
বাংলাদেশে আত্মহত্যা ক্রমে এক নীরব মহামারীর রূপ ধারণ করিতেছে। প্রতিবছর কমপক্ষে তেরো হাজার হইতে চৌষট্টি হাজার মানুষ আত্মহননের পথ অবলম্বন করে। প্রতি এক লক্ষ জনসংখ্যায় আত্মহত্যার হার দাঁড়াইয়াছে ন্যূনতম ৭.৮ জন হইতে সর্বোচ্চ ৩৯.৬ জন পর্যন্ত। সংখ্যার বিচারে ইহা নিছক একটি পরিসংখ্যান বলিয়া প্রতীয়মান হইতে পারে, কিন্তু প্রতিটি মৃত্যুর অন্তরালে রহিয়াছে ভাঙাচোরা পরিবার, নষ্ট স্বপ্ন এবং বিষণ্ণ সমাজ।
প্রথম আলো-এর ০৪ মার্চ ২০২৫ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লিখিত হইয়াছে—২০২৩ সালে বাংলাদেশে দৈনিক ৫৬ জন আত্মহত্যা করিয়াছে। বিশ্বব্যাপী আত্মহত্যার প্রবণতা নিম্নমুখী হইলেও, স্থানীয় জরিপে প্রতীয়মান হইয়াছে যে, বাংলাদেশে ইহার হার তুলনামূলকভাবে এখনও অধিকতর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক জরিপে (অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি) প্রকাশ পায়, দেশে প্রতি এক লক্ষে অন্তত বারো জন আত্মহত্যা করিতেছে। আরেক গবেষণায় প্রতিফলিত হয়, দেশে প্রতি দশজন কিশোর-কিশোরীর মধ্যে অন্তত একজন আত্মহত্যার প্রবণতায় আক্রান্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আত্মহত্যাকে ১০ হইতে ২৪ বৎসর বয়সি তরুণ-তরুণীদের মৃত্যুর দ্বিতীয় কারণরূপে চিহ্নিত করিয়াছে। এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক আত্মহত্যার হার এক-তৃতীয়াংশ হ্রাস করিবার অভিপ্রায় থাকিলেও বাংলাদেশ সে পথে বহুলাংশে পশ্চাৎপদ অবস্থানে রহিয়াছে।
২০১৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন অধ্যাপক কর্তৃক প্রণীত এক গবেষণায় "সুইসাইড প্রোফাইল" নির্মিত হয়, যাহাতে প্রতীয়মান হয় আত্মহত্যাকারীর গড় বয়স মাত্র ২৬.৪৮ বৎসর। জীবনের উন্মেষকালেই বহুজন হাল ছাড়িয়া দিতেছে। নারীর গড় বয়স ২২ বৎসর, আর পুরুষের ৩১.১২ বৎসর। কৈশোর-যুবক শ্রেণি, বিশেষত ১৫–১৯ বৎসর বয়সীরা, আত্মহত্যার নিকটতম ঝুঁকির স্তরে অবস্থিত।
এই প্রোফাইল অনুযায়ী, আঞ্চলিকভাবে চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহে আত্মহত্যার প্রকোপ সর্বাধিক। সমতল ভূমিতে ইহার হার উঁচু, যদিও পার্বত্য ও উপকূলীয় অঞ্চলেও প্রকোপ অনুল্লেখ্য নহে। শিক্ষার স্তর হইতে প্রতীয়মান হয়—মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা প্রবলতর। বৈবাহিক অবস্থার বিচারে আত্মহত্যাকারীদের প্রায় ৫৬ শতাংশ বিবাহিত, যাহা দাম্পত্য কলহ ও পারিবারিক চাপে জীবনবীতৃষ্ণার ইঙ্গিত বহন করে।
পেশাগত চিত্রে প্রতীয়মান হয় কৃষিজীবী ও গৃহিণীরাই প্রধান ভুক্তভোগী। নারীদের অর্ধাধিক গৃহিণী; ইহা গ্রামীণ সমাজে দারিদ্র্য, নির্যাতন ও অসহায়ত্বের প্রতিচ্ছবি। অর্থনৈতিকভাবে আত্মহত্যাকারীর অধিকাংশ নিম্নবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণিভুক্ত, যাহাদের মাসিক আয় দশ হাজার টাকার নিম্নে।
ধর্মীয় প্রভাবের ক্ষেত্রেও মিশ্র চিত্র দেখা যায়। ধর্মচর্চা থাকিলেও আত্মহত্যা প্রতিরোধে ইহা সর্বদা কার্যকর নহে। অর্থাৎ কেবল ধর্মীয় মূল্যবোধ নয়, বরং প্রয়োজন সামাজিক সহায়তা, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও পারিবারিক সংহতি। আবার পরীক্ষার চাপে বা জ্বীন ভূতের মতো কুসংষ্কারেও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে।
গবেষণায় প্রতিফলিত হয়, অধিকাংশ আত্মহত্যার পদ্ধতি হইল ফাঁস (৬২.৫%) এবং তদনন্তর বিষপান। নারী ও পুরুষ উভয়ই সমভাবে এই পথ অবলম্বন করিতেছে। কালের বিচারে অক্টোবর মাসে আত্মহত্যার প্রকোপ সর্বাধিক, এবং দিনের বেলায়, বিশেষত নিজ শয়নকক্ষে, প্রায় ৭৭ শতাংশ আত্মহত্যা সংঘটিত হয়।
অতএব প্রতীয়মান হয়, আত্মহত্যা কেবল ব্যক্তিগত দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ নহে; বরং ইহা সামাজিক বৈষম্য, মানসিক স্বাস্থ্যসেবার অভাব, পারিবারিক অশান্তি ও অর্থনৈতিক হতাশার সম্মিলিত প্রতিচ্ছবি।
কৌশলগত করণীয়
- উপজেলা পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন ও সুলভ কাউন্সেলিং ব্যবস্থা প্রবর্তন।
- শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিশোর-কিশোরীদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা ও সহায়তা কর্মসূচি চালু।পারিবারিক সহিংসতা, বাল্যবিবাহ ও দাম্পত্য নির্যাতন প্রতিরোধে কঠোর আইন প্রয়োগ।কমিউনিটি পুলিশিং সক্রিয়করণ, যাতে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিকে শনাক্ত ও সহায়তা প্রদান সম্ভব হয়।
- দারিদ্র্য হ্রাসে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি সম্প্রসারণ।
- গণমাধ্যমে আত্মহত্যা বিষয়ক দায়িত্বশীল প্রতিবেদন ও সচেতনতামূলক প্রচারণা।
- ৭. ধর্মীয় ও সামাজিক নেতৃবৃন্দকে সম্পৃক্ত করিয়া জীবনমুখী মনোভাব প্রচার।
- ৮. মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে গ্রামীণ জনগণের জন্য সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য করণ।
- ৯. সামাজিক সহায়তার নেটওয়ার্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও সম্প্রদায়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ।
- ১০. জাতীয় পর্যায়ে নিয়মিত আত্মহত্যা বিষয়ক জরিপ ও গবেষণা, যাহা প্রমাণভিত্তিক নীতি প্রণয়নে সহায়ক হইবে।
উপসংহার
আত্মহত্যা প্রতিরোধ কেবল চিকিৎসা কিংবা আইন প্রয়োগের দ্বারা সম্ভব নহে; ইহা এক বহুমাত্রিক সামাজিক আন্দোলন। রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবার যদি সম্মিলিতভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করে, তবে এই নীরব মহামারী প্রতিরোধ সম্ভবপর। অন্যথায় প্রতিটি আত্মহত্যা মানবিকতা, সমাজ ও ভবিষ্যৎকে আরও নিঃস্ব করিবে। অতএব আত্মহত্যা প্রতিরোধ এক স্বাস্থ্যকৌশল নয়, বরং এক গভীর মানবিক দায়িত্ব—জীবনের প্রতি আস্থা ফিরাইয়া আনা।
[কৃতজ্ঞতা স্বীকার: এই প্রবন্ধটি 2018 সালে বাংলাদেশ পুলিশের সহায়তায় ডঃ মোঃ ফারুক শাহ ও ডঃ মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান কর্তৃক সম্পাদিত বাংলাদেশে আত্মহত্যার কারণ এবং ঝুঁকি কমাতে কমিউনিটি পুলিশিংয়ের ভূমিকা শীর্ষক একটি গবেষণা ফলাফলের আলোকে প্রণয়ন করা হয়েছে]
— লেখক: ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান (লিটু), অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং উপদেষ্টা সম্পাদক, আমাদের অধিকা্রপত্র, odhikarpatranews@gmail.com
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: