজেলার এক ইউনিয়নে তিন মাস ধরে ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র তালাবদ্ধ—ফলে স্থানীয়রা ২০-২৫ কিলোমিটার দূরে গিয়ে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হচ্ছেন। শিক্ষাক্ষেত্রেও বৈষম্য স্পষ্ট। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২৩ সালের জরিপ অনুযায়ী, শহরে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের গড় উপস্থিতি হার ৯০% হলেও প্রত্যন্ত গ্রামীণ অঞ্চলে তা ৭৪%। অপরদিকে শ্রমিকদের সাথে বঞ্চনা ও শোষণ যেন থামছেই না।যেমন: গাজীপুরের একটি তৈরি পোশাক কারখানায় কর্মরত ২৮ বছর বয়সী মুনমুন খাতুন জানান, মাসিক বেতন ১২,৫০০ টাকা হলেও অতিরিক্ত কাজের (ওভারটাইম) টাকা তিনি নিয়মিত পান না। বকেয়া মজুরি চাইতে গেলে চাকরি হারানোর ভয় দেখানো হয়। এটি শ্রম আইন ২০০৬-এর (সংশোধিত) সরাসরি লঙ্ঘন।
প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহির অভাব এই অধিকার বঞ্চনাকে আরো প্রকট করে তুলেছে।মানবাধিকার সংস্থা ও নাগরিক প্ল্যাটফর্মগুলোর অভিযোগ, অধিকাংশ সরকারি সেবা খাতেই জবাবদিহি প্রক্রিয়া দুর্বল। অভিযোগ করার পরও অনেক ক্ষেত্রে তদন্ত হয় না বা ফলাফল জনসমক্ষে আসে না। এতে নাগরিকের আস্থা ক্ষুণ্ণ হয় এবং অধিকার বঞ্চনার চক্র আরও দীর্ঘস্থায়ী হয়। অধিকারপত্রের কথা হয় কয়েকজন তৃনমুলের খেটে খাওয়া মানুষের সাথে। এক্ষেত্রে আশুলিয়ার এক গার্মেন্টস শ্রমিক বলেন, “আমার বেতন ১২,৫০০ টাকা। কিন্তু অতিরিক্ত কাজের টাকা মাসের পর মাস বকেয়া থাকে। বকেয়া চাইতে গেলে সুপারভাইজার বলে—‘চাকরি রাখতে চাইলে চুপ থাকো।’ অপরদিকে রবিউল নামক এক প্রান্তিক কৃষক (কুড়িগ্রাম, কৃষক) বলেন, “পানি উন্নয়ন বোর্ড নালার কাজ করেছে, কিন্তু আমার জমির সেচলাইন বন্ধ হয়ে গেছে। অভিযোগ দিয়েও কোনো ফল পাইনি। খরায় ফসল নষ্ট হলো, ক্ষতিপূরণও মেলেনি।” অপরদিকে এক শেরপুরের এক বিধবা নারী জানান, “বিধবা ভাতার জন্য তিনবার আবেদন করেছি। চেয়ারম্যান সাহেব বলেন তালিকা পূর্ণ। পরে শুনি যারা পরিচিত, তারা দ্রুত ভাতা পেয়ে যায়।”
এখন প্রশ্ন এভাবে আর কতদিন? এই মানুষগুলো নিজ অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকবে। রাষ্ট্রের কি কোনো দায়িত্ব নাই।এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের এক অধ্যাপক বলেন, “রাষ্ট্রের উন্নয়ন পরিসংখ্যান যতই উজ্জ্বল হোক না কেন, যদি আমজনতার মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত না হয়, তবে সেই উন্নয়ন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।” তিনি আরও বলেন, অধিকার সুরক্ষায় স্থানীয় পর্যায়ে গণশুনানি, অনলাইন অভিযোগ ব্যবস্থা ও স্বাধীন মনিটরিং টিম গঠন জরুরি। কেননা বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারা তখনই টেকসই হবে, যখন উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে সাধারণ মানুষ ও তাদের অধিকার। আমজনতার বঞ্চনা রোধে কেবল নীতি নয়, মাঠপর্যায়ে কার্যকর বাস্তবায়নই হতে হবে রাষ্ট্রের প্রধান অঙ্গীকার। কেননা অধিকার বঞ্চনা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত দুর্ভাগ্যের বিষয় নয়; এটি একটি প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত সমস্যা। এই সমস্যার সমাধানে আইনের কার্যকর প্রয়োগ, সেবা প্রদানে স্বচ্ছতা, এবং সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণমূলক জবাবদিহি ব্যবস্থা গড়ে তোলাই সময়ের দাবি।
- অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক
রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা সামাজিক ন্যায়বিচার উন্নয়নের বৈষম্য জবাবদিহির অভাব আইনি সহায়তার বঞ্চনা শিক্ষায় বৈষম্য স্বাস্থ্যসেবার সংকট গ্রাম-শহর বৈষম্য প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা সেবা খাতের দুর্নীতি অধিকার বঞ্চনা আমজনতার অধিকার
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: