
সম্পাদকীয়
বাংলাদেশের নগর ও গ্রামজুড়ে আজ যে নির্মম বাস্তবতা চোখে পড়ে, তাহা হইল পথশিশুর জীবনচিত্র। এরা তাহাদের স্বজন, ঠিকানা ও নিরাপদ আশ্রয় হারাইয়া রাস্তাকেই করিয়াছে জীবিকার উপায় ও বাসস্থানের বিকল্প। জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে প্রতিটি শিশুর শিক্ষা, খাদ্য, স্বাস্থ্য ও সুরক্ষার অধিকার নিশ্চিত করিবার কথা বলা হইলেও, বাস্তবে প্রায় ৩৪ লক্ষাধিক পথশিশু আজও অমানবিক জীবন যাপন করিতেছে (ইউনিসেফ, ২০২৪)।
এই শিশুরা নিত্যদিন ক্ষুধা নিবারণের তাগিদে নানা ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিযুক্ত হইতেছে—কাগজ কুড়ানো, রিকশা চালনা, হোটেল শ্রম, আবর্জনা সংগ্রহ ইত্যাদির মাধ্যমে। কেবলমাত্র পেটের ভাতের জন্যই তাহাদের নিষ্পাপ হাত আজ শোষণ ও বিপদের শৃঙ্খলে আবদ্ধ। তদুপরি, অপরাধচক্র ও দালালদের প্রলোভনে অনেকেই অল্প বয়সেই অপরাধ ও যৌনশোষণের অন্ধকারে নিমজ্জিত হইতেছে। বিশেষত কন্যাশিশুরা পতিতাপল্লীর পথে বাধ্য হইয়া নানা যৌনরোগের শিকার হইতেছে।
তবে প্রশ্ন হইল—কেন এই অধিকারহীনতা?
এর উত্তর নিহিত আছে বহুমাত্রিক কাঠামোগত সংকটে—
- অভিভাবকীয় যত্ন ও সুরক্ষার অভাব,
- দারিদ্র্য ও অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ,
- রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতা,
- শিক্ষা থেকে বিচ্ছিন্নতা,
- শোষণ ও নির্যাতনের সংস্কৃতি,
- এবং সামাজিক অবহেলা ও কলঙ্কিত দৃষ্টিভঙ্গি।
শিক্ষাই যেহেতু ভবিষ্যতের চাবিকাঠি, শিক্ষা থেকে বঞ্চনা তাহাদের দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রকে দীর্ঘায়িত করিতেছে। অনেকেই কখনো বিদ্যালয়ে পা রাখিতে পারে নাই, আবার কেউ বা টিকে থাকার সংগ্রামে পড়াশোনা ছাড়িতে বাধ্য হইয়াছে। ফলে জীবন জুড়িয়া তাহারা রইয়াছে সুযোগের বাইরে ও অধিকারহীনতার গভীরে।
তবুও এই আঁধারের মাঝেই দেখা যায় আলোকরেখা। পথশিশুরা তাহাদের সরলতা, সৃজনশীলতা ও সহনশীলতা লইয়া বাঁচিবার পথ খুঁজিয়া লইতেছে। ছোট ছোট স্বপ্ন আঁকড়ে ধরিয়া রাখিতেছে—যাহা সমাজকে একইসাথে অনুপ্রেরণা জোগায় এবং দায়বদ্ধতার কথা স্মরণ করাইয়া দেয়।
অতএব, পথশিশু সমস্যার সমাধান কেবল দান-খয়রাতের বিষয় নহে; ইহা মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্ন। প্রয়োজন একটি বহুমুখী কৌশল—
- নিরাপদ আশ্রয়, বিশুদ্ধ পানি ও স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চয়তা,
- পথশিশুদের জন্য ড্রপ-ইন সেন্টার প্রতিষ্ঠা,
- নিয়মিত খাবারের ব্যবস্থা,
- শিক্ষা ও পুনর্বাসন কর্মসূচির সম্প্রসারণ।
এইসব উদ্যোগ পথশিশুদের কেবল টিকে থাকার সুযোগই দিবে না, বরং তাহাদের জন্য একটি মানবিক ভবিষ্যতের দুয়ারও উন্মুক্ত করিবে।
সমাজের দায় আজ সুস্পষ্ট: পথশিশুরা আমাদেরই সন্তান। তাহাদের জন্য দায়িত্ব পালন করাই ন্যায্য, তাহাদের অধিকার নিশ্চিত করাই মানবিক কর্তব্য।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: